অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ২৪ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


আরশির কলেজ বাঙ্কের ঘটনা শুনে কেউই অবাক হলো না।ভিনার এদের দেখে মনে হলো এরা সবাই ই এধনের ঘটনা জেনে অভ্যস্ত। ক্লাসে যাওয়ার পর সেই একি মেয়ে এসে বললো,

-কী হলো?আরশি আসলো না যে?

-জানি না তো।

-বাঙ্ক দিয়েছে নিশ্চয়ই।দেখলা,কলেজের প্রথম দিনেই রঙ দেখানো শুরু করেছে।

ভিনা কোনো উত্তর দিলো না,উৎসাহ না পেয়ে মেয়েটা দমে গিয়ে বললো

-তুমি মনে হয় কথা কমই বলো,তাই না?

-হ্যাঁ 

-বুঝি সবই,নতুন পরিবেশ তো,কয়দিন পর সব এমনিই ঠিক হয়ে যাবে।

মেয়েটার নাম সুমনা।ভিনা নাম জিজ্ঞেস করেনি,নানা কথা প্রসঙ্গে সে নিজেই বলেছে নাম।'সুমনা', সু....মনা।মানে সত্যিই এত আইরোনিক নাম সে কোথাও দেখে নি। 
ক্লাস শেষে ওয়াসিম এসে আরশির ব্যাগ নিয়ে গেলো।প্রথম দিনেই ছেলেটাকে ভালো লেগেছে।ওয়াসিম না থাকলে নতুন পরিবেশের গুমোট ভাবটা কাটতোই না।ছুটির সময় কোথা থেকে যেন আরশি এসে ভিনার রাস্তা আটকালো।

-এই মেয়ে,আমার ব্যাগ কই?

-ওয়াসিম নিয়ে গিয়েছিলো।

-ওয়াসিম!তুমি নিতে দিলে কেন?আর কখনো নিতে দিবে না।এরপর থেকে তুমি নিয়ে আসবে।

ভিনা চুপচাপ কথা শুনে কিছু না বলে চলে আসলো।রাগে গা জ্বলছে।মেয়েটা পুরো বাপের জমিদারি পেয়ে গেছে।

-মেয়েটা কে ছিলো?

ভিনা চমকে পেছনে তাকিয়ে দেখে যাবির।খুশি হওয়ার পরিবর্তে ভয় পেয়ে গেলো সে।সবার আগে সুমনার কথা মনে পড়লো।তাড়াতাড়ি হাঁটা শুরু করে যাবিরকে পেছনে আসতে ইশারা করলো ভিনা।কলেজের বেশ খানিকটা দূরে একটা কোল্ড কফির দোকানের সামনে দুজন দাঁড়ালো।

-কী ব্যপার?এত ভয় পেলে কেন?

-কেউ দেখে ফেলত তাই। 

-আগে তো আমরা কলোনিতে হেঁটেছি,তখন তো ভয় পাওনি।

-পরে বুঝিয়ে বলবো সব,আগে বলো হটাৎ এখানে কী?

-কোচিং তো ছেড়ে দিয়েছো।কলোনিতেও আসো না।ভাবলাম তুমি নিখোঁজ হওয়ার আগে জানান দেই আমার কথা।লেখিকা টাইপ মানুষ তো তুমি,হালকা মাথা ছিট থাকবেই। 

ভিনা রাগ করতে যেয়েও পারলো না।অনেক কষ্টে হাসি চেপে রাখলো নিজের। 

-আমি তো ছিট,তুমি তো একেবারে পার্ফেক্ট জেন্টেলম্যান,তাহলে আমার পেছনে কেন আসলে?

-ওমা,তুমি জানো না?অপজিট এট্র‍্যাক্টস?

বেশকিছুক্ষণ কথা বলার পর ভিনা দোকান থেকে নেসক্যাফের দুটো কফি নিলো। কফি খেতে খেতে সারাদিনের গল্প করে ভিনাকে বাসা পর্যন্ত দিয়ে যাবির টিউশনিতে চলে গেলো। আরশির কারণে মন মেজাজ খারাপ লাগলেও এখন সবকিছু খুব ভালো লাগছে।


মুনা বাবার বাড়ি থেকে আসার পর থেকেই আরো ভেঙ্গে পড়েছে।এত স্যাক্রিফাইস করার পর ও নিজের পরিবারই তাকে ঠেলে দেয় দূরে,সেখানে সোহেল তো অনেক দূরের মানুষ।সোহেলের আচরণ নিয়ে আগে অভিযোগ থাকলেও এখন নেই,এটাই বোধহয় নিয়তি ছিলো তার।আলমারি গুছানোর সময় নিজের রিপোর্ট গুলো নিয়ে দেখলো সে।পিরিয়ডের সমস্যা বেশ আগের থেকেই ছিলো তার।আমলে নেয়নি কেউই।ডাক্তার দেখানোর ও প্র‍য়োজন মনে করেনি।অনার্সের প্রথম বর্ষে পিরিয়ডের সময় হটাৎ অনেক অসুস্থ হয়ে গেলে তার মা এক পরিচিত প্রতিবেশির কথা মত ফার্মেসি থেকে ঔষুধ কিনে খাওয়ায়।এরপর যখন আরো অসুস্থ হয়ে পড়ে,তখন নিরুপায় হয়েই ডাক্তার দেখানো হয় তাকে।বলা বাহুল্য এই ডাক্তারকে বেশ অপারদর্শী মনে হয়েছিলো মুনার।এই ডাক্তারের নানা টেস্ট দিয়ে ভরিয়ে ফেলেছিলো ফাইল।টেস্টের সংখ্যা আর খরচ দেখে আর কোনো টেস্ট করানো হয়নি।পরবর্তীতে ইরেগুলার পিরিয়ডের সমস্যা আরো তীব্র হয়।মুনার মা কোনো এক হুজুরের পানি পড়া এনে খেতে দেয় তাকে।এই কথা তার চাচির কানে গেলে সে চারদিকে চাউর করে বেড়াতে থাকে যে মুনা আর মা হতে পারবে না।এক বাড়ি থেকে দশ বাড়ি কথা ছড়ালে তার জন্য প্রস্তাব আসাই বন্ধ হয়ে যায়।শুরু হয় তার মায়ের অকথ্য অত্যাচার।এরপর টাকা জমিয়ে নিজেই ডাক্তার দেখায় মুনা।ডাক্তার জানায় অতিরিক্ত স্ট্রেস,ভুল আর দেরী করে চিকিৎসা করানোর কারণে অনেক সমস্যা হয়েছে তার।হাইপোথ্যালামিক ডিসফানশন আর পিসিওএস এর কারণে তার ফেলোপিয়ান টিউব আর ইউটেরাসে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার কারনে তার মা হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।এই খবর আর কাউকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি সে,কারণ তখন *মেয়ের বয়স বেশি* তকমা গায়ে লেগে গেছে,সেই সাথে তার বাবার চাকরি থেকেও রিটায়ার করেছে।নিজের বাসায়ই সবার সাথে সারাজীবন থাকার ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু হুট করে সোহেলের সাথে বিয়ে ঠিক করে তার মা, মতামত নেয়ার ও প্রয়োজন মনে করেনি।ঘরে অবিবাহিত বড় মেয়ে থাকলে এর প্রভাব অন্যদের উপরেও পড়ে।সব মিলিয়ে মাথা পেতে নেয় সব।এখন তার বয়স প্রায় ছত্রিশ,তার উপর সোহেলের সাথে তার স্বাভাবিক দাম্পত্য সম্পর্ক ও নেই বললে চলে।মা হওয়ার সম্ভাবনা যে নেই,এটা জেনে কেন যেন সব খালি খালি লাগে মুনার।


কয়েকদিন ধরে ভিনাকে খুঁজে খুঁজে রুশান অস্থির হয়ে গেছে।নওমির কাছে হাজার অনুরোধের পরও ভিনার ফেসবুক আইডি দেয় নি সে।নওমিকে এখন চোখের বিষ লাগে ওর।সে বৃত্তি পেয়ে দেশের নামি কলেজে ভর্তি হয়েছে।কয়দিন পরই পড়াশোনার চাপ বাড়বে, কিন্তু ভিনাকে হারাতে রুশান পারবে না।মকবুলের ঐ ঘটনার পর ভিনা আর কোচিং এ আসেনি। এর জন্য যাবিরের প্রতিও চাপা ক্ষোভ কাজ করে। কী দরকার ছিলো চৌদ্দজন মানুষকে ডেকে এসব ড্রামা করে হিরো হওয়ার?যাবির চাইলেই আলাদাভাবে মকবুলকে শায়েস্তা করতে পারত। ভিনা যদি অন্তত তাকেও জানাতো,সে ব্যাটার চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করে ফেলত তার বাবার ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে।ভিনার নাম্বারে কল দিলে বেশিরভাগ সময় বন্ধ থাকে,কল গেলেও রিসিভ করে না মেয়েটা।কিন্তু এসবের জন্য একটুও খারাপ লাগে না রুশানের,বরং আরো তীব্র অনুভূতি কাজ করে......
.
.
.
চলবে...................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন