স্ত্রী হিসেবে তোর যেটুকু প্রাপ্য সেটুকু অহন তোকে দিলেই খুশি থাকিস। এর বেশি কিছু চাস না।
.....
হুম অহন আমাকে আমার প্রাপ্যর চেয়েও অনেক বেশি কিছু দেয়। যে টুকু দিতে পারে না তার জন্য সে দায়ি নয়। পরিস্থিতি দায়ী আর সে তো শুধু মাত্র পরিস্থিতির স্বীকার ।তার প্রতি কোন অভিযোগ আমার নেই।
.
— পরি বৌ ,তোমার কি মন খারাপ ?
— কই না তো?
— তাহলে কি শরীর খারাপ করছে?
— উহু।
— তাহলে এই অসময় ঘুমাচ্ছ যে???
— এমনিতেই।কখন যে চোখ লেগে এসেছিল বুঝতেই পারি নি
— উহু। মিথ্যা কথা । আমি জানি তোমার মন খারাপ। আমাদের প্রথম anniversary টা অন্য দের মতো করে সেলিব্রেট করতে পারছি না বলে মন খারাপ তো?
— না না তেমন কিছু না ।
— তেমন কিছু নয় বললেই হলো??? আমি বুঝি না?কি করব বলো বাসায় এসব পার্টি রাখা আম্মা আর বাবা কেউ ই পছন্দ করেন না । আর তোমার এই অবস্থায় বাইরে তো পার্টি করা সম্ভব নয় । আবার আম্মা যদি শোনে তোমাকে এই অবস্থায় বাইরে পার্টির জন্য নিয়ে গেছি বুঝতেই পারছ বাড়ির পরিস্থিতি কই গিয়ে দাঁড়াবে? আর তোমার ও এসময় বাইরের খাবার খাওয়া ঠিক না । এমনিতেই প্রায় প্রতিদিন ই বমি কর।
—হুম
— শোন, এইবার আর মন খারাপ করো না।। আগামী বছর তিনজন একসাথে ভালো ভাবে সেলিব্রেট করব ওকে?
— তিন জন??
— হুম তিন জন ই তো । যার জন্য এত কষ্ট করছ সে তো চলেই আসবে কয়েক মাস পরে ।
— হুম।।।। ইন শা আল্লাহ্ ।
— ইন শা আল্লাহ্ ।
.
অহন আমার জন্য ডমিনজ এর স্পেশাল পিজ্জা এনেছিল। কারণ সে জানে পিজ্জা দেখলেই আমার মন আলোর গতিতে ভালো হয়ে যায় ।
বিছানার ওপর পিজ্জা তেই মোম ধরিয়ে কেক এর মত করে কাটলাম দুজন । অহন মাত্র দুটো স্লাইস খেয়েছে। বাকিটা আমি।
সে আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে পিজ্জা খাওয়াতে খাওয়াতে গান ধরল,
তোকে দেখে হয়েছে মনে প্রেমের হাতেখড়ি
পৃথিবীতে তুই আমার আর আমি শুধু তোর ই
কোথায় তোকে লুকোই আমি সেই ভাবনায় মরি
তুই যে আমার খুব আদরের ডানা কাটা পরী
যে স্বপ্ন একেছি চোখে আমি বরাবরই
আজকে যে তা পুর্ণ হল সেই খুশি তে মরি
তুই যে আমার খুব আদরের ডানা কাটা পরী ।
.
— পুরক সাহেব ভুল হচ্ছে তো । লাইন গুলো ঠিক মতো সিরিয়ালে গান । কি এক লাইনের মধ্যে অন্য লাইন ঢুকিয়ে দিচ্ছেন?
— ভুল হচ্ছে বুঝি? সে যা হয় হোক। আমি আমার বৌ এর জন্য এভাবেই গাইব।
— আহারে। দাও পিজ্জা দাও। কখন থেকে হা করে আছি
— নাও। আর শোন আজই কিন্তু শেষ খাওয়া ওকে? আমাদের ময়না পাখি আসার আগে আর নয় । আর এসবের বায়না ধরবে না। ডক্টর এসব বাইরের খাবার খেতে নিষেধ করেছে।। আজ স্পেশাল ডে ছিল। আর আপনার মন খারাপ ছিল বলে এনেছি ।
— দেখা যাবে সেটা। আগে আজকের টা তো খাইতে দাও ঠিক মতো ।
—
— হুম নাও।
.
এরই মধ্যে মা ডেকে পাঠালেন রাতের খাবার খাওয়ার জন্য । পিজ্জা খেয়ে এমনিতেই পেট ভরে গেছিল।।তাও একটু খেলাম জোর করেই ।
তারপর মেডিসিন নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি। অহন ও। অহন সব ই ঘুমের সময় আমার উপর হাত রাখে। সেদিন ও তার ব্যতিক্রম কিছু ঘটে নি। কিন্ত সেদিন আমার ই অস্বস্তি হচ্ছিল। পেটে হালকা ব্যাথা ছিল।
.
কিন্তু কিছুক্ষণ এর মধ্যেই সে ব্যাথা আর হালকা রইল না । প্রকট আকার নিল। আর সহ্য করা যাচ্ছিল না । অহন কে ডাক দিতে বাধ্য হলাম।
.
ও উঠতে উঠতেই আমার ওর টি শার্ট আর বেড শিট এর ওপর বমি করা সারা। অহন টি শার্ট খুলেই আমাকে জড়িয়ে ধরল।
— কি হয়েছে?? শরীর খারাপ লাগছে?? কিচ্ছু হয় নি। কিচ্ছু হয় নি। ভয় পাচ্ছ কেন? হতেই পারে এরকম।আমি পরিস্কার করছি এগুলো।
আমি শুধু অহন কে বললাম, অহন আমার প্রচন্ড পেইন হচ্ছে। আর বমি পাচ্ছে আরো ।আমাকে ওয়াশ রুমে নিয়ে চলো । আমি আর পারছি না ।
.
অহন কোলে করেই ওয়াশরুমে নিয়ে গেলো আমাকে ।ব্যাথায় আমি দারাতেও পারছিলাম না ঠিক মতো । ও আমাকে ধরে থাকল আর আমি বমি করে যাচ্ছি তো যাচ্ছিই।
ততক্ষণে বাড়ির অন্যরা ও জেগে গেছে ।
অহন শুধু আমাকে বলল, দেখলে তো অয়নী কেন আমি ইদানিং তোমাকে এসব বাইরের খাবার খেতে দিই না । আমি কিন্তু নিষেধ করেছিলাম অতগুলো পিজ্জা খেতে। কি হল এখন? কে কস্ট পাচ্ছে? গ্যাস ফর্ম করেছে বোঝাই যাচ্ছে ।
.
কিন্তু আমি বুঝতে পারছি এটা গ্যাস ফর্ম করার ব্যাথা নয়। আমার মনে হচ্ছিল পেটের ভেতর থেকে কেউ কিছু ছিড়ে নিয়ে যাচ্ছে।
.
অহন ওয়াশরুম থেকে আমাকে কোলে করে নিয়ে এসে বেডের সাথে হেলান দিয়ে শুইয়ে দিল। কিন্তু আমার ব্যথা কমার চেয়ে আরো দিগুন হারে বাড়তে লাগল। চোখে অন্ধকার দেখা শুরু করলাম মনে হয় । কিছুক্ষণের মধ্যে বুঝতে পারলাম ব্লিডিং হচ্ছে।
আমার পাশে মা বসে ছিলেন। আমি উনাকে বললাম। মা অহন কে তাড়াতাড়ি এম্বুলেন্স ডাকতে বললেন।
.
অহন আমাকে কোলে করে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামাচ্ছিল। আমি ব্যাথায় অহনের বুকের ভেতর মাথা গুজে নিয়েছিলাম। আস্তে করে ওকে বললাম , পুরক সাহেব আমি মনে হয় আর বাচব না ।
মনে আছে ও সেদিন আমাকে এই এক বছরের মধ্যে সব চেয়ে জোরে ধমক দিযেছিল।
— চুপ।এটা কোন বোকা বোকা কথা বলার সময় নয় অয়নী।
.
হসপিটালে নেয়ার পর ডক্টর চেক আপ করেই বললেন,
— উনার তো টিউব ব্লাস্ট হয়েছে । অপারেশন করতে হবে ।
— মানেহ?? কি বলছেন এসব? কিছুক্ষণ আগেও তো ঠিক ছিল ও।(অহন)
— একচুয়ালি উনার ফেলোপিয়ান টিউব ব্লাস্ট হয়ে গেছে । মানে বাচ্চার ভ্রূণ ইউটেরাসে আসে ই নি উনার।ভ্রূণ ফেলোপিয়ান টিউবে ই রয়ে গিয়েছিল।। একজন নারীর জরায়ু গর্ভধারণ অবস্থায় প্রায় বিশ গুন বৃদ্ধি পায় ধীরে ধীরে ফিটাস এর বৃদ্ধির সাথে সাথে ।ভ্রূণ সময়ের সাথে বাড়ছিল কিন্ত ফেলোপিয়ান টিউব তো জরায়ুর মত বাড়তে পারছিল না । কিছুদিন পর আলট্রা সাউন্ড এর সময় হলেই ডক্টর উনার এই অস্বাভাবিকতা বুঝতে পারতেন এবং যথেষ্ট ব্যবস্থা নিতেন। । কিন্তু তার আগেই তো ..
— কিন্ত তার আগেই এমন কিভাবে হল?
—....মে বি ভারি কোন কাজ করেছেন উনি এ জন্য পেটে চাপ পেয়েছেন আর....
— ভারি কাজ??? প্রশ্নই ওঠে না ।
— তাছাড়া এত তাড়াতাড়ি এমন হওয়ার কথা তো না।
.
অহন এবার আমার দিকে তাকালো ।আমি শুধু মাথা নিচু করে নিলাম।
.
ডক্টর বললেন কিছুক্ষণ পর অপারেশন করা হবে। আরো কিছু টেস্ট দিলেন। তারপর জানতে পারলাম আমার দুটো টিউবে দুটো বেবি ছিল। একটা পুরো ব্লাস্ট অন্যটা ও প্রায় ব্লাস্ট।আর এখন দুটো টিউব ই কেটে ফেলতে হবে । মানে মা হওয়ার ইচ্ছা এই মুহুর্ত থেকে বাদ দিতে হবে আমার ।
.
এসব শুনে আমার মনে হচ্ছিল আমি এই মুহুর্তে পাগল হয়ে যাব। আমি যে কি পরিমান কেদেছি নিজেও জানি না ।
ডক্টর আমাকে অনেক বুঝালেন সেই সাথে অহন ও। কিন্ত মা ঠায় হয়ে আমার পাশে দাড়িয়ে থাকলেন। বসলেন ও না আমার পাশে একটু। ডক্টর আমাকে স্টেবল হওয়ার জন্য,,, মেন্টালি প্রিপারেশন নেয়ার জন্য কিছু সময় দিয়ে গেলেন। অহন কে আমার পাশে থাকতে বলে গেলেন। এসময় তাকেই আমার পাশে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।।।।।।
.
ডক্টর চলে যাবার পর অহন আমাকে আবার জিজ্ঞেস করল,
অয়নী, সত্যি ই ভারি কিছু কাজ করেছ?
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি দিতে দিতেই মা বলে উঠল,
— হ্যা অহন।তোমার বৌ আমার ওপর জেদ করে এসব করেছে।। বড় দের সাথে জেদ করলে তার ফল এমন ই হয়। বংশ টা একদম নির্বংশ করে ছাড়ল। রাক্ষুসি মেয়ে একটা ।
— আম্মা কিসব বলছেন? আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন? আল্লাহর দোহায় লাগে..এভাবে কথা না বলে আমাকে সবটা খুলে বলুন। কি হয়েছে? কিসের জেদ?
— তোমার বৌ এর হঠাত দু বালতি কাপড় ধোয়ার শখ হয়েছিল। কাজের বুয়া আসে নি তাও। বেশি পরিস্কার পরিচ্ছন্ন কি না ...আমরা তো সব নোংরা ।আমাদের কথা কি শুনবেন উনি? বললাম বুয়া আসে নি থাক ওসব রেখে দাও। অহন আসুক ও ই না হয় ধুয়ে দেবে নি। কে শোনে কার কথা । একা একা ধুলো ছাদে নিয়ে গেল নিজেই নেড়ে দিতে। এখ্ন বোঝ তার জেদের ফল তোমাকে আর আমাদের সামলাতে হবে আজীবন।
— অয়নী আম্মা এসব কি বলছেন? আম্মার ওপর জেদ করে এসবের কোন মানে হয়? কি হলো এখন এটা?কস্ট কে বেশি পাচ্ছে? আম্মা না তুমি?
.
আমার কোন ধৈর্য ই হচ্ছিল না ঐ মুহুর্তে সব কিছু বলে অহন কে বোঝানোর। কি ই বা বলতাম। তার মা তাকে যেভাবে সহ্জ ভাবে কথা গুলো বলল সেভাবে আমাকেও তো বলতে পারতেন । অথচ আমাকে সে কথাগুলোর সাথে কত খোটা শুনতে হয়েছিল।অহন কে এই মুহুর্তে ওসব বললে সে ভাবতেই পারে আমি নিজের দোষ ঢাকতে তার মাকে দোষ দিচ্ছি । আমি নিজে অহনের জায়গায় হলেও হয়ত তাই ই ভাবতাম।
.
কম সুখে পড়ে তো আর এই অবস্থায় অত গুলো কাপড় নিজে ধুই নি। অথচ বাবার বাড়িতে নিজের জামা কাপড় ও মা ধুয়ে দিত বেশির ভাগ সময়।কাকে কৈফিয়ত দিতে যাব এসব?
আমি অহন কে জড়িয়ে ধরে আর কান্না আটকাতে পারলাম না ।।শুধু বললাম,
— অহন আমি বুঝতে পারি নি। বিশ্বাস করো । আমি তো জানতাম না আমার ভেতরে এতো ডিফিকাল্টিস।। আমি তো জেনে বুঝে এসব করি নি।। তোমার কি মনে হয় আমি ইচ্ছা করে নিজের এত বড় ক্ষতি করব?তুমি পারলে আমাকে মাফ করে দিও। আমার আর কিচ্ছু বলার নেই তোমাকে।
— চুপ.. চুপ একদম চুপ। ডক্টর কান্নাকাটি করতে নিষেধ করেছেন না??? আমি তো জানি তুমি কিছু জানতে না। শুধু তুমি কেন? আমি , আমরা কেউ ই কি জানতাম? একদম কান্নাকাটি করবে না । ধৈর্য ধর। আল্লাহ আমাদের ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন।।
— আমার জন্য তোমার ও অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেল তাই না?
— ধুর পাগলি। কিসের ক্ষতি হবে? আল্লাহর দেয়া উপহার আল্লাহ্ ক্ষণিকের জন্য দিয়েছিলেন তার পর উনি আবার ফেরত নিয়ে নিচ্ছেন। এতে তোমার আমার ক্ষতির কি আছে । আল্লাহ যা করেন ভালর জন্যই করেন। হয়ত আমাদের কাছে থাকলে ওদের কোন ক্ষতি হত। আল্লাহর কাছেই ভালো থাকবে ওরা।
— আমি জানি তুমি এসব আমাকে স্বাভাবিক রাখার জন্য বলছ তো?? তুমি যতই এমন ভাব দেখাও যে তোমার কোনকিছুই যায় আসে না এসবে, তোমার কোন কস্ট ই হচ্ছে না। কিন্ত আমি তো জানি সত্যি টা ।তোমার ও অনেক কস্ট হচ্ছে। আমিও যেমন আর মা হতে পারব না তুমিও তো বাবা হতে পারবে না ।
— আরে পাগলি ,,বাচ্চা ই কি সব নাকি ?? আমরা দুজন না হয় মা বাবা হলাম না।তো?? মহাভারত কি অশুদ্ধ হয়ে যাবে????? আর আমার কোন ক্স্ট ই হচ্ছে না সত্যি বলছি।
.
.
— বৌমা, তুমি মা হতে পারবে না বলে যে অহন ও বাবা হতে পারবে না সে কথা তোমাকে কে বলল??????
তোমার খামখেয়ালিপনার জন্য আমার ছেলে কেন স্যক্রিফাইস করবে??? আর আমরাই বা কেন স্যাক্রিফাইস করব?? আশ্চর্য তো । এ বিষয়েও নিজের অক্ষমতার ভার আমার ছেলের ওপর চাপাতে চাও তাই না?
.
.
.
চলবে...............................