কিছুক্ষণ পর আমার এবরশন । আমাদের ভালোবাসার চিহ্ন, আমাদের সম্পর্কের সেতুবন্ধন, আমাদের পবিত্র সম্পর্কে আল্লাহর দেয়া সব চেয়ে শ্রেষ্ঠ উপহার টা আজ কেড়ে নেয়া হবে আমাদের থেকে। সাথে কেড়ে নেয়া হবে আমার সারাজীবনের মা হওয়ার ক্ষমতা ও। হ্যা আর কোন দিন ও মা হতে পারব না আমি ।
অথচ অহনের চেহারায় এ বিষয়ে কোন কস্ট বা মন খারাপের লেশ মাত্র দেখতে পাচ্ছি না আমি। সে এতটা স্বাভাবিক কিভাবে আছে আমার জানা নেই। অহন এর এই স্বভাবটা আমার বরাবর ই পছন্দ না ।। বড্ড চাপা স্বভাবের ছেলেটা নিজের মধ্যে কি হচ্ছে কাউকে বুঝতে দেবে না ।। কারো উপর রাগ করলে, অভিমান করলেও সেটা বুঝতে দেবে না । একদম স্বাভাবিক আচরণ করবে। কিন্ত আজ এই মোমেন্টেও এরকম অদ্ভুত আচরণ দেখার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না ।ওর কি একটুও খারাপ লাগছে না নিজের বাচ্চাটার জন্য????
আমার জন্য খারাপ লাগার কথা না হয় বাদ ই দিলাম।। আমি আর কোন দিন ও মা হতে পারব না তাতে তার কি?? সে তো বাবা হতেই পারে তার তো আর বাবা হওয়ার অধিকার কেড়ে নেয়া হচ্ছে না!!!!
,
আমি হসপিটালের বেড এ শুয়ে আছি ।আর সে আমার পাশেই বসে ফোনে ম্যসেঞ্জারে লুডো খেলায় ব্যস্ত।। ও আমার চোখে তাকানোর সাহস ও পাচ্ছে না এই ভেবে যে আমার দিকে তাকালেই বুঝি আমি আবার কেদে দিই।গত কয়েকটা দিন আমি এত কেদেছি যে অহন কে আমাকে থামাতে হিমশিম খেতে হয়েছে। ডক্টর বলেছে অপারেশন এর আগে আমাকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক থাকতে। বাস্তবতা মেনে নিয়ে আর কান্নাকাটি না করতে।।
বেশ অনেক্ষন ধরেই দুজন চুপচাপ। অহন এখন লুডো খেলা শেষ করে PUBG গেইম নিয়ে ব্যস্ত। মৌণতা কাটিয়ে নির্লজ্জের মতো আমি ই তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
— আচ্ছা অহন তুমি কি বিয়েতে এবার ও গোল্ডেন শেরওয়ানি পড়বে??? আমাদের বিয়েতে কিন্তু গোল্ডেন কালারে তোমাকে খুব মানিয়েছিলো । আমার সব ফ্রেন্ড আর কাজিনরা কিন্তু তোমার উপর ফিদা হয়ে গিয়েছিল ।তবে তুমি এবার মেরুন কালার ও ট্রাই করতে পারো ।
অহন ফোন থেকে চোখ সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল,
— কাফন রঙের পড়লে কেমন হয়???
অহনের সাথে এই এক বছর থাকতে থাকতে ওর কিছু অভ্যাস আমার মধ্যে আসতে শুরু করে দিয়েছে।এই যেমন অতিরিক্ত রাগ উঠলেও খুব শান্ত হয়ে যার উপর রাগ করেছি তার সাথে কথা বলা ।অহন এর এই কথায় আমার যথেষ্ট রাগ উঠেছে কিন্তু তবুও খুব স্বাভাবিক ভাবে আমিও উত্তর দিলাম
— ও আচ্ছা?? সাদা কালার পড়তে চাচ্ছ?? হুম মোটামুটি মানাবে ।তুমি তো ফর্সা মানুষ সব কালার ই মানায়।আমার মতো শ্যামলা মানুষের যত জ্বালা কোন রঙ ই মানায় না ।তবে তোমার এবারের বউ তোমার সাথে একদম মানান সই ই হবে। কিন্ত তোমাদের বিয়েতে আমার কোন কালার টা পড়া উচিত?? কালো ??
অহন আমার দিকে তাকিয়ে আবার কিছু একটা বলবে ঠিক তখন ই কেবিনে মা আর বাবা এলো । সে তাদের দেখে কথা টা আর বলতে পারলো না।ও আমার পাশ থেকে উঠে গিয়ে বাবা মাকে বসতে বলল।হ্যা,,আমার বাবা মা এখ্ন ও তাদের একমাত্র জামাই এর দ্বিতীয় বিয়ের ব্যপারে কিছুই জানে না ।
জামাই তাদের কাছে হীরার টুকরা। সত্যিই কি হীরার টুকরা? কে জানে???
.
অহন কে তো তারাই আমার জন্য পছন্দ করেছিল। যদিও এ বিয়েতে আমার মত ছিল না । তবে মত না থাকার কারণ টা তুচ্ছ হিসেবে উড়িয়ে দিয়ে তারা প্রায় জোর করেই অহন এর সাথে আমার বিয়ে দেয়। ভালো ফ্যামিলি,ভালো জব, ভালো স্যলারি,বিনয়ী,চেহারা মাশ আল্লাহ এসব গুন দেখে আমার বাবা মা আর ছেলেকে হাত ছাড়া করেন নি ।। আমার ও কিন্ত তার অন্য কোন বিষয়ে প্রবলেম ছিল না ।তবে প্রবলেম ছিল নাম টা নিয়েই। আবার বিয়ের রাতেই জানতে পারলাম অহন আমাকে আমার নামের জন্য ই বিয়ে করেছে।অয়নী ।।।
যাই হোক,দেখতে এক বছর হয়েই গেল আমাদের বিয়ের। গত পরশুদিন আমাদের anniversary ছিল । তবে অন্যদের মতো জাকজমক কোন পার্টি রাখা হয় নি ।কারণ আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন অত্যন্ত রক্ষণশীল। তারা এসব পছন্দ করেন না ।আর অহন বাবা মায়ের অতি বাধ্য সন্তান। একমাত্র সন্তান।। তবে আমার প্রতি ও সে সেন্সেটিভ। আমি পিজ্জা খেতে দারুন ভালোবাসি বলে সে অফিস থেকে ফেরার পথে আমার জন্য ডমিনজ এর স্পেশাল পিজ্জা নিয়ে এসেছে। মাঝ রাতে চুপিচুপি পিজ্জাটাই কেক এর মত কেটে আমরা anniversary পালন করেছি।। কিন্তু আগামী বছর অহন কার সাথে anniversary পালন করবে?? আর আমাদের anniversary টা?? অহন কি ভুলে যাবে?? হুম ভুলে যাওয়াই ভালো ।
"যে যত বেশি ভুলতে পারে তার জীবন তত বেশি সুন্দর ।
পৃথিবীতে সব চেয়ে বড় মানসিক টর্চার হল মনে পড়া আর আর মনে থাকা ।"""
.
কিছুক্ষণ হলো জ্ঞান ফেরার পর আমার আর বুঝতে বাকি রইল না যে , এতক্ষণে আমার সব শেষ হয়ে গিয়েছে।। আমি এখন শুধু আকৃতিতেই নারী অন্যকিছুতে নয়।। একটা মেয়ের মা হওয়ার ক্ষমতা না থাকলে সে আবার কিসের মেয়ে মানুষ??? তিতা হলেও সত্যি যে আমাদের সমাজের অনেকেই এখনও এই নীতিতে বিশ্বাসী ।।
প্রচন্ড ব্যথায় আমি আমাদের বাচ্চাটার জন্য কাদতেও পারছি না ঠিক মতো । বাবুটা হয়ত এতক্ষণে নিজের ঠিকানায় চলে গেছে । ভালোই হয়েছে বেহেশতের ফুল আবার বেহেশতেই ফিরে গেছে । এই কৃত্তিমতায় ঘেরা পৃথিবীর মুখ তাকে দেখতে হলো না । এই পৃথিবীর সবাই নিষ্ঠুর। হ্যা অহন ও,, আমার কথা একটা বার ও শুনলো না । সবার সাথে হা মিলিয়ে চলল।।
এই মুহুর্তে চোখ দিয়ে পানিফেলা ছাড়া আমার আর কিচ্ছু করার নেই । আমার চোখ দিয়ে অনবরত জল পরেই যাচ্ছে । অহন আমার পাশে বসে আমার এক হাত আলতো ভাবে ধরে আছে । আর চোখ মুছে দিচ্ছে।। আমি বোবা পুতুল এর মতো আওয়াজ ছাড়াই কেদে যাচ্ছি।। খুব জোরে কাদার ইচ্ছে করলেও এই মুহুর্তে আমি সেটা পারছি না । মানে সেই সামর্থ পাচ্ছি না ।
অহন আমার কানের কাছে আলতো ভাবে বলছে,
— অয়নী ,'পরি' বউ আমার কেদো না ।শরীর খারাপ করবে আরো ।
আমি অস্ফুট স্বরে কিছু বলতে চেয়েও পারলাম না ।। 'পুরক' কথাটা বলতে গিয়েও যেন গলায় আটকে গেল।। মনে হলো এখ্ন থেকেই অহন কে এই নামে ডাকার অভ্যাস টা বাদ দেয়া উচিত আমার ।
..
মনে আছে,বিয়ের রাতেই অহন আমাকে বলেছিল আমরা একে অপরের পরিপূরক।।।।
তারপর থেকে নিজেদের মধ্যে কথা বলার সময় সে সব সময় ই আমাকে আদর করে আহ্লাদ করে 'পরি বৌ 'বলে ডাকত ।এখন ও ডাকছে,তবে কিছুদিন পর হয়ত আর ডাকবে না ।হুম আমিও তাকে 'পুরক সাহেব' বলতাম।। কিন্ত এখন হয়ত আর বলা হবে না ।।
আমি ছিলাম অহন এর 'পরি' আর সে আমার 'পুরক'।আমরা দুজন একে অপরের 'পরিপূরক'।।।।
আচ্ছা একজন মানুষের কি একই সাথে দুজন পরিপূরক থাকতে পারে ??? নাকি কিছুদিন পর পর পরিপূরক বদলে যেতে পারে?????
হয়ত পারে,, এইত আর কিছুদিন মাত্র। অহন এর নতুন বৌ আসবে বাড়ি । তখন সে হবে অহন এর পরি বৌ,,,,আর আমি???
আমাকে হয়ত আর মনেই থাকবে না ওর। মাত্র তো একটা বছরের সংসার। দুঃস্বপ্ন ভেবেই হয়ত ভুলে যাবে এই কয়েকটা দিন।।
.
হসপিটালে থেকে কিছুদিন পর ডিসচার্জ করে দেয়ার পর কিছুদিন বাবার বাড়িতে ছিলাম।সেখান থেকে অহন দের বাড়ি মানে শ্বশুর বাড়ি ফিরেই দেখতে পেলাম বাড়িতে বেশ আয়োজন চলছে। কিছুটা আন্দাজ করলেও শাশুড়ি মাকে জিজ্ঞেস করলাম
— মা, কেউ আসবে নাকি বাড়িতে??
— হ্যা, অহন কে আজ দেখতে আসবে আর বিয়ের ডেট ও ফিক্স হবে আজ। তুমি আজ আর রুম থেকে বের হয়ো না । ওরা জানে তুমি বাপের বাড়িতেই থাকবে এখন থেকে।
তারপর আমার খালা শাশুড়ির সাথে বিড় বিড় করে বলতে বলতে ড্রইং রুমে ঢুকল আর কথা গুলো যে আমাকে ইচ্ছে করেই শোনানো হচ্ছে সেটাও আমি ভালো ভাবেই বুঝতে পারছি।
— কত বার ছেলেটা কে বললাম ডিভোর্স দিয়ে দে। তাহলে আর এত ঝামেলা হয় না। । আরো বড় ফ্যামিলি তে সম্বন্ধ করা যেত ।কি বুঝল কে জানে ।। কোন কথা তো ঠিক মতো বলতে চায় না।। এই যুগে এক সাথে দুই বৌ কেউ রাখে ।। পাড়ায় মুখ দেখাব কিভাবে কে জানে।।। এই বাঝা টারে ছেড়ে দিলে কি ক্ষতি আমি কিছু বুঝি না ।। বৌ তো আসতেছে ই আর একটা ঐ বাঝা টার চেয়ে হাজার গুন সুন্দরী ।একদম আমার অহনের সাথে মানানসই।। তাও ভালো বিয়েটা তে রাজি করাতে পারছি ।
— আরে আপা, কিছু দিন সুন্দরী নতুন বৌ এর আদর সোহাগ পাইলে এমনি ঐ বাঝা কাইল্লানী রে ছেড়ে দেবে অত ভাইবো না তো।
.
.
.
চলবে.............................