অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ১৫ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


ভিনার হাত প্রায় ঠিক হয়ে গেছে। তবে সেলাইয়ের দুই জায়গায় দাগ হয়ে গেছে।এই দাগ সারাজীবন থাকবে। ভিনা দাগের উপর হাত বুলালো,তার মোটেও খারাপ লাগছে না,কারণ এর সাথে জড়িয়ে আছে কিছু স্মৃতি,আর স্মৃতি জুড়ে আছে এমন অনুভূতি যা সে আগে অনুভব করেনি,দূর্ভাগ্যবশত করতেও চায় না।ডায়রির পাতাগুলোয় চোখ বোলাতে লাগলো,ঠিক সে সময়ই একটা একটা জায়গায় পেন্সিল দিয়ে কিছু লেখা দেখলো।সেখানে লেখা

'মা,তুমি যেখানেই থাকো,জেনে রেখো,তোমার মেয়ে একদিন অনেক বড় হবে।'

ভিনা হাতের লেখা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলো।এত সুন্দর হাতের লেখা,তাও একটা ছেলের।ভিনা মনে মনে ঠিক করলো আজ থেকে সেও সুন্দর করে লেখা শুরু করবে। তার আগে পড়াশোনা শুরু করা জরুরি। এতদিন গা ভাসিয়ে চলেছে, এখন একটা স্ট্যাবল লাইফের জন্য নিজেকে ঠিক করতে হবে।হাত মুখ ধুয়ে সে পড়তে বসে গেলো।আগামী ক্লাসের প্রেজেন্টেশনে সে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিবে।এসব দেখে যাবিরের রিয়েকশন কী হবে ভাবতেই,ঠোঁটের কোণে হাসি ছড়িয়ে পড়ে। 


মুনা গতরাতে সোহেল কে ডিভোর্সের কথা জানিয়েছে।আশ্চর্য জনক ভাবে সোহেল এর কারণ জানতে চায়নি।শুধু বলেছে, 'কবে উকিলের কাছে যাবে জানিয়ো'।মুনা জানতো সোহেল না করবে না ডিভোর্সের ব্যাপারে,কিন্তু এতটা নিরুত্তাপ প্রতিক্রিয়া থাকবে,সেটা তার ধারণার বাইরে ছিলো।নিজেকে এতটা ছোট মনে হচ্ছিলো যে শেষ করে ফেলতে ইচ্ছে করছিলো সব।কথা শেষ হওয়া মাত্রই মুনা তার বাবা বাড়িতে ফোন দিয়ে সব জানিয়ে দিয়েছে।তার মা শোনার পরই অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেছে আর অভিশাপ দিয়েছে,এ বাড়িতে যে জায়গা হবে না,তাও সাফ জানিয়ে দিয়েছে।মুনা সেসব কিছুই সোহেলকে জানায়নি।নিজের আত্মসম্মানের কাছে এখন কিছুই বড় মনে হচ্ছে না তার।পরশুদিন উকিলের কাছে যাবে বলে সব ঠিক করেছে।ডিভোর্সের পর অনেক দূরে চলে যাবে সে,নয়ত আত্মহত্যা করবে,নয়ত কোনোভাবে জীবনটাকে চালিয়ে নিবে।এসব ভাবতে ভাবতে মুনার ফোনে কল আসলো,তার ছোট বোন দোলা দিয়েছে।

-হ্যালো দোলা?

-আপা এটা তুই কী করলি!

-মানে?কী হয়েছে?

-আব্বা স্ট্রোক করেছে তোর ডিভোর্সের কথা শুনে।এখন সেন্ট্রালে আছে,জলদি আয়।

মুনার এক মূহুর্তের জন্য মনে হলো,সে হয়ত দুঃস্বপ্ন দেখছে।ফোন কেটে যাওয়ার কয়েক মূহুর্ত পর সে বুঝতে পারলো,জীবনে প্রথমবার স্বার্থপর হওয়ার ফল ভালো হয়নি।চুপচাপ রেডি হয়ে মুনা বেড়িয়ে গেলো হস্পিটালের পথে।সোহেলকে মেসেজ দিলো
'সেন্ট্রাল হস্পিটালে এসে পড়ো।আর মাফ করে দাও,আমি ডিভোর্স নিবো না।'


যাবির টিউশনি ছাড়ার পর থেকেই বেশ টেনশনে আছে।ক্লাস ও ঠিকমত করাতে পারছে না।এদিকে সামনে পরীক্ষা।কারো কাছ থেকে টাকা ধার চাইতেও খুব খারাপ লাগে।আরেকটা যে টিউশনি আছে,সেখানে মাসের অগ্রিম টাকাটা নিয়ে রাখতে হবে,এছাড়া চলা মুশকিল হয়ে যাবে।দুইদিন পরই ভিনার জন্মদিন,ইচ্ছে ছিলো ছোট খাটো একটা গিফট দিবে মেয়েটাকে।কিন্তু এখন দশ টাকা খরচ করতেও হিসাব করা লাগছে।এ বয়সী ছেলেরা কত ফূর্তি করে বেড়ায়,এ সময়টা হলো জীবনের গোল্ডেন টাইম,অথচ দায়িত্ব আর অনিশ্চয়তা ছাড়া জীবনে আর কিছুই নেই যেন।কলোনির পুকুর পাড়ে বসে খুব একা লাগছে,ভিনাকে কি কল দিবে?কেন দিবে?দিলেও বা কি হবে?


-কে তুমি?

মেসেজ টা দেখার পর নওমি চুপসে গেলো।তানভির কি কিছুই জানে না?ভিনা তো যাবির ভাইয়ার সাথে কথা না বলে কিছুই করার কিথা না।যাবির ভাইয়া তাহলে কি জানায়নি তানভিরকে?যদি তাই হয়ে থাকে,তাহলে আর মেসেজ দিবে না।ভিনাকে জিজ্ঞেস করার জন্য ফোন তুলতেই নওমি দেখলো তানভিরের নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে।

-নওমি?

খুশিতে হালকা চিৎকার দিয়ে উঠলো নওমি।তার মানে ভিনা আসলেই কাজটা ঠিকমত করেছে।

-হ্যাঁ, ভালো আছো?

-চলছে,হটাৎ কী মনে করে?

-না মানে,আমার গায়ে জ্বর, ভাবলাম চেনা জানা ডাক্তার থাকতে আর চিন্তা কিসের।

প্রায় রাত বারোটা পর্যন্ত মেসেজ চালাচালি হলো নওমি আর তানভিরের।হাজারো অপ্রাপ্তির অনুতাপের মাঝে,ছোট একটা সুন্দর পথচলা শুরু হলো।


জেরিন নাওয়া খাওয়া প্রায় ছেড়ে দিয়েছে।ইগো মানুষকে ধ্বংস করে দেয়।যাবিরকে না দেখে আগে থাকতেই পারত না,এখন কতদিন না জানি না দেখে থাকতে হবে।যাবিরের ফেসবুকে সেই কবে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দেয়া আছে,এক্সেপ্টেড হয়নি।মোবাইলে পাগলের মত মেসেজ দিয়ে গেছে স্যরি বলে,কিন্তু কোনো রিপ্লাই আসবে না,জানা কথা।যাবিরকে ছাড়া থাকা অসম্ভব।কোনো একটা উপায় বের করতেই হবে।হটাৎ করে শোয়া থেকে উঠে জেরিন টেবিল থেকে সব মেডিকেলের বই ফেলে দিলো।মেডিকেল ছোট থেকে স্বপ্ন থাকলেও এখন আর মেডিকেলের ধারের কাছেও যাবে না।এখন থেকে তার একটাই লক্ষ্য, যাবিরের সাথে একি ইন্সটিটিউশনে পড়া.....
.
.
.
চলবে...................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন