— এই যে হাজব্যান্ড,,,দ্বিতীয় বিয়ের ডেট বুঝি ফিক্স হয়ে গেছে???? কবে করছ সেকেণ্ড ম্যারেজ??? এই পুরক সাহেব তোমার দ্বিতীয় বিয়ের আগে আমার একটা শেষ ইচ্ছে রাখবে???
......
অহন আমার দিকে নির্লিপ্ত ভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। তার যা স্বভাব ..কোন প্রশ্ন পছন্দ না হলে..তার উত্তর দেবেই না।। এমন ভাব করবে যেন শুনতেই পায় নি কথাটা।।। ব্যাগ থেকে কি একটা প্যাকেট বের করে নিয়ে বাইরে গেলো ।
কৌতূহল বশত আমিও গেলাম পিছে দেখি তো হবু শশুর শাশুড়ি কে কি গিফট দেয়।।
.
রুম থেকে বের হয়ে দেখি এমা পুরো বাড়ি ফাকা ।কি ব্যাপার গেলো কই সব ?? ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত ১১.৫০ ..ওরে বাপ্রে এত রাত কখন হলো ?? আমি তো সন্ধ্যায় একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । এতক্ষণ ঘুমিয়েছি।।!!!!
অহন এর দিকেও তাকিয়ে দেখি সে পুরো কাক ভেজা হয়ে আছে। রুম অন্ধকার করে ঘুমাচ্ছিলাম বলে তখন অহন কে ভালো ভাবে দেখতে পাই নি। এদিকে অহন চিল্লানো শুরু করেছে
— আম্মা,আম্মা
— এই তোর এতক্ষণে বাড়ি ফেরার সময় হলো??? কতবার ফোন দিয়েছি ফোন অফ কেন ছিল তোর??
— আম্মা,এই যে আব্বা আর আপনার এ মাসের মেডিসিন । প্রেসক্রিপশনের সাথে আব্বা কে সকালে মিলায়ে নিতে বলবেন।
— অহন আমি তোমাকে কিছু বলছি?? কই ছিলা এতক্ষণ বৃষ্টির মধ্যে??
অহন মায়ের কথার ও কোন উত্তর না দিয়ে সোজা শাওয়ার নিতে চলে গেল।
যাক বাবা আমি হাফ ছেড়ে বাচলাম।অহন তাহলে কেবল বাড়ি ফিরল।আর মা যা রেগে আছে বোঝাই যাচ্ছে বিয়েটা ক্যানসেল। কিন্ত বেচারা বৃষ্টির মধ্যে কই বসে ছিল এতক্ষণ।জিজ্ঞেস করলে তো মনে হয় না বলবে। এসে থেকে তো মা বা আমার কারোর ই কোন কথার উত্তর দিচ্ছে না ।ইশ পুরা কাক ভেজা ভিজেছে। ।
অনেক্ষন পর শাওয়ার নিয়ে বের হলো। ব্ল্যাক ট্রাউজার পরে চুলের পানি গুলো মুছতে মুছতে বের হলো । বুকে আমার ফেলানো গরম চায়ের ছ্যাঁকার দাগ এখন ও একটু একটু আছেই এক বছর হয়ে গেছে তবুও।। অহন আমার হিরোর কোন অংশে কম না হুম জিম করা বডিও আছে হিরো দের মতো । পুরা টার্কিশ হিরো। আমি অহন কে দেখে আবার নতুন করে যেন ক্রাশ খাচ্ছি বিয়ের এক বছর পর।। হা হা। আসলে অনেক দিন পর মন টা খুব ভালো হয়ে গেছে অহনের বিয়ে ভাঙার কথা শুনে। আহ এই না হলে আমার জামাই।।কত্ত ভালো তুমি... সত্যিই সব অহন এক না ।।
..
আমি দৌড়ে গিয়ে অহন কে জড়িয়ে ধরলাম
— পুরক সাহেব তুমি কত্ত ভালো ।।
— তাই??
— হু
অহন আমাকে ছাড়িয়ে আবার অফিসের ব্যাগ এ হাত দিল। তারপর আমার প্রতিদিন এর গিফট কিটক্যাট দিল । তারপর আর একটা পিজ্জার প্যাকেট ও দিল।।।
— wow... চিজি pizza!!!!! Love you এত্ত্গুলা ।উম্মাহ
— দাড়াও আর একটা স্পেশাল গিফট আছে । তারপর উম্মা দিও।
অহন এবার আমার হাতে এক গুচ্ছ কদম ফুল দিল ।
— হায় আল্লাহ,, ওয়াও থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ .....কি দরকার ছিল বৃষ্টির মধ্যে এসবের??
— দরকার ছিলো তো
— কি দরকার??
— আমার পরি বৌ টার হাসি মুখ যে দরকার ছিল আমার ।
— পুরক সাহেব...
......
অহন রান্নাঘর থেকে নিজেই মাংসের পাতিল টা নিয়ে প্লেটে করে ভাত নিয়ে টিভির সামনে সোফায় গিয়ে খেতে বসল। এদিকে মা তো তার টেপ রেকর্ডার চালু করে দিলো। আর আমি রুমের দরজায় দাড়িয়ে পিজ্জা খাচ্ছি আর লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছি আজ অহন ব্যাটার খবর আছে। মা ওর উপর যে রেগে আছে। আমি ইচ্ছে করেই বাহিরে যাচ্ছি না আমাকে দেখলে আরও ক্ষেপে যাবেন উনি।ভাববে আমিই অহন কে এসব কান্ড করতে বলেছি।
মা তার বক বক শুরু করেছেন ,অহন কই ছিলা তুমি??? কেন আসলে না সময় মতো ।?? আমাদের অপমান করতে তোমার খুব ভালো লাগে তাই না??? তুমি জাস্ট মেয়েটাকে একবার দেখলেও না ।। আজ আমি আর তোমার বাবা তোমার জন্য কত অপমান হয়েছি জানো??? কত বড় বাড়ি থেকে সম্বন্ধ এসেছিল জানো??? অহন তুমি কিন্ত দিন দিন অতিরিক্ত বেয়াদব হয়ে যাচ্ছ। অয়নী কে জোর করে বিয়ে করলে । একদিন দেখেই কি এমন পেলে ওর মধ্যে কে জানে ।। অসুস্থ একটা মেয়ে। প্রথম দিন দেখেই ওর মতিগতি আমার ঠিক লাগে নি। । তারপরেও জেদ করে ওকেই বিয়ে করলে। বিয়ের আগে যদি জানতাম ও অসুস্থ কোন দিন ও এই বিয়েটা হতে দিতাম না ।। অহন আমি কিছু বলছি তোমার কানে কি কোন কথাই যাচ্ছে না?? আমাদের বংশ টা কি তুমি নিরবংশ করতে চাও?? তোমার কি নিজের ও বাবা হতে ইচ্ছে করে না ?? ঐ বাঝা মেয়েটার জন্য তুমি কেন এত বড় ত্যাগ স্বীকার করবে??? আমাদের কি নাতি নাতনির মুখ দেখতে ইচ্ছে করে না??
মা আরো বলেই যাচ্ছে...
অহন এমন ভাব দেখাচ্ছে যে সে কোন কিছু শুনতেই পাচ্ছে না ।তার যত মনযোগ সব ঐ টিভির মধ্যে ঢুকে গেছে ।তাও ভালো কিছু দেখলে হয় ।সে দিয়ে রেখেছে বিটিভির মতো বোরিং চ্যানেল। যেখানে দেখানো হচ্ছে বরগুনা তে বাতাবি লেবু আর বেগুন এর ব্যাপক চাষ হয়েছে । অথচ অহন এই রিপোর্ট টা এমন ভাবে দেখছে যেন ব্রাজিল আর্জেন্টিনার 90 মিনিটের রুদ্ধশ্বাস গেইম চলছে।
যে অহন স্পোর্টস চ্যানেল ছাড়া কিছু বোঝে না সে কি না আজ বিটিভিতে বাতাবি লেবুর চাষ দেখছে তাও এত মনযোগ দিয়ে ,,,হায় আল্লাহ,,,,অহন তুমি পারো ও বটে।।।
সে আরামে টিভি দেখ্ছে আর মেহমান দের জন্য রান্না করা গরুর মাংসের ভুনা পাতিল থেকে একটার পর একটা তুলছে আর খাচ্ছে। আর মা ওকে বকেই যাচ্ছে । আজকের রান্না টা মা ই করেছে। উনার রান্নার হাত সত্যি খুব ভালো । আমি আগে আমার মা ছাড়া কারো রান্না খেতে পারতাম না। তবে মায়ের পর এখ্ন যদি কারো রান্না ঠিকঠাক খেতে পারি তা হলো আমার শাশুড়ি মায়ের।বিয়ের এক বছর হয়ে গেল তবুও মা আমাকে রান্না করতে দেন না আমি শুধু সাথে থেকে টুকিটাকি কাটা কুটোয় হেল্প করি এটা ওটা এগিয়ে দিই। উনার এক কথা,,উনি যত দিন সুস্থ আছেন ততদিন পর্যন্ত নিজের স্বামী সন্তান কে নিজের হাতেই রান্না করে খাওয়াবেন । উনি সুস্থ থাকা পর্যন্ত সংসারের হাল নিজেই ধরে রাখবেন।
আমার শাশুড়ি আসলে মানুষ হিসেবে খারাপ না । কিন্তু খুব জেদি আর কড়া স্বভাবের ।একবার যা বলবে সেটাই ঠিক। যা চাবেন তাই আদায় করেই ছাড়বেন। আমাকে তার প্রথম থেকেই পছন্দ ছিল না মানে দেখতে যাওয়ার দিন থেকেই। কিন্তু অহনের পছন্দ ছিল বলে বিয়েটা দিতে বাধ্য হয়েছেন । অহন চুপচাপ স্বভাবের হলেও মায়ের মতই জেদি । কিন্ত এখন আমি এখ্ন অক্ষম। । আমি আর তাদের বংশের বাতি জ্বালতে পারব না । তাদের নাতি নাতনির মুখ দেখাতে পারব না। তাদের ছেলের ভবিষ্যত অন্ধকার ।বুড়ো বয়সে তাদের ছেলেকে কে দেখবে। আমাকে নতুন করে অপছন্দের জন্য এই কারনগুলোই যথেষ্ট।।
..
মা এখ্ন পর্যন্ত অহনের সাথে বকবক করেই যাচ্ছে।আর কথা গুলো অহনের বুকে না বিধ্লেও আমার বুকে ঠিক ই বিধছে।অহন ধীরে সুস্থে খাওয়া শেষ করে উঠে আসার সময় শুধু ধীর গলায় মাকে বলল,আম্মা আপনিও কিন্তু একটা মেয়ে....
...
অহনের খাওয়া শেষে আমি প্লেট গুলো ধুয়ে রান্না ঘরের টুকিটাকি কাজ সেরে ঘরে ফিরে দেখি অহন উপুড় হয়ে শুয়ে আছে আর মিউজিক প্লেয়ার এ হালকা সাউন্ডে গান শুনছে। কুমার বিশ্বজিত এর সেই বিখ্যাত গানটা,
"" যেখানে সীমান্ত তোমার ,সেখানে বসন্ত আমার""
আমি বুঝতে পারি অহন ও একটা মানুষ ।যতই এরকম ভাব দেখাক না কেন যে তার এসবে কিচ্ছু যায় আসে না, সে কিচ্ছু কেয়ার করছে না, কিচ্ছু শুনছে না কিন্ত আমি জানি দিন শেষে তার ও খারাপ লাগে । কিন্ত আমার হাতে কি কিছু করার আছে? কিচ্ছু করার নেই আমার ।
অহন জীবনে নিজের চাহিদা মত তেমন কিছুই পায় নি। শুধু মাত্র বাবা মায়ের জেদ এর বলি হওয়ার কারণে। বাবা মা অবশ্যই সন্তানের ভালো চান কিন্তু তাদের সন্তানের চাহিদার দিকটাও একটু খেয়াল করা এবং গুরুত্ব দেয়া উচিত।
তবে সব বাবা মা এক না।কিছু কিছু বাবা মা আছে যারা তাদের সমস্ত চাওয়া পাওয়া বাচ্চার মধ্যে ফুটিয়ে তুলতে চায় কিন্ত এসব চাইতে গিয়ে সন্তানের চাওয়া টা আসলে কি সে বিষয়ে তারা গুরুত্ব ই দেন না । এরকম সাধারণত যাদের একটা ই বাচ্চা তাদের ক্ষেত্রে বেশি হয়ে থাকে । তারা তাদের সকল চাওয়া পাওয়া,সকল স্বপ্ন ঐ একটা বাচ্চার মাঝেই পুর্ণ করতে চায় কিন্ত তাদের এসব পুর্ণ করতে করতে বাচ্চা টার উপর দিয়ে কি যায় তারা তা বোঝার ও চেষ্টা করে না । শুধু অতিরিক্ত কড়া শাসনের মধ্যে রাখতে চায় ।
কিন্ত যাদের একের বেশি সন্তান তারা এক এক সন্তানের মধ্যে তাদের এক এক চাওয়া পুর্ণ হলেই তারা খুশি। এক্ষেত্রে একজনের উপরেই সব চাপ গিয়ে পরে না ।
অহনের ছোট বেলা থেকেই মিউজিক এর উপরে খুব ঝোক ছিল নাকি ।আমি নিজেও শুনেছি খুব ভালো গান করে ও। যে কোন গানের সুন্দর কভার দিতে পারে। লুকিয়ে লুকিয়ে গান ও শিখত । স্কুলে ফ্রেন্ড দের নিয়ে মিউজিক টিম ও ফর্ম করেছিল। নিজ টাকায় লুকিয়ে গিটার ও কিনেছিল।। কিন্তু ঐ যে বাবা মায়ের শখ ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে.....একমাত্র ছেলে গান বাজনা নিয়ে পড়ে থাকবে?? লোকে কি বলবে?? ছেলেকে ইঞ্জিনিয়র ই হতে হবে।
কলেজের টেস্ট এক্সামে অহন কেমিস্ট্রি আর বায়ো তে নাকি খুব খারাপ রেজাল্ট করেছিল। কলেজে গার্জিয়ান কল করে পিন্সিপাল বলেছিল ,ছেলে তো উচ্ছ্ন্নে গেছে। সারাদিন গান বাজনা নিয়েই তো পরে থাকে। ও ভাল রেজাল্ট করবে কিভাবে?? আপনারা শাসন করতে পারেন না ছেলেকে??
বাড়ি ফিরে অহন কে সেদিন প্রচুর মার খেতে হয়েছিল। বাবা ওর গিটার টাও সেদিন ভেঙে ফেলেছিল।জ্বর ছিল টানা ৬ দিন। তারপর অহনের গান একদম অফ করে দেয়া হয়েছিল। বন্ধু বান্ধব,আড্ডা, বাইরের প্রাইভেট সব অফ।। সব সাবজেক্ট এর টিউটর বাড়িতে রাখা হয়েছিল। বাইরে খুব প্রয়োজন ছাড়া বের হতে দেয়া হয় নাই ভার্সিটি তে ভর্তির আগ পর্যন্ত। কিন্ত তত দিনে যা হবার হয়ে গেছে। বাবা মায়ের অতিরিক্ত কড়া শাসনের ফলে সে ধীরে ধীরে ফিলিংলেস,একগুঁয়ে,জেদি আর চাপা স্বভাবের হয়ে গেছে।
,
আমি অহনের পাশে গিয়ে মিউজিক প্লেয়ার অফ করে দিয়ে নিজেই একটা গান ধরলাম আর ওর মাথায় হাত বুলালাম
"" তুমি সুখ যদি নাহি পাও,
যাও সুখের ও সন্ধানে যাও....
আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয় ও মাঝে....""
— কি অয়নী?? তুমিও শুরু করলে??
— ঠিক ই তো বলছি। তোমার সুখের সন্ধানে যাওয়া উচিত ।
— চুপ করো তো । আম্মার কথায় মন খারাপ করোনা ।
— মন কেন খারাপ করব?? উনি উনার অবস্থানে ঠিক ই আছেন। সত্যি ই তো বাচ্চা কাচ্চা না থাকলে ভবিষ্যত কি?? জীবনের পূর্ণতা ই তো সন্তান।
— হুম
— আমি বলি কি অহন তুমি বিয়ে টা করেই নাও। রাজি ই তো হয়েছিলে। আবার আজ কেন অমন করলে??
— জানিনা
— অহন রাজি হয়ে যাও। কি এমন হবে আর একটা বিয়ে করলে?? কারো তো কোন ক্ষতি হচ্ছে না । এতে তোমার ই ও ভালো । আমার ও ভাল তোমাদের বাবু কে আমিও একটু আদর করতে পারব।( বুকে যে কত বড় পাথর চেপে কথা গুলো বললাম নিজেও জানি না)
— ভেবে বলছ??
— হুম
— পরে আফসোস করবে না তো??
— না
.
.
.
চলবে...........................