অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ২৭ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


গত এক সপ্তাহেও যখন সোহেল মুনাকে তার বাবার বাড়ি পাঠালো না,তখন ভিনা সিদ্ধান্ত নিলো,সে তার বাবার সাথে কোনো সম্পর্ক রাখবে না।এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে প্রচন্ড কষ্ট হয়েছে।আত্মার সম্পর্ক ছিন্ন করা এত সহজ না,একি ছাদের নিচে থেকে তো আরো অসম্ভব।কিন্তু যে মানুষ অন্যের জন্য নিজের প্রথম স্ত্রী আর ভালোবাসার মানুষের মৃত্যু বার্ষিকী ও ভুলে যায়,তাকে ক্ষমা করা কঠিন।ভিনার এখন একটাই লক্ষ্য, কোনোভাবে এই পরিবার থেকে দূরে চলে যাওয়া।এর জন্য নিজের পায়ে দাঁড়ানো অনেক জরুরি,তাই কষ্ট নিয়ে হলেও পড়ালেখায় মনোযোগ দিচ্ছে।সে চায় না কোনো কারণে গার্জিয়ান কল করা হোক কলেজ থেকে।সারাদিনে কলেজ শেষে কথা বলার মানুষ বলতে শুধু যাবির।নওমি কেন যেন আগের মত নেই।যেই মেয়ে আগে মাঝরাতে ফোন দিয়ে কোন কালারের নেইল পলিশ লাগাবে জিজ্ঞেস করতে গিয়ে কথা বলে ভোর করে দিত,সেই মেয়ে এখন কোনো প্রয়োজন ছাড়া ফোন দেয় না।পড়াশোনার চাপের জন্যই হয়ত এমন হচ্ছে,এই বলে নিজেকে বুঝ দেয় ভিনা,কিন্তু মনের ভিতরে কাছের মানুষগুলো হারিয়ে যাওয়ার তীব্র ভয় কাজ করে।যাবির কে নিয়ে এই ভয়টা সবচেয়ে বেশি।সম্পর্কহীন মানুষের সাথে একি বাড়িতে থাকা,একাকীত্ব,কলেজে আরশির খেয়ালখুশি কান্ডকারখানা ,সম মিলিয়ে মনে ধীরে ধীরে পাহাড়সম বোঝার সৃষ্টি হয়েছে।যাবিরকে সব খুলে না বললেও যাবির ঠিকি বুঝে।কীভাবে বুঝে,সেটা সেই ভালো জানে।দিনশেষে এই একটা মানুষের কথা যেন অভিমানের পাহাড়ের বোঝা বয়ে বেড়ানোর শক্তি যোগায়।কিন্তু কখনো কখনো এই ধৈর্যের বাধ ভাঙে।দুইদিন আগে ক্লাসে ভিনা হেড ডাউন করে ছিলো,টিচার তখনো আসেনি।আরশি স্বভাবমত এসেই ভিনার ব্যাগ নিচে মাটিতে রেখে দিলো।প্রতিবার ভিনা চুপ করে থাকলেও এবার আর পারলো না।

-আমার ব্যাগ এখানেই থাকবে।

-জায়গা হয় না দেখো না সেটা?

-সবসময় আমিই দেখি,এবার তুমিও দেখবে।আমার ব্যাগ নিচে থাকবে না মানে থাকবে না।

-এত তেজ কিসের?ভালোই তো ছিলা এই কয়দিন,এখন কী সমস্যা?

-সমস্যা হলো প্রতিবার আমি কম্প্রোমাইজ করবো না।হয় দুইজনের ব্যাগ ই নিচে থাকবে,নাহলে দুইজনেরটাই উপরে।আর হ্যাঁ, ছুটির সময় তোমার ব্যাগ আমি আনতে পারবো না।সামান্য ব্যাগ সামলাতে না পারলে কলেজে আসা বন্ধ করে দাও।

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থেমে গেলো ভিনা।সে প্রস্তুত ছিলো আরশির প্রতিক্রিয়ার জন্য।কিন্তু আরশি কিছুই বললো না।নিজের ব্যাগ নিচে নামিয়ে রেখে বললো।

-ঠান্ডা হইসিস?হইলে বস।

ভিনা আরশির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে পুরো বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করছে।

-আমি জানি এমনিই এত ক্ষেপার মেয়ে তুই না,হইসে কী বল,বয়ফ্রেন্ড ছ্যাকা দিসে?

-না

-মা মারসে?বাপ মরসে?ভাই গালি দিসে?

-না

-তাইলে তো কিছুই হয় নাই।

-কী হয়েছে না হয়েছে তোমাকে কেন বলবো আমি?

-না বললে আমার উপর রাগ ঝাড়সিস কেন?আমার উপর যেহেতু রাগ দেখাইসিস,আমাকে বলা লাগবেই যে কী হইসে। 

-আমি বলবো না।

-বাসায় সৎমা?

ভিনা উত্তর দিলো না।অকারণেই চোখে পানি এসে পড়েছে।

-বুঝছি।সৎমা ই।তো হইসে টা কী?বাপে দেখে না তোকে?

-জানিনা।

-এসব ছোট খাটো ব্যাপারে কান্না করে লাভ নাই। দিন দুনিয়ার কত তামশা যে দেখবা সামনে!কান্নার দিন সামনে আছে,সামলায়ে রাখো এসব রাগ।আর না পারলে আমাকে বইলো।

আরশিকে সেদিন অনেক বেশি আপন মনে হয়েছে ভিনার।কিন্তু কিছু আগ বাড়িয়ে বলেনি সে।আগে আরশির ব্যাপারে জেনে নিবে। 


নওমির কলেজ লাইফ খুবই ভালো যাচ্ছে।নতুন বই,নতুন বান্ধবী, নতুন প্রেম আর স্বাধীনতা। এত এত নতুনের মাঝে পুরোনো অনেক কিছুই সে ভুলতে বসেছে।কলেজ শেষে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই তানভিরের সাথে দেখা হয়। এত ভালো আর কেয়ারিং একজন মানুষকে নিজের জীবনে পেয়ে নওমির মনে হচ্ছে এর চেয়ে সুন্দর জীবন হতেই পারে না।কে বলেছে এই বয়সে চোখে রঙিন চশমা থাকায় জীবন সুন্দর লাগে?জীবন টা তো এমনিই নানা রঙে ভর্তি থাকে।কেন যেন এখন ভিনাকে নিয়ে ভাবতেও ইচ্ছে হয় না।ভিনার জীবনে একরাশ বিষন্নতা আর বয়সের তুলনায় ভারিক্কি ছাড়া কিছুই নেই। ভিনার কথা চিন্তা করলেই কেন যেন একটা অনুশোচনা কাজ করে,এর থেকে দূরে থাকার জন্যই ইদানিং আর তেমনভাবে কথা হয় না ওর সাথে।কিন্তু তানভিরের সাথে বাইরে গেলে ভিনার কথা বলেই বের হতে হয়।নতুন জোটানো বান্ধবীদের খুব বেশি ভালো চোখে নওমির মা দেখে না।ভিনাকে অনেক আগে থেকে চিনে দেখে আলাদা একটা ভরসা আছে তার প্রতি।ভিনার কোনো খবর না নিয়েও এই ওর নাম ব্যবহার করায় নিজেকে মাঝে মাঝে স্বার্থপর মনে হয় নওমির।কিন্তু ঐত,এই বয়সে যেচে পড়ে কেউই অনুশোচনা, অপরাধবোধ নিজের মাঝে কাজ করায় না।


রুশানের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ততা বেড়ে গেছে।ক্যারিয়ারের আগে এখন সে কিছুই ভাবছে না।কিন্তু সংগোপনে সে ভিনাকে নিয়ে ভাবে,শুধু ভাবে না,ভালোবাসার তীব্র অনুভূতিও লালন করে নিজের মাঝে।যাই পরিকল্পনা করুক, সেটা ভিনাকে ঘিরেই হয়।ওর বিশ্বাস,নিজে স্ট্যাব্লিশ হয়ে ভিনার সামনে দাঁড়ালে,ভিনা ওকে ফিরাবে না।আর ভিনা যেরকম রুক্ষ আর নিরস বাস্তববাদী মেয়ে,প্রেম করার প্রশ্নই আসে না।এখন শুধু চেষ্টা,নিজেকে হারিয়ে স্বপ্নের পেছনে ছোটা।
.
.
.
চলবে..............................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন