ভিনা ইনজামাম,বয়স সতেরো। এসএসসি দিয়েছে বেশিদিন হয়নি।তার বাবা সোহেল ইনজামাম একজন সফল বিজনেসম্যান।ভিনার মা শিউলি তিন বছর আগে মারা গেছেন আকস্মিক হার্ট এ্যটাকে।মায়ের সাথে অন্যরকম সম্পর্ক ছিলো ভিনার,মায়ের অকাল মৃত্যু তাকে প্রচন্ডভাবে আঘাত করে,চেনা পৃথিবী এক ধাক্কায় অচেনা হয়ে যায়।স্ত্রীকে হারিয়ে সোহেলও দিশেহারা হয়ে যান,কারণ ভালোবাসার বিয়ে ছিলো তাদের। একমাত্র মেয়েকে ঘিরেই তার পৃথিবী গড়ে উঠেছিলো।শিউলি মারা যাওয়ার পর মেয়ের দেখাশোনার জন্য নিজের মাকে নিয়ে আসেন সোহেল, প্রথম দেড় বছর ভালো থাকলেও বিয়ের জন্য ছেলেকে চাপাচাপি শুরু করে দেন।বিয়ের তীব্র অনিচ্ছা থাকলেও মায়ের ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলের কাছে হার মানতে হয় তাকে।
নয় মাস আগে স্ট্রোক করে তার মায়ের দাবী আরো জোড়ালো হয়ে উঠে।শিউলির সাথে পালিয়ে বিয়ে করেছিলো সে,তাই শিউলিকে তার মার কখনোই পছন্দ ছিলো না,শুধু একমাত্র ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে তাদের মেনে নেন।আর শিউলির পরিবারের কেউই তাদের মেনে নেয়নি,বিশেষ করে শিউলির ভাইরা,এমনকি তার মৃত্যুর খবরেও কেউ আসে নি ও বাড়ি থেকে।শ্বশুর বাড়িতেও খুব একটা ভালো থাকে নি।সোহেলের মা শিউলিকে কখনো ছেড়ে কথা বলতেন না।কিন্তু সে ছিলো সদা হাস্যোজ্জ্বল, কিছু হলেই বলত,'আরে মাই তো,বয়স হয়েছে না?'সোহেল ভেবে পায় না এত অল্প বয়সে কেনই বা সৃষ্টিকর্তা সবাইকে অসহায় করে নিয়ে শিউলিকে নিয়ে গেলো।নাকি শিউলির কষ্ট সৃষ্টিকর্তাই আর বাড়াতে চায় নি।এরকম অসংখ্য প্রশ্নের ভীড়ে সোহেল নিজেকে বড় অসহায় মনে করে।
ভিনাকে দেখাশোনার দোহাই দিয়ে সাত মাস আগে দ্বিতীয় বিয়ে দেয়া হয় সোহেলকে, তবে বিয়েতে শর্ত ছিলো,মেয়েকে বন্ধ্যা হতে হবে,অর্থাৎ সে আর বাচ্চা নিবে না।এ নিয়ে তুমুল দ্বন্দ্ব লাগলেও অবশেষে এরকম একজন কে পাওয়া যায়।মুনা হক নামের সে মহিলাটি তার দ্বিতীয় স্ত্রী।
এই দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে ঘোর আপত্তি ছিলো ভিনার।তার মার জায়গা অন্য কেউ নিবে,মানা অসম্ভব ছিলো তার পক্ষে।দাদীর অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি দেখেও সে চুপ ছিলো এই ভেবে যে তার বাবা কখনো এমন করবে না,অন্যদিকে মেয়ের মৌনতা কে সম্মতি হিসেবেই দেখেছিলেন সোহেল।হুট করে একদিন ভিনা স্কুল থেকে এসে দেখে তার বাবার বিয়ে।সেদিন যে ধাক্কা খেয়েছিলো,তার মনে হচ্ছিলো সে দমবন্ধ হয়ে মারা যাবে,তার কেউ আপন নেই।বিশ্বাস আর ভরসার জায়গা এক নিমিষেই শেষ হয়ে গিয়েছিলো।নিজের বাবার প্রতিই তীব্র ঘৃণা জন্মেছিলো।এই দিন যে কখনো দেখতে হবে,ভিনা কল্পনাও করেনি।
বিয়ের পরের দিন সকালে সোহেল ভিনাকে ঘুম থেকে ডাকতে গিয়ে দেখেন ভিনার গায়ে প্রচন্ড জ্বর।সাথে সাথে মেয়ের কপালে পট্টি দেয়ার জন্য পানি আনতে যান।
-বাবা,আমি ঠিক আছি,তুমি যাও।
-তোর গায়ে জ্বর ভিনা।
-আমি নিজেকে সামলে নিতে পারবো।
-কী সামলে নিতে পারবো?কী হয়েছে?
-কিছু না,এতিম হয়ে গিয়েছি।
সোহেলে সেদিন বুঝতে পারলেন,তিনি অনেক বড় ভুল করে ফেলেছেন,নিজের ভুলের প্রায়শ্চিত্তের জন্যই হয়ত সারাদিন তিনি মেয়ের সাথেই ছিলেন।এদিকে নতুন বিবাহিতা মুনা সারাদিন সোহেলের অপেক্ষা করে গেলেন।বন্ধ্যা দেখে তার জন্য ভালো কোনো বিয়ের প্রস্তাব আসেনি আগে,অথচ বাড়ির বড় মেয়ে তিনি।বয়স পয়ত্রিশের কোঠায়।এদিকে বাবা মা অতিষ্ট হয়ে শেষে এক মেয়ের বাবার সাথেই তার বিয়ে ঠিক করে, মা বাবা অসহায়ত্বের জন্য সে বিয়েতে রাজি হতে হয়,কেননা তার পরে আরো একটা বোন আর ছোট ভাই রয়েছে।মনে খুব আশা নিয়ে ছিলেন,স্বামীর কাছে অন্তত স্ত্রীর ভালোবাসা পাবেন।কিন্তু বিয়ের পরের দিনেই স্বামীর এমন বিমুখতায় প্রচন্ড ভেঙে পড়েন তিনি,মনের অজান্তেই তার ধারণা হলো ভিনা তার বাবাকে আটকে রেখেছে।ভিনার প্রতি ক্ষোভ জমে গেলো মুনার মনে।এরপরের দিনগুলো আরো দুর্বিষহ হয়ে উঠলো।যে মেয়ে হাসিমুখে সবার সাথে কথা বলত,সে একেবারে বদলে গেলো,স্কুল থেকে কম্পলিন আসতে লাগলো।ভিনা কাছের সব বন্ধু বান্ধব থেকে আলাদা হয়ে গেলো।মুনার সাথে প্রায় দিনই তর্ক লেগে যেত। সোহেল অতিষ্ট হয়ে মেয়েকে বকা ঝকা শুরু করেন,এ নিয়ে আরো ডিপ্রেশনে পড়ে সিগারেট খাওয়া শুরু করে ভিনা। রেজাল্ট দিন দিন খারাপ হতে থাকে।কোনোমতে এসএসসি দেয় সে।এসএসসির পর ইংলিশ কোর্সে ভর্তি হয়ে যায়।এই কোর্সে ভর্তি হওয়া বাহানা,নিজের বাসা থেকে দূরে থাকার।সে যত পারে বাসায় কম থাকে।মেয়ের এই উচ্ছৃঙ্খলতা আর স্ত্রীর অভিযোগের ভীড়ে সোহেলও আজকাল বাসায় আসেন না।ত্রিমুখী এই সমস্যা তাদের জীবনকে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়।এভাবেই চলছিলো তাদের জীবন,এই মাঝে আসে বড় পরিবর্তন......
.
.
.
চলবে................................................