অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ০৩ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


সকালে ফ্লোর থেকেই ঘুম ভেঙে উঠলো ভিনা। কেউ এসে ডেকে দিয়ে বিছানায় যেতে বলেনি।ছোট বেলায় সোফায় ঘুমিয়ে পড়লে মা কোলে নিয়ে বিছানায় দিয়ে আসতো।কোলে নেয়ার সময় ঘুম ভাঙতো, কিন্তু তাও চোখ বন্ধ করে পুরো ভালোবাসাটা উপভোগ করতো।বাবাও আগে বুকে নিয়ে ঘুমাতো। দিনগুলো হারিয়ে গেলো কেন?হারিয়ে যখন গিয়েছেই,ভিনাকে নিয়ে কেন হারালো না।

ফ্রেশ হয়ে নিচে এসেই দেখলো তার বাবা চলে গেছে আগেই,মুনা বসে নাস্তা করছে।ব্যাগ গোছানোর সময় দেখেছিলো মানিব্যাগে পঞ্চাশ টাকা আর কিছু কয়েন রয়েছে।বারো দিন আগে পাঁচশ টাকা দিয়েছিলো বাবা,এই টাকা শেষের পথে। সে জানে আলমারির কোথায় টাকা থাকে। আগে বলতে হত না,আলমারির ড্রয়ার খুলে টাকা নিয়ে মা কে বলে চলে যেত। সে ছোট থেকেই কম খরচ করে,তাই আলমারি থেকে টাকা নিলেও মা বাবা কিছু বলত না।এখন মাসে দুই একবার কিছু সহ্য না করতে পেরে সিগারেট খায়।মুনা সোহেল এর কাছে এই স্মোকিং কে ড্রাগ নেয়া বানিয়ে দিয়েছে। তাই হাতে টাকা আসে খুবই কম।আর এখন মুনার কাছে টাকা চাওয়ার কোনো মানেই নেই।কী থেকে কী বানায় ঠিক নেই।একটা গাড়ি সোহেল নিয়ে গেছে,আরেকটা গাড়ি নষ্ট।তাই বাসেই যাবে সে।মুনার সামনেই না খেয়ে বের হলো ভিনা,মুনা দেখেও কিছু বললো না।অতচ সোহেল রাতে বলেছিলো মেয়েটাকে ডেকে বিছানায় নিতে আর সকালে নাস্তা দিতে। মুনা দুইটার একটাও করে নি।সে গতকাল খুব আশা নিয়ে ছিলো সোহেলের সাথে একান্তে সময় কাটাবে। কিন্তু রাতে ঝগড়ার জন্য সোহেল আর বিছানায় আসেই নি।বরং মধ্য রাতে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেছে।মেয়েটার জন্য স্বামীর সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছে অনেকবার। 

অনেক খানি রাস্তা হেঁটে এরপর বাসে উঠলো ভিনা।বাসে কোথাও সিট না পেয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো।খানিক বাদে পাশ থেকে কে যেন কথা বললো-
-তুমি এই সিটটায় বসতে পারো।

প্রথম দেখায় তুমি বলায় ভিনা বিরক্ত হয়ে তাকালো।লম্বা,ফর্সা আর মুখে মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি ছেলেটার। চোখে কালো ফুল ফ্রেমের চশমা,মাথাভর্তি চুল,কিন্তু এলোমেলো।এক কালারের শার্ট আর পুরোনো জিন্স পড়া।হটাৎ তাকালে সাথে সাথেই চোখ ফেরানো যাবে না টাইপ সুন্দর।

-নো থ্যাংকস, আপনি আগে এসেছেন,আপনিই বসুন।

-কোনো এক বিচিত্র কারণে ছেলেটা আর বসলো না,বরং ভিনার পিছনে দাঁড়ানো এক মধ্যবয়স্ক লোককে সড়িয়ে দিয়ে সে দাঁড়ালো।ভিনা সাথে সাথে রিয়েক্ট করতে পারত,কিন্তু করলো না,কারণ সে ভালোমতই অনুভব করেছে কেউ তার কোমরে হাত রেখেছে,একবার। যেহেতু একবারই হয়েছে তাই কিছু বলে নাই,ভুলেও লাগতে পারে ভেবে।কিন্তু ছেলেটা যেখানে বসা ছিলো, সেখান থেকে দেখে বোঝা সম্ভব কেউ ইন্টেনশনালি হাত দিয়েছে নাকি না।ভিনা বুঝতে পারলো ছেলেটা কেন পিছনের লোকটাকে সড়িয়ে দিয়েছে।মনে মনে কৃতজ্ঞ ও হলো,কিন্তু এই সিচুয়েশনে কিছু বলা সম্ভব না।স্টপ এসে পড়ায় সে নেমে গেলো জলদি,যাওয়ার শুধু একবার ছেলেটার দিকে তাকিয়ে হালকা হাসি দিয়ে গেলো।আশা করা যায় এই হাসির অর্থ ছেলেটা ধরতে পারবে।

বাস থেকে নেমে কোচিং এ না ভিনা গিয়ে টং এ চা খেতে নামলো। খালি পেটে চা খেলে সমস্যা হতে পারে জেনেও চা খাচ্ছে।এছাড়া উপায় নেই,সারারাত ফ্লোরে ঘুমিয়ে ঠান্ডা লেগে গেছে,মাথা ব্যাথা করছে।আগে চা খেতে চাইলে মা ঘন দুধের মাঝে হালকা লিকার দিয়ে চা বানাতো,যেন অন্তত দুধ বেশি খাওয়া হয়, আর ঘুমে সমস্যা না হয়।হায়রে মা,কখনো কী ভেবেছিলে তোমার মেয়ে টাকার অভাবে টং এ চা খাবে?কখনো ভেবেছিলে তোমার মেয়ে বাবা থাকা সত্ত্বেও এতিমের মত থাকতে হবে?কাকে ভালোবাসলে মা? কেনই বা চলে গেলে?
চা খাওয়া শেষে পেছনে ঘুরেই অবাক হয়ে গেলো ভিনা,রুপিন আন্টি!ভিনা চা খাওয়া রেখে ফুটপাত ছেড়ে দৌঁড়ানো শুরু করলো। এর আগেই সে গাড়ি নিয়ে চোখের পলকে হারিয়ে গেলো।ভিনা দৌড়াতে গিয়ে পায়ে ব্যথাও পেয়েছে। সেদিকে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। ভিনা হন্যে হয়ে খুঁজছিলো তাকে ।এই মানুষটাকে আজ বড্ড দরকার ছিলো। ঘড়িতে দশটা বারো বাজে,ক্লাস লেট হয়ে গেছে।আজকে মকবুল স্যার এই অজুহাতে আবার অফিস রুমে একা ডাকবে।লোকটা খালি অজুহাত খুঁজে একা পাওয়ার। ইচ্ছে করে লোকটাকে খুন করে ফেলতে, কিন্তু সেই লোক খুব ভালোমত জানে বাবা আর তার সেকেন্ড ওয়াইফের সাথে ভিনার সম্পর্কটা বেশ দূর্বল।যার কারণে অযাচিত কিছু করলেও ভিনা কোনো স্টেপ নিতে পারবে না।এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করছে সে।কিছুই করার নেই হয়ত।কোনো স্টেপ নিতে গেলে ক্যারেকটারলেস তকমা লাগবে গায়ে,ঘরের মানুষই ছাড়ে না,বাইরের মানুষ তো দূরের।আচ্ছা,মুনা কী সত্যিই ঘরের মানুষ?

সব ভেবে ক্লাসে যেতে দশটা বিশ বাজলো,আনমনে ক্লাসে ঢুকে মে আই কামিং স্যার বলতেই চেনা স্বর কানে আসলো......
.
.
.
চলবে....................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন