কিন্তু সেদিন কি আর বুঝেছিলাম , ওহি হুট করে আমাদের বাসর ঘরে ঢোকার মত ই আমাদের লাইফে ও ঢুকে পড়বে??
....
যদি বুঝতাম ....ইশ যদি বুঝতাম .. অবশ্য বুঝলেই বা কি করতাম????
.
এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি নিজেই জানিনা ।।
.
খুব সুন্দর বছর তিন চারেক এর একটা ফুটফুটে মেয়ের ডাকে ঘুম ভেঙে গেল ।
.
লাল ফ্রক পড়া পরীর মতো একটা মেয়ে।। হাতে লাল ছোট্ট ছোট্ট কাচের চুড়ি , পায়ে লাল জুতো,লাল রঙা আলতা দু পায়ে,, পুরো প্রিনসেস একটা ।
অহন ওকে কোলে করে নিয়ে এসেছে। দরজায় এসে অহন ওকে নামিয়ে দিল আর ও অহনের কোল থেকে নেমেই ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার বুকে। আমি হাটু গেড়ে বসে আছি ওকে ওকে বুকে নিয়ে।আর ও মিস্টি করে আমায় ডাকছে
""মামুনি""
.
আযানের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো । বুঝতে বাকি রইল না সব ই স্বপ্ন ছিল ।
.
এরকম একটা লাল ফ্রক পড়া মেয়ের স্বপ্ন আমি আগেও বহুবার দেখেছি। অহন কে স্বপ্ন টার কথা বললেই ও হেসে উড়িয়ে দিত। আর ওর হাসি দেখে আমি যখন রাগ করতাম ও বলত আমাদের মেয়েকেও আমরা তোমার স্বপ্নের মতো করেই সাজাবো। ভাল করে মনে রেখ মেয়েকে কেমন সাজে দেখেছ। মেয়ে পৃথিবী তে আসলে ওসব কিনে সাজাতে হবে তো !!!!
.
আচ্ছা অহন আর ওহির মেয়েকে ওরা কিভাবে সাজাবে??লাল ফ্রকে নাকি নীল ফ্রকে? মেয়ে কেন বলছি? ছেলেও তো হতে পারে।। ছেলে হলে আমার শাশুড়ি ও বেশি খুশি হবেন ।উনার তো আবার বংশের বাতি চাই।।।
.
সকালে অহন অফিস যাবার জন্য রেডি হয়ে খেতে বসল। মা ওকে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
— অহন আজ তোমার কিসের অফিস?
— মানে??
— বিয়ের পরের দিন ই তুমি অফিস যাবে??
— হুম তো?
— তো আবার কি? আজ তোমার খলারা আসবে। এখ্ন তো আর ওরা শুধু তোমার খালা খালু ই না শশুর শাশুড়ি ও। আর আজ হালকা কিছু অনুষ্ঠান ও আছে।
— কিসের অনুষ্ঠান?? কোন অনুষ্ঠানের দরকার নেই। আমি আবার বলছি কোন অনুষ্ঠান যেন বাড়িতে না হয় । লোক ডেকে জোকার বানাতে চান আমায়?? বিয়ে করতে বলেছেন করেছি। ব্যাস এটা নিয়ে আর কোন বাড়াবাড়ি দেখতে চাই না আমি। খালা খালু আসতে চায় আসুক। কিন্ত আর কোন ব্যাক্তি আমি দেখতে চাই না এ বাড়ি তে।
— আচ্ছা,আচ্ছা তুমি যা চাইছ তাই হবে । কিন্তু অফিস তো না গেলেই পারো আজকের দিনটা ।
— আমার অফিস আপনাদের মতো এত নাটক বোঝে না যে রোজ রোজ বিয়ের জন্য আমাকে ছুটি দেবে।দাও খেতে দাও।
.
আমি এগিয়ে গেলাম ওকে খাবার বেড়ে দিতে। এক বছরের ও বেশি সময় এর অভ্যাস এটা আমার ।
.
অয়নী, আজ ওহি বেড়ে দিক । বিয়ের পরের দিন ওর ও তো শখ আহ্লাদ আছে নাকি?
মা আমাকে থামিয়ে দিয়ে একথা বললেন।
.
— আম্মা অয়নী ই দিক। ওহি এখ্ন ও ঘুম থেকে ওঠে নি।
.
অহনের প্রথম কথা টা শুনে বেশ আস্থা আর ভরসা পেয়েছিলাম ওর উপর খানিক সময়ের জন্য এই ভেবে যে ওহি আসলেও সে হয়ত আমাকে আমার জায়গা তেই রাখতে চায়। আমার ওর উপর ছোট ছোট অধিকার গুলো সে কেড়ে নিতে চায় না ।কিন্ত যখন ই বলল ওহি ঘুমে তখন ই আমার বোঝা হয়ে গেল আমার অবস্থান টা এখ্ন ঠিক কোথায় । আমি এখ্ন আর অহনের পরিপূরক নই। আমি এখন ওহির বিকল্প।।
.
খাবার বেড়ে দিচ্ছি আর ঠোট চেপে কান্না আটকাতে চেষ্টা করছি।। তবুও চোখ যেন অঝোর পানিতে ছলছল করছে।। অহন ব্যপার টা খেয়াল করল।
.
— কি ব্যাপার রাতে ঘুমাওনি নাকি? চোখ মুখ অমন হয়ে আছে কেন? এরকম করলে কিভাবে হবে?? ডক্টর না তোমাকে ঠিকমত ঘুমাতে বলেছে? রাতে মেডিসিন নাও নি তো? ঘুমের মেডিসিন টাও নাও নি?
— তুমিও তো সারারাত ঘুমাও নি। কই আমি তো তোমাকে কিছু বলছি না। তাহলে তোমার এত প্রশ্ন কেন? অফিস না গিয়ে ওহির মতো ঘুমালেই পারতে । রাতে তো দুজনের ই ঘুম হয় নি।
.
আমার কথা টা শুনে অহন মাথা টা নিচে নামিয়ে নিল। সে আর কোন কথা না বলে চুপচাপ খেয়ে অফিস গেল।।
.
রাতে ওহির মা চলে যাওয়ার আগে আমাকে তাদের রুমে ডেকে পাঠালেন এবং বুঝাতে শুরু করলেন,
— দেখ অয়নী , অহন ছেলে মানুষ। ও হিতাহত জ্ঞান না করেই একটা কথা বলে দিয়েছে। কিন্তু তুমি ই বল মা এভাবে কি হয় আজকাল কার যুগে?
— খালা আম্মা, আপনি কি বলতে চাচ্ছেন ? স্পষ্ট করে বললে সুবিধা হয় আমার জন্য ।
— বলছি তুমি আর কত দিন থাকতে চাও এবাড়িতে? দেখো দুই বৌ এক সাথে এক ই বাড়িতে দেখ্তে কেমন একটা লাগে না??? আমি বলি কি তুমিও নতুন ভাবে নিজের জীবন শুরু করো । অহন কে ডিভোর্স দিয়ে জীবন টা গুছিয়ে নাও। এভাবে চলে না জীবন। অহন আর ওহি তো নতুন করে শুরু করেই নিয়েছে।তুমিও....
।.
আমি কিছু উত্তর দেয়ার আগেই ওহি রুমে এসে উপস্থিত ।
— মা তুমি কি উল্টো পাল্টা বুঝাচ্ছ ভাবি কে??? সরি আমার আপুকে?
ওহির মুখে আপু ডাক শুনে শুধু একবার তাকালাম ওর দিকে।
সারা জীবন ই আমার একটা বোনের শখ ছিল মনে আছে অয়নের জন্মের পর আমি খুব রাগ করেছিলাম মাকে বলেছিলাম, তুমি বোন আনতে পারলে না আমার জন্য? খুব রাগ করেছিলাম প্রথম কয়েক দিন অয়নের উপর।। পরে তো অয়ন আমার কলিজার একটা টুকরায় পরিনত হয়েছে। খুব ভালোবাসি আমার ভাই টা কে।
কিন্ত বোনের আকাঙ্ক্ষা যে মন থেকে একদম চলে গেছে তা না। এখ্ন ও মাঝে মাঝে মনে হয়,ইশ আমার যদি একটা বোন থাকত। অন্তত মনের সব কথা গুলো কাউকে বলতে পারতাম।
কিন্তু এমন বোন আমি কোন দিন ও চাই নি। সতীন বোন ।।।।
.
খালা ওহি কে বোঝাতে শুরু করলেন। ওহি কিছুতেই রাজি হচ্ছে না ।
— ওহি নিজের ভালো তো পাগল ও বোঝে। আর তুমি কি না?
— হ্যা মা, আমি পাগল নই তাই হয়ত নিজের ভালো নিজে বুঝছি না। অয়নীপু এখানেই থাকবে। কোত্থাও যাবে না ।
— ওহি তুমি কিন্ত নিজের সংসারের অশান্তি নিজেই ডেকে আনছ।
— মা অয়নীপু কে নিয়ে তো আমাদের কোন সমস্যা হচ্ছে না। তো তোমাদের এত সমস্যা কি তাই তো বুঝ্ছি না।
ওহি আমার হাত ধরে রুম থেকে আমাকে নিয়ে বের হতে হতে বলল,
— আপু তুমি মার কথায় কান দিও না তো । তুমি আমাদের সাথেই থাকবা।
—সেটা তুমি না বললেও আমি থাকবো । তুমি কি ভেবেছ এসব বলে দয়া দেখাবা আমাকে? একদিন হল বৌ হয়ে এসেই আমার ওপর নিজের কতৃত্ব দেখাবা যেভাবে এক দিনেই অহন কে নিজের করে নিয়েছ?
— আপু আমি কিন্তু এত কিছু ভেবে বলি নি। তুমি শুধু শুধু কথা অন্য দিকে নিয়ে যাচ্ছ।খুব রাগ করে আছ আমার ওপর তাই না??
— নাহ রাগের কি আছে? তোমার আর অহন এর বিয়েটা তো ঠিক হয়েই ছিল মাঝখান থেকে আমি চলে এসেছি।।
— এভাবে বলো না আপু।
— এর চেয়ে ভালো ভাবে আমি আর কথা বলতে পারি না ওহি।
.
কিছু দিন পর আমার বাবা মা আসলেন আমাকে দেখতে। বিপত্যি টা ঘটল তখন ই।
বাবা মা জানতে পারলেন তাদের জামাই প্রায় মাস দেড়েক হলো নতুন বিয়ে করেছে।
আর আমি তাদের কিছুই জানাই নি। ফোনে এত বার কথা হয়েছে তাও। মা আমাকে একটা থাপ্পড় ও দিয়েছে এরকম খামখেয়ালির জন্য ।
এসব জেনে বাবা মা আমাকে তাদের সাথে নিয়ে যেতে চাইল। আমার কি করা উচিত কিচ্ছু বুঝতে পারছি না । বাবা মায়ের সাথে চলে যাব নাকি অহন এর জেদ এর উপর আমিও জেদ দেখাতে থেকে যাব।।।
.
মনে মনে শুধু অহন এর জন্য অপেক্ষা করছি। আমি জানি ও আমাকে যেতে দেবে না ।
আজ বৃহস্পতি বার । হাফ ডে । তাড়াতাড়ি ই এলো ।
.
এসে বাবা মাকে হুট করে দেখে ও যে কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছে তা আমি ওর মুখ দেখেই বেশ বুঝতে পারছি।।
তবুও যথেষ্ট স্বাভাবিক ভাব নিয়ে হাসি মুখে সে বাবা মার সাথে কথা বলতে শুরু করল।
— আস সালামু আলাইকুম ।বাবা কেমন আছেন?
বাবা ওর কথা শেষ না হতেই আমার সামনেই অহন কে ঠাস করে একটা চড় দিয়ে দিল।আমি বুঝতে পেরেছি এরকম একটা সিরিয়াস মমেন্টে দাত বের করে হেসে কেমন আছেন জিজ্ঞাস করা অহন এর একদম উচিত হয় নি । জামাই আর একটা বিয়ে করেছে সেটা শোনার পর কোন মেয়ের বাবা মা ভালো থাকবে?? আর মাথা ঠিক থাকবে? তাও আবার সেই জামাই ই জিজ্ঞেস করছে কেমন আছেন।
অহন দাতে দাত চেপে চড় টা হজম করল।।
— অহন তোমার কি মনে হয় কেমন আছি আমরা?? নিজের ছেলে ভেবেছিলাম তোমাকে। একমাত্র মেয়েটা কে ভরসা করে তোমার হাতে তুলে দিয়েছিলাম । আর তুমি????? তোমাকে সত্যিই আমরা চিনতে ভুল করেছি । যাই হোক আমাদের অয়নী কে আমরা নিয়ে যাচ্ছি। মেয়েটা তোমার জন্য ই এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল।
— এটা কেমন কথা?? অয়নী কে আপনারা নিয়ে যেতে পারেন না। ও এখানেই থাকবে। অয়নী তুমি কিছু বলো ।
— অয়নী কি বলবে? ওর কিছু বলার নেই।
— ওর কিছু বলার নেই মানে? বাবা আপনি অয়নী কে জিজ্ঞেস করে দেখুন কেন আমি এই কাজ করেছি,???বিয়ে বিয়ে করে আমার মাথা খারাপ করে দিয়েছিল এরা। কি অয়নী এখ্ন নিরীহ সাজা হচ্ছে তাই না????
.
অহন এর এসব কথা শুনে বাবা আরো রেগে গেলেন ।শেষ মেস বাবাকে বুঝাতে পারলাম যে আমিই জোর করেছি অহন কে বিয়ে করতে। সে রাজি ছিল না ।।
তবুও তারা আমাকে জোর করল তাদের সাথে যাওয়ার জন্য ।এভাবে তারা আমাকে অবহেলায় ফেলে রাখ্তে চায় না।
.
অহন বাবাকে মাগরিবের নামাজ পড়তে বাবাকে সাথে করে নিয়ে গেল মসজিদে। অহন আমাদের বাড়িতে গেলেও বা বাবা এ বাড়িতে এলেও তারা সব সময় ই একসাথে মসজিদে নামাজ পরে। আগেই বলেছি জামাই শশুড়ের খুব মিল তাদের।
.
অহন বাবাকে মসজিদে নিয়ে গিয়ে ঠিক মানিয়ে আনল। বাবা এসে বলল,অয়নী তুমি যদি যেতে না চাও জোর করব না তোমাকে। তোমার জীবন তুমিই সিদ্ধান্ত নাও।জন্মের পর থেকেই কোন দিনও কোন ব্যাপারে জোর করি নি তোমাকে।
.
তবে মা আমাকে নিয়ে যাবেই যাবে ।
কিন্ত আমি জোর করেও রয়ে গেলাম। অহন আর এখ্ন আমার খাবার টেবিল ছাড়া তেমন একটা কথা হয় না। এভাবেই চলছিল দিন গুলো।
.
মাথায় বাজ ভেঙে পড়ল সেদিন যে দিন শুনলাম ওহি প্রেগন্যান্ট!!!
.
.
.
চলবে...............................