অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ১২ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


যাবির বিকালে ভিনার বাসার নিচে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো।কিছুক্ষণ পরে ভিনা নেমে আসলো।একটা নীল কালারের শার্ট আর প্যান্ট পড়েছে সে।চুল গুলো আলগোছা করে খোপা করা। কাঁধে ছোট ব্যাগ।এসেই কিছু না বলে হাঁটা শুরু করলো।যাবির কেন যেন চোখ সরাতে পারছে না।আহামরি কিছুই না।সব অগোছালো, চুল থেকে শুরু করে চোখগুলোও।রাজ্যের দুঃখ যেন বয়ে নিয়ে যাচ্ছে সে চোখ।এই বয়সী মেয়েদের মাঝে চঞ্চলতা কাজ করে,কিন্তু ভিনা ধীর স্থির।যাবির রিকশা খুঁজতে লাগলো রাস্তায়,হটাৎ পেছনে ঘুরে বললো-

-আমার সাথে রিকশায় বসতে কোনো সমস্যা আছে?

-না, কেন থাকবে?

-না মানে,যদি হেজিটেট ফিল করো,তাই আরকি।

-পরিবেশ ম্যাটার করে।আজকে যদি বৃষ্টি পড়ত আর আমি শাড়ি পড়ে ভিজে রিকশায় আপনার সাথে বসতাম,তাহলে সমস্যা হতে পারত। ইঞ্জুরড হাত নিয়ে রোগী হিসেবে রিকশায় বসলে সেই সমস্যাটা হবে না।

যাবির ভিনার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো,ভিনাও তাকিয়ে রইলো,কিন্তু যাবিরই চোখ সড়াতে বাধ্য হলো,না,এই মেয়ের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা মানে সর্বনাশ। জলদি করে রিকশা নিয়ে ভিনাকে নিয়ে উঠে পড়লো সে। 

-তোমার বাসায় জানে এই ব্যাথার কথা?

-হ্যাঁ জানে।

-কী বলেছো?

-যতটুকু বলার ততটুকুই বলেছি।

-আমার সাথে যে এসেছো ডাক্তারের কাছে,এটাও কি জানে?

-না,কিছু বলে আসিনি।এমনিই বের হয়েছি। 

-কেউ বকবে না?

-এত সময় কারো নেই। 

এই কথাটায় কেমন যেন বিষন্নতা লুকোনো।মনে হচ্ছে আপন কেউ বকা দিলে মনটা ভালো হয়ে যাবে।এই বয়সে কেউ যখন বকার 
জন্য আত্মহত্যা করে,সেখানে বকা খাওয়ার জন্য মনে হয় মেয়েটা আকুল হয়ে আছে।আপন কারো কাছ থেকে,ভালোবাসার জন্য।হস্পিটালে আসতে বেশিক্ষণ সময় লাগলো না।আসার পর তানভির কে ফোন দিলো যাবির।দশ মিনিটের মধ্যেই তানভির এসে সব রিপোর্ট দিলো হাতে,সে সাথে ড্রেসিং ও করে দিলো।কিছুক্ষণ পরে সেই সিনিয়র আপু এসে জানালো হাই ডোজের পেইন কিলার খেয়েছে ভিনা।এরপর ঔষধ দিয়ে,কাউন্সিলর এর নাম্বার দিলো।

-যাবির,ভিনাকে কাউন্সিলরের কাছে নিয়ে যেও।আমি চেক আপের সময় হাতে দাগ দেখেছি।ও সুসাইডাল আই গেস।

-আচ্ছা আপু।

সব গুছিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় যাবির তানভির কে ডাক দিলো-

-বিল দে।

-লাগবে না

-ডাক্তার হইয়া নে,এরপর তো ভিজিট দিমু না।বিল টা দে এখন,

-আরে বাদ দে!

-দিলি, নাকি?

যাবির দেখলো বিল এসেছে একুশ শ।গলা শুকিয়ে গেছে।ব্যাগ ঘাটা শুরু করলো,যদি কিছু পায়।সত্যিই,কিছু পেলোও।একটা খাম।খামে পাঁচ হাজার। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে এরপর তানভিরকে টাকা ফেরত দিয়ে দিলো।ভিনা বাইরে দাঁড়ানো ছিলো।

-এভাবে টাকা দেয়া ঠিক হয়নি।

-কিসের টাকা?

-খামের।

-কিসের খাম?

-যেটা ব্যগে ঢুকিয়েছো।

-আমি যে ঢুকিয়েছি,প্রমাণ আছে?

যাবিরের রাগ লাগছে।

-তো কে ঢুকাবে?

-কী ঢুকাবে?ছি ছি

যাবির লজ্জায় পড়ে গেলো।

-দেখো ভিনা,আমার টাকা লাগবে না।

-না লাগুক,আমাকে কেন বলছেন?

-তুমি ফেরত নাও টাকা।

-আমি কেন নিবো?

-কারণ এটা তোমার টাকা।

-আমার নাম লেখা আছে?আপনি জানলেন কীভাবে?

-আমাকে সেধে কে টাকা দিবে?কেন দিবে?

-আপনি পরোপকার মানুষ, সবাইকে সাহায্য করে বেড়ান,এর জন্য মনে হয় কেউ মিরাক্যালি রেখে গেছে।

-মিরাকেল?সিরিয়াসলি?

-বাস্তবতা থাকলে বিপরীত ভাবে অবাস্তবতাও থাকবে,সেটাই মিরাক্যাল।

যাবির হাল ছেড়ে দিলো।

-কী করবো তাহলে আমি?টাকাটা তো আমার না।

-আমার দায়িত্ব ও তো আপনার না,তবুও তো নিয়েছেন,এভাবেই টাকাটা নিয়ে নিন।যাদের দায়িত্ব তারা তো পালন করে না।আমি এ বিষয়ে আর কথা বলবো না,কথা বাড়ালে চলে যাবো।

যাবির আর এই বিষয়ে কথা বাড়ালো না।

-আচ্ছা শোনো,কাউন্সেলরের কাছে যাবা?

-না

-তোমার এই সমস্যার সামান্য ও যদি হেল্প হয়?

-কাউন্সিলর নিশ্চয়ই আপনার মত ভোর দেখাবে না?

রিকশা বাসার সামনে এসে পড়তেই ভিনা লাফ দিয়ে নেমে দৌঁড়ে চলে গেলো।যাবির তাকিয়ে থাকলো,যতক্ষণ দেখা যায়।এই মেয়েকে নিয়ে প্রতিদিন ভোর দেখা যায়,প্রতিদিন।


মুনার জ্বর এসেছে, কিছুই ভালো লাগছে না।আজকে রান্নাও হয়নি।সোহেল যে বাইরে গেছে,একবার জিজ্ঞেস ও করেনি কিছু লাগবে নাকি। খাম হাতে ধরিয়ে রোবটের মত চলে গেছে।খামে কী ছিলো তা ভালোমত জানা আছে,যথেষ্ট ভারী ছিলো।এতটুকু মেয়ের হাতে এত টাকা দিচ্ছে,অথচ তার হাতে মাস শেষে কিছুই দেয় না।আগে সে একটি ব্যাংকে ক্যাশিয়ার হিসেবে এ কাজ করত,মোটামুটি হাত খরচ এসে পড়ত,ফ্যামিলিতেও কিছু টাকা দিত। বিয়ের আগে সোহেলের মা শর্ত দিয়েছিলো,কোনো চাকরি করা যাবে না,ঘরের বউ ঘরেই থাকবে।মুনার মা বাবা বিনা বাক্য ব্যয়ে রাজিও হয়ে গেছে।যেন সে একটা আপদ, সে গেলেই তারা বাঁচে।কলিং বেজে উঠলো।নিশ্চয়ই ভিনা এসেছে।দরজা খুলতেই বেশ হাসিমুখে ভিনা ঘরে ঢুকলো।হাহ্!এই হাত নিয়েও টইটই করে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর টাকা উড়াচ্ছে।এই মেয়ে নাকি কষ্টে বাঁচে না!সোহেল মেয়ের ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে গিয়েছে একেবারে। বেশ জোরেই দরজা লাগিয়ে ঘরে চলে গেলো মুনা।সব দেখে তার দিকে একবার তাকিয়ে ভিনাও উপরে চলে এলো।নওমি কী যেন বলবে বলেছিলো,আর ফোন দেয়া হয়নি।এখন দিবে।


জেরিনের অসহ্য লাগছে সব।আজকেও যাবির নাকি আসবে না,কী যেন কাজ আছে বললো।অতিরিক্ত ভাব এই ছেলের, সব বুঝে তাও পাত্তা দেয় না,অথচ প্রতিমাসে এই বাসা থেকেই কিন্তু পনেরো হাজার পায়।এইযে এত দেমাগ,এটা সহ্য করবে না জেরিন,সুযোগ মত বাদ দিয়ে দিবে।এক মাসের জন্য বাদ দিলে যখন আক্কেল আসবে,তখন ফিরিয়ে আনবে।যত যাই হোক,যাবিরকে ভালোবাসে সে।


এদিকে যাবির আজকে গুলশানে যাবে,প্রতিমাসে একবার করে আসতে হয় এখানে।মানুষের কাছে সাহায্য নিতে সে পছন্দ করে না,কিন্তু সৃষ্টিকর্তার ও এমন বিধান,সাহায্য ছাড়া চলাও মুশকিল।ছোট থেকেই সে দেখে এসেছে এই মানুষটাকে সাহায্য করতে। মায়ের চিকিৎসার জন্য প্রতিমাসে যে টাকা যায়,সেটার ব্যবস্থা করার মত অবস্থা এখনো যাবিরের হয়নি।কিন্তু সে আশা করে একদিন না একদিন সে সবার থেকে মুক্ত হবে,নিজের পায়ে দাঁড়াবে।
.
.
.
চলবে..........................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন