— কত বার ছেলেটা কে বললাম ডিভোর্স দিয়ে দে। তাহলে আর এত ঝামেলা হয় না। । আরো বড় ফ্যামিলি তে সম্বন্ধ করা যেত ।কি বুঝল কে জানে ।। কোন কথা তো ঠিক মতো বলতে চায় না।। এই যুগে এক সাথে দুই বৌ কেউ রাখে ।। পাড়ায় মুখ দেখাব কিভাবে কে জানে।।। এই বাঝা টারে ছেড়ে দিলে কি ক্ষতি আমি কিছু বুঝি না ।। বৌ তো আসতেছে ই আর একটা ঐ বাঝা টার চেয়ে হাজার গুন সুন্দরী ।একদম আমার অহনের সাথে মানানসই।। তাও ভালো বিয়েটা তে রাজি করাতে পারছি ।
— আরে আপা, কিছু দিন সুন্দরী নতুন বৌ এর আদর সোহাগ পাইলে এমনি ঐ বাঝা কাইল্লানী রে ছেড়ে দেবে অত ভাইবো না তো।।।
.....
বিকেল দিকে অহন এর হবু শ্বশুর বাড়ির লোকজন এলো । গ্রামের বড় লোক দেখেই বোঝা যাচ্ছে । আমি দরজার পর্দা একটু করে ফাক করে করে দেখছি।।। সবাই উপস্থিত তবে যে আসল মানুষ সে অনুপস্থিত ।আজ তো বৃহষ্পতিবার অহন এর তো আজ হাফ ডে ।তবুও এত দেরি কেন করছে জানি না । ফোন ও দিতে ইচ্ছে হচ্ছে না ।আর যাই হোক কোন মেয়েই নিজের বর কে যেচে যেচে বাড়ি ডেকে এনে বিয়ের সম্বন্ধ করাতে বসাবে না । বরং ও আসছে না আমার ভালই লাগছে । একটা করে মুহুর্ত কাটছে আর আমি নিশ্চিত হচ্ছি যে বিয়েটা আর হচ্ছে না ।
আকাশ টা বেশ মেঘলা মেঘলা হয়ে আছে । মনে আছে এরকম ই এক মেঘলা দিনে অহনেরা আমাকে দেখতে গিয়েছিল।। বেশি কেউ না অহন,অহনের এক বন্ধু লাবিব ভাইয়া, আমার শ্বশুর শাশুড়ি আর অহনের খালাতো বোন ওহি।
আমি কিন্তু বিয়েতে প্রথ্মে রাজি ছিলাম না । রাজি না থাকার কারণ টা মনে হলে অবশ্য এখন হাসি পায় । আমি ছোট বেলা থেকেই মুভি সিরিয়াল টেলিফিল্ম এসবের ফ্যান। তো একবার একটা টেলিফিল্ম এ ভিলেন এর নাম ছিল অহন।কিন্ত সে হিরো আর হিরোয়িন কে এত ক্স্ট দিয়েছে আমি তো বরাবর এর মতো ইমোশনাল হয়ে গেছিলাম টেলিফিল্ম টা দেখে। তারপর আবার হিরোইন ছিল মেহ্জাবিন। ঐ অহন ব্যাটা আমার ফেভারিট নায়িকা টাকে এত কাদাইছে আমার তো খুব রাগ এসেগেছিল।
যাই হোক,ভুলেই গিয়েছিলাম টেলিফিল্ম টার কথা ।কিন্তু এই পুরক সাহেবের মানে অহনের সম্বন্ধ টা আসার পর আমি সোজাসুজি বাবা কে বলে দিলাম
— বাবা,আমি এই বিয়ে করতে পারবো না।
( বাবা মার সাথে আমি যথেষ্ট ফ্রি। তারা আমার বন্ধুর মতো । বাবা মা বলতে আমি এতদিন বন্ধু ই বুঝে এসেছি।কিন্তু অহন দের বাড়ি এসে দেখি পুরো উল্টো পরিস্থিতি ।এখানে বাবা মা মানে যেন কোন জেলখানার জেল সুপার অথবা কোন স্কুল এর হেড টিচার)
যাই হোক, বাবা আমার এমন কথা শুনে বেশ ভড়কে গেলেন।
— কেন অয়নী মামুনি?? এই ছেলের আবার কি প্রবলেম??? এর আগের গুলোর তো যে সব ভুল ধরতে এই ছেলের মধ্যে তো তেমন কিছু নেই। ছেলে আইটি ইঞ্জিনিয়ার , এক বাবার এক ছেলে। আর তুমি কি কি সব যেন ভুল ধর মাথায় চুল কম ,ভুড়ী , দাড়ি , হাইট কম , হ্যাংলা আরো কি কি জানি সে সব কিছুই এই ছেলের মধ্যে নেই। আমি নিজে দেখে এসেছি ওর অফিস গিয়ে । আর কি অমায়িক বিহেভ দেখেই বোঝা যায় খুব ই ধৈর্যশীল ।তোমার মতো অধৈর্য মেয়েকে খুব ভালো ভাবেই হ্যন্ডেল করতে পারবে ।আমি তো ওকে আমার পরিচয় দিই নি। অন্য অফিসিয়াল একটা কজ দেখিয়ে গিয়েছিলাম জাস্ট ১৫ মিনিটেই সলভ করে দিল।।
— সব ই বুঝলাম ।কিন্ত
— কিন্ত আবার কি?? এর চেয়ে আরো কি চাও তুমি? এই অয়নী তোমার কোন পছন্দ টছন্দ নেই তো??? বার বার যে সম্বন্ধ ই আসে তুমি একটা না একটা কারণ দেখে ফিরিয়ে দিচ্ছ??
— বাবা তুমি খুব ভালো করেই জানো যে আমার সেরকম কেউ নেই।আমাকে এপর্যন্ত যারাই প্রপজ করেছে একটা কেও আমার ভালো লাগে না ।সব ই হ্যাংলা টাইপ। আর আমার যাদের পছন্দ তারা সবাই তো মুভি আর সিরিয়াল এর হিরো ।
— তাহলে কি সমস্যা, মা??
— বাবা, ছেলের পিক আমি দেখেছি।সব ই ঠিক আছে চুল গুলো সত্যিই ক্রাস খাওয়ার মতো, আর টার্কিশ সিরিয়ালের হিরো দের মতো ফর্সা ও ঠিক আছে,ভুড়ী ও নেই কিন্তু,,,,এই ছেলের নামেই তো সমস্যা ।
— কিহ???
— হুম, অহন নাম টা একদম ভালো না । কিছুদিন আগে একটা টেলিফিল্ম এ এক বজ্জাত ভিলেন ব্যাটার নাম ছিল অহন। এই অহন ও যদি সেরকম হয়?? মেহ্জাবিন কে কত কাদাইছে.... আহারে...
আমার এই কথা শুনে বাবা আর মা দুজন দুজনের দিকে তাকাল তারপর তারা হাসবে না কাদবে মে বি ভেবে পাচ্ছিল না । শুধু মা একটা ধমক দিল
— এই অয়নী এই তুই কবে বড় হবি?? মুভি আর নাটক ছাড়া মাথায় কিছু নেই না ?? যা পড়তে বস।
কি আর করার আমি রুমে গিয়ে আবার ইউটিউবে নিশো আর মেহ্জাবিন এর নাটক দেখা শুরু করলাম ।নাটকের নাম ''বুকের বা পাশে'' ।দারুন একটা নাটক।
....
দেখতে দেখতে ওদের আমাকে দেখতে আসার দিন চলে এলো । বাবা মা তো আমার বিয়ে না করার কারণ টা তুচ্ছ হিসেবে হাসতে হাসতে উড়িয়ে দিল । আমিও নিজেকে বুঝানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলাম যে সব অহন এক না । কিন্ত তবুও মন সায় দিচ্ছিল না ।
...
পাত্রপক্ষ এসে বসে আছে ড্রইং রুমে। আমি হালকা মেকআপ নিলাম। এরপর মা আমাকে টেনে কিচেনে নিয়ে গেলো । গিয়ে আমার হাতে চা এর ট্রে দিল। পুরো ছ কাপ চা। উফ্ফ আমি কি এত চা একসাথে নিয়েছি নাকি কখনো। বিকেল বেলার চা এর কাপ তো মা ই এসে আমাকে দিয়ে যায়।আর আজ কি না এত গুলো চা আমাকে সার্ভ করতে হবে?? আমি মার উপর রাগ দেখাচ্ছি। মা আমার কথায় কোন কর্ণপাত ই করলেন না । সে আমাকে আরও শিখিয়ে দিচ্ছে কিভাবে সালাম দেব কিভাবে কথার উত্তর দেব এই চা টা আমি ই বানিয়েছি এই সব বলব । ইত্যাদি ইত্যাদি ।
..
আমি মায়ের হাত থেকে ট্রে টা নিয়ে কাপা কাপা হাতে এগোচ্ছি।এই কখন বুঝি চা টা পড়ে যায়। রুমে ঢুকেই লম্বা একটা সলাম দিলাম।
— আ... আ.. আস সালামুআলাইকুম।
এটা বলতেই দুটো ছেলের পাশে বসে থাকা একটা মেয়ে ফিক ফিক করে হেসে দিল। আর পাশের ছেলেটা কে চিমটি কাটল । আমি তার দিকে হলকা চোখ তুলে তাকাতেই বুঝলাম এইটাই অহন ব্যাটা। এর ই পিক দেখেছিলাম । ছেলেটা চিমটি খেয়েও মাথা কেমন নিচ দিক করে আছে আর ঠোট টিপে যে হাসি আটকানোর চেষ্টা করছে তা আমি ভাল ভাবেই বুঝতে পারছি। অহনের পাশে বসে থাকা লাবিব ভাই ও হাসছে।
এবার আমার প্রচণ্ড রাগ হলো। সলাম দিতে একটু না হয় তোতলামো করেইছি তাই বলে এভাবে হাসতে হবে?? আমি কি এত গুলো অপরিচিত মানুষের সামনে কখনো এভাবে দাড়িয়েছি নাকি। আগের সম্বন্ধ গুলো তো দেখতে আসার আগেই ক্যানসেল করে দিয়েছি।
...
কিন্তু রাগ উঠলেও এই মুহুর্তে আমি তাদের কারো উপর রাগ দেখাতে পারছি না। মুখে কৃত্তিম ভাবে মিষ্টি হাসি নিয়ে আমি তাদের চা সার্ভ করছি। নিজেকে এবার আমার রেস্টুরেন্টের ওয়েটার এর মতো লাগছে। সবাই কে ঠিকমতো দেয়ার পর যখন ই অহনের সামনে গেছি ওকে সার্ভ করার জন্য ঠিক সেই সময় ই বিপত্তি ঘটাল আমার সোনা ভাই অয়ন।। বিচ্ছু বললেও ভুল হবে।ক্লাস ফাইভে পরে । সে যে আসলে কি তা আমি আর বাবা মা ছাড়া কেউ জানে না । কোত্থেকে যেন দৌড়ে এসে
— আপুনি ,আপুনি আজ আমি হাফ সেঞ্চুরি করেছি আর তিন টা বাউন্ডারি মেরেছি
বলেই আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরতে নিল ব্যস যা হওয়ার তাই হলো। কাপের বেশির ভাগ চা অহনের বুকের উপর পড়ল। আহারে বেচারা খুব লাইট কালার একটা শার্ট পরে হিরো সেজে এসেছিল। ব্যস চায়ের দাগে সব শেষ।। কিন্ত এতো গরম চা পড়ায় সে উহ আহ কিছুই করলো না। বরঙ আমি সরি বলার আগের পকেট থেকে রুমাল বের করে মুছতে মুছতে it's ok ..its ok বলা শুরু করলো।আমি তখন ই বুঝেছি বাবা ঠিক ই বলেছে এ ছেলে খুব ই ধৈর্যশীল । আর পাশে হাসির রানি আমার ননদিনী ওহি হি হি করে হাসতে লাগল । আমি লজ্জায় কি করব কিচ্ছু বুঝতে পারছি না ।ইচ্ছে করছে অয়ন কে এখ্ন ই ওর ব্যাট দিয়ে ইচ্ছে মতো ধলাই দিতে।
ওহি উঠে এসে আমার কানে ফিস ফিস করে বলল
— কি ভাবি প্রথম দিনেই আমার ভাই তোমাকে ঘায়েল করলো তো ?? ক্রাস খেয়ে নিয়েছ তাই না ?
আমি আর কোন কথাই বললাম না।
.
লাইট কালার শার্টে চায়ের কড়া রঙ ভরেছে।রুমাল দিয়ে যতই ঘোশুক তাই কি আর ওঠে??? এদিকে আমার শশুর আর শাশুড়ি এসব সার্কাস চুপচাপ দেখেই যাচ্ছে।আমি খুব ভালো বুঝতে পেরেছি আমাকে তাদের পছন্দ হয় নাই। আমার এসব খামখেয়ালিপনা তারা একদম ই পছন্দ করছে না ।।
.
মৌণতা কাটিয়ে বাবা বললেন ,
— দেখুন আমি খুব ই লজ্জিত। আমার ছেলেটা আসলে একটু দুষ্ট তো। ছোট মানুষ বুঝতেও পারে নি। বোন কে খুব ভালোবাসে। বোন ই ওর প্রাণ । বাইরে খেলতে গিয়েছিল,,ফিরে এসে বোন কে আদর করে ধরতেই,,,ও আসলে বুঝতে পারে নি।। অয়নী ও বুঝতে পারে নি।
অহন এর বাবা মা কিছু বলার আগেই লাবিব ভাই ই বলল,
— না না আঙ্কেল it's ok...হঠাত হতেই পারে। এই অহন তুই না হয় washroom এ গিয়ে দ্যাখ দাগ টা ওঠে নাকি।
— হুম ঠিক ই বলেছ। এই অয়নী তুই ওকে washroom টা দেখিয়ে দে তো । ( বাবা আমাকে বলল)
কি আর করার হবু স্বামী কে নিয়ে যাচ্ছি washroom দেখতে।ভাবা যায় এগ্লা??? হুহ। মুভি আর নাটকে দেখি বিয়ের কথা বলতে আসলে হিরো হিরোইন ছাদে গিয়ে অথবা আলাদা রুমে বা কোন রেস্টুরেন্টে গিয়ে নিজেদের কিছু কথা বলে একে অপরকে কিছুটা জানার চেষ্টা করে। আর আমার কপাল দেখো উনাকে নিয়ে যাচ্ছি washroom এ।। সব দোষ এই অয়ন এর। সবাই চলে গেলে আজ ওকে 100 বার কান ধরে উঠবস করাতেই হবে।। এই দিকে অহন বেচারা রোবট এর মত আমার সাথে যাচ্ছে।মুখে কোন কথা নেই। রুমাল দিয়ে শার্ট টা আবার ঘুষছে। ওর এই ঘশাঘুশি দেখে ইচ্ছে করছে ভীমবার এনে দিই ওকে। ভীম বার এক ঘষা তেই তেল চর্বি পরিস্কার ।
.
যাই হোক পিক দেখে একটু আকটু ক্রাশ খেয়েছিলাম।কিন্তু সামনা সামনি আজ দেখে আমি পুরাই ক্রাশড ।।। উফ্ফ পুরা হিরো হিরো ভাব ।জোশ একদম । ধুর নাম দিয়ে কি আসে যায়।।।
কথা গুলো যে আমি ঘুমের মধ্যে বিড় বিড় করছি কেউ এসে ডাক না দিলে বুঝতেই পারতাম না।
— অয়নী,এই অয়নী ঘুমের মধ্যে এমন বিড় বিড় করছ আর হাসছ কেন??
চোখ খুলেই দেখি অহন চলে এসেছে। আর আমি এতক্ষণ তন্দ্রা তন্দ্রা ঘুমের ঘোরে আমি আমাদের পুরাতন স্মৃতি গুলো স্বপ্নে খেয়াল দেখছিলাম।।
কিন্তু অহন এত তাড়াতাড়ি এলো কেন?? আমি তো ভেবেছিলাম ও অনেক দেরি করে আসবে আর ওর বিয়েটা ভেঙে যাবে। কিন্তু এটা কি হলো??
অহন কে জিজ্ঞেসকরলাম,
— এই যে হাজব্যান্ড,,,দ্বিতীয় বিয়ের ডেট বুঝি ফিক্স হয়ে গেছে???? কবে করছ সেকেণ্ড ম্যারেজ??? এই পুরক সাহেব তোমার দ্বিতীয় বিয়ের আগে আমার একটা শেষ ইচ্ছে রাখবে???
.
.
.
চলবে...........................