অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ২০ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


জন্মদিনের শেষ সময়ে ভিনার বাবা উইশ করেছে। আর গিফট হিসেবে ওর মায়ের একটা শাড়ি আর এক জোড়া স্বর্নের কানের দুল দিয়ে গেছে।এসব দেখে ভিনা অনেকদিন পর মন উজার করে কেঁদেছিলো,শুধু তাই না,তার বাবাকে জড়িয়েও ধরেছিলো মাস খানেক পর।ভিনা ছোট থাকতেই ওর মা একদিন বলছিলো,বয়স আঠারো হলেই মায়ের সবচেয়ে প্রিয় শাড়ি আর কানের দুল পাবে সে।ধীরে ধীরে কবে যে বড় হলো,বোঝাই গেলো না।শাড়ির মাঝেও স্নেহের ঘ্রাণ আছে।তাই শাড়িটা পাশে রেখেই সে রাতে ঘুমিয়েছে ভিনা।এরপর প্রায় সপ্তাহখানেক হয়ে গিয়েছে।রেজাল্ট দিয়েছে জন্মদিনের দুইদিন পরই। খুব ভালোও না আবার খারাপ ও না।সব ভেবে সিদ্ধান্ত নিলো সে বাসার সামনের কলেজেই পড়বে।গ্রুপ চেঞ্জ ও করার ইচ্ছা আছে।হাতে আরো সময় আছে,ভেবে করবে সব।রেজাল্ট শুনে সোহেল রিয়েক্ট করবে বলে ভেবেছিলো,কিন্তু করেনি। বলেছে সামনের দিনগুলো সব গুছিয়ে নিতে।ভিনা বরাবরই ভালো ছাত্রী ছিলো,তাই সামান্য হলেও ভেতরে খারাপ লাগা কাজ করছে। নওমি বেশ ভালোই করেছে,ভিনাও খুশি এর জন্য,কিন্তু নওমি একটা পাগল।রেজাল্টের দিন ভিনার জন্য কান্না করে কাটিয়েছে,বেকুব একটা!যাবির আবার একটু বেশিই,সে বলেছে সিচুয়েশনের বেসিসে ভিনার রেজাল্ট 'খুবই' সন্তোষজনক।নানা অজুহাত দেয়া যায় রেজাল্ট খারাপের জন্য,কিন্তু কেন যেন অজুহাত দিয়ে সে আত্মতৃপ্তি পেতে চাচ্ছে না। খুব ভেবেচিন্তে সামনের দিনগুলো তে আগাতে হবে।সে তার বাবাকে প্রচন্ড ভালোবাসে,তাই অভিমান ও বেশি।এই অভিমান নিয়ে এক ছাদের নিচে থাকা সম্ভব না।সবচেয়ে বড় কথা ইদানিং তার বাবা মুনাকে বেশি সময় দিচ্ছে।প্রায়ই বাইরে নিয়ে যাচ্ছে।এমন না যে ভিনার খোঁজ খবর নিচ্ছে না,কিন্তু কেন যেন খুব বেশি আন্তরিক লাগে না সেটা।তার মায়ের জায়গা এত সহজেই কেউ নিয়ে নিচ্ছে,ভাবতেই পুরো পৃথিবী শূন্য হয়ে যায়। এই কষ্ট নিয়ে একসাথে থাকা অসম্ভব,তাই সে নিজে দূরে থাকবে। তাই কোনো জায়গায় সেটেল হয়ে এ বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়াই উচিৎ।দূরত্ব থাকলে ফর্মালিটির জন্য হলেও ভালো সম্পর্ক থাকবে।রুপিন আন্টিও এ ব্যাপারে সায় দিয়েছে।বলেছে সে চেষ্টা করলে বাইরে যেয়ে পড়াশোনার ব্যবস্থা উনিই করে দিতে পারবে।ইদানিং দিনগুলো খুব বেশি অসহ্য লাগে না।কষ্ট যে কমে গেছে তা না,কিন্তু সহ্য ক্ষমতা বেড়ে গেছে।Melania Martinez এর একটা গান রয়েছে,Mrs.Potato Head,সেখানে লিরিক্সে ছিলো,
'Baby soft skin turns into leather'

আগে না বুঝলেও সে এখন বুঝে।আগে সে ভাবত বয়সের সাথে সাথে বুঝি মানুষের অনুভূতি ভোতা হয়ে যায়।এখন সে জানে,বয়স কোনো ব্যাপারই না,অভিজ্ঞতাই সব।যার অভিজ্ঞতা যত তিক্ত,তার অনুভূতি তত ভোতা।


মুনার বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই মুনার প্রতি মায়া কাজ করছে সোহেলের।কোথাও আর যাওয়ার জায়গা নেই মুনার।কতটা অসহায়ত্ব কাজ করলে একজন বাবা নিজের মেয়েকে কাজের লোক বানিয়ে রাখতে বলে,ভাবলেই বুক ভারী হয়ে আসে সোহেলের।তার ও মেয়ে আছে,কখনো যদি দূর্ভাগ্যবশত ভিনার ভাগ্যে এমন ঘটে,তাহলে সে কি সহ্য করতে পারবে?অন্যের মেয়ের সাথে অন্যায় করলে প্রকৃতি যে এর প্রতিশোধ নিবে না,এর নিশ্চয়তা কী?আর মুনা তো জোর করে বিয়ে করেনি,তাকে আনা হয়েছে এই বাড়িতে।একজন মেয়ের বাবা হয়ে অন্যের মেয়ের সাথে এমন করা যায় না।সবচেয়ে বড় কথা, মুনা যা চাইছে,সেটা তার অন্যায় আবদার না,অধিকার।ভালোবাসতে না পারলেও দায়িত্ব তো পালন করাই যায়,এবং এটাই করবে সে।তাই ইদানিং সে মুনাকে সময় বেশি দিচ্ছে,ঘুরতে নিয়ে যাচ্ছে।সম্পর্কটা যতটা সম্ভব সহজ করার চেষ্টা করছে।হয়ত এই কেয়ারটুকু পেলে মুনা ভিনাকে ভালোবাসা দিতে কার্পণ্য করবে না।


জেরিনের মা খুব অসুস্থ।মেয়ের এইসব বাড়াবাড়ি সহ্যের সীমা অতিক্রম করেছে।জেরিনের বাবার এই বিষয়ে কোনো মাথাব্যথাই নেই।তিনি মনের সুখে ঘুরে বেড়ান।এদিকে জেরিন যে যাবিরকে পছন্দ করে দেখেই এসব করছে,এটা বুঝতে বাকী নেই জেরিনের মা খুরশিদের।কিন্তু মেয়েকে সরাসরি প্রশ্ন করার সাহস উনি পাচ্ছেন না।পাগল মেয়ে কখন কি করে বসে ঠিক নেই।জেরিনের বাবাকে দ্বিতীয় বাচ্চার কথা বলার উনি হাসতে হাসতেই শেষ। নানি হওয়ার বয়সে নাকি বাচ্চার শখ হয়েছে,এটা বলেছেন উনি।খুরশিদের নিজের হাজবেন্ড ইকরামের প্রতি প্রচন্ড বিরক্তি কাজ করছে।এই একি মানুষই নাকি দশ বছর আগে বাচ্চা নেয়ার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিলো।কিন্তু একটা বাচ্চাকেই বেশি সময় দিয়ে মনের মত মানুষ করবেন,এই আশায় আর বাচ্চা নেয়ার কথা চিন্তাই করেন নি।জেরিনের জন্য যে নতুন মেয়ে টিচার ঠিক করা হয়েছে,সেই টিচারের সাথে প্রথম দুইদিন প্রচুর মিসবিহেভ করেছে সে।মেয়েটার নাম মাইশা,সেও আইবিএ তেই পড়ছে,কিন্তু যাবিরের এক ব্যাচ সিনিয়র।জেরিন কে এই বলে পড়তে রাজি করানো হয়েছে যে,এই ইন্সটিটিউশনে পড়ার জন্য মাইশা হেল্প করতে পারবে।জেরিন অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে।যাবির পর্যন্ত পৌছানোর জন্য সে পসিবল সব পন্থাই চেষ্টা করেছে।ফেক একাউন্ট দিয়ে রিকোয়েস্ট দেয়া,অন্য নাম্বার দিয়ে কল দেয়,ইন্সটিটিউশনের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সব।লাভ হয়নি,এর জন্যই আরো বেশি জেদ কাজ করছে।সে কোনো ভাবেই হার মানবে না।


নওমির রেজাল্টের পরের দিনই তানভির প্রপোজ করেছে নওমিকে। নওমি সেদিন নিজের চোখে বিশ্বাস করতে পারছিলো না যে এত জলদি সে তার স্বপ্ন পূরণ হবে।কিন্তু সে ঠিক পুরোপুরি খুশি হতে পারছে না।তার জীবনে খুশির শেষ নেই যেন,আর ভিনার চারদিকে হাহাকার।রেজল্ট ও ভালো হলো না।এ অবস্থায় সে কীভাবে তানভিরের সাথে সম্পর্কের বিষয়টা জানাবে?সে জানে ভিনা এমন মেয়ে না যে হিংসা করবে,কিন্তু কষ্ট তো ঠিকি পাবে, পাওয়াটাই স্বাভাবিক। তাই আপাতত বলবে না।সব ঠিক হয়ে যাওয়ার পর বলবে।কত ভালো হত,যদি যাবির আর ভিনার ও সম্পর্ক হয়ে যেত!ভাবতেই অন্যরকম একটা অনুভূতি হচ্ছে।দুই বান্ধবী দুই বন্ধুকে বিয়ে করবে,একসাথে বিয়ে করবে,ঘুরতে যাবে,সংসার নিয়ে আলোচনা করবে,বাচ্চার স্কুল নিয়ে চিন্তা করবে এবং লাস্টে দুই বান্ধবী নিজেদের বাচ্চাদের একসাথে বিয়ে দিয়ে দিবে!ইশশশ!


যাবির নতুন টিউশনি পেয়েছে।লিফলেটে যতটুকু বেতন ডিমান্ড করেছিলো তার চেয়ে বেশি বেতনেই পেয়েছে টিউশনিটা।ব্যবস্থাটা করে দিয়েছে রুশান,তাও লিফলেট লাগানোর পরেরদিনই।রুশানের খালাত ভাইকে পড়াবে সে।এবারের টিউশনিটা বাসার কাছেও।কিন্তু যে বিষয়টা তাকে ভাবাচ্ছে তা হলো,রুশানের লিফলেট দেখার কথা না।যাবির নিজের কলোনিতেই সেগুলো লাগিয়েছিলো,রুশান সেখানে যায় না।জিজ্ঞেস করার পর কিছুই বলেনি।শুধু বলেছে পরিচিত একজন থেকে শুনেছে।অনেক ভাবার পর বুঝেছে এই পরিচিত আর কেউ না ভিনা।এর জন্য সেদিন বলেছিলো সব সমস্যা ঠিক হয়ে যাবে।মেয়েটা আসলেই অনেক বড় চিন্তা থেকে বের করে এনেছে।কীভাবে যে মেয়েটাকে খুশি করা যায়,ভেবেই পাচ্ছে না যাবির।


আজকে কোচিং এ যেয়েই শক খেলো ভিনা, মকবুল স্যার এসেছে ক্লাসে।বুকের ভেতরটা মোচর দিয়ে উঠলো।এসেই সে হাসিমুখে সবার খোঁজখবর নিলো।ভিনার দিকে হাসি দিয়ে বললো,

-পড়াশোনা হয়েছে তো ভিনা?এবার কিন্তু আমি এসে পড়েছি,ফাঁকিবাজি করা যাবে না।

আবার এক রাশ ঘৃণায় মন বিষিয়ে উঠেছে।পেছন থেকে রুশান জিজ্ঞেস করলো,

-ভাইয়া কি আর ক্লাস নিবে না?

-কেন,ভাইয়া খুব ভালো ক্লাস নিয়েছে?

-হ্যাঁ, ভালোই ক্লাস নিয়েছে।

-আমি এর চেয়েও ভালো ক্লাস নিবো,চিন্তা করো না।

ছুটির সময় মকবুল ভিনাকে অফিস রুমে যেতে বললো,ভিনা বললো তাড়া আছে।কালকে এসে দেখা করবে।ছুটির পর প্রায় কেঁদেকেটে অফিস থেকে বের হচ্ছিলো ভিনা।পেছন থেকে যাবির ডাক দিয়ে দিলো।

-ভিনা,দাঁড়াও

-বলো

-জানোই তো তুমি সব

-আগে বললে না কেন

-আমি বুঝিনি এসব।

-আচ্ছা 

-ভিনা,প্লিজ রাগ করো না

-আমি রাগ করার কেউ না যাবির......ভাইয়া..

-নিচে যাও,রিকশা ঠিক করো,আমি আসছি।

ভিনা নিচে যেয়ে রিকশা ঠিক করার পর যাবির আসলো,এসেই রিকশায় উঠলো।ভিনা বিনা বাক্য ব্যায়ে মাঝখানে ব্যাগ রেখে উঠে পড়লো।

-তোমার গিফট কিন্তু এখনো দেয়া হয়নি।

-লাগবে না,অনেক পেয়েছি,ইটস ইনাফ।

-কালকে ক্লাসে লেটে আসবে,ওকে?

-কেন?

-গিফট দিবো,আসবে কিন্তু

-আচ্ছা......
.
.
.
চলবে...............................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন