অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ০৬ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


-ভিনা,কিছু কথা আছে তোমার সাথে।

-বলো.....বাবা....

-আজকে কী তুমি আমার রুমে গিয়েছিলে?

-হ্যাঁ,তোমার আর মার রুমে গিয়েছিলাম।

সোহেল ভিনার দিকে ভালোমত তাকালেন। সে অন্যমনস্ক হয়ে সব কথার উত্তর দিচ্ছে।তার চোখে কোনো স্থির হয়ে আছে দেয়ালের দিকে।তার নিজেরো খুব অস্বস্তি লাগছে ভিনাকে এইভাবে জেরা করতে,কিন্তু মুনা যা বলেছে,তার সত্যতা আর গভীরতা জানার জন্য এই কাজ তার করাই লাগবে।

-রুমে গিয়েছিলে কেন?

-আমার মনে হয় তুমি উত্তরটা জানো। না জেনে নিশ্চয়ই আমার রুমে আসো নি। 

-ঠিক,তাহলে আসল কথায় আসি,রুপিনের নাম্বার দিয়ে তোমার কী দরকার। 

-রুপিন আন্টিকে দরকার। 

-কেন?

-তার সাথে কথা বলবো।

-দেখো ভিনা,আগের সিচুয়েশন কিন্তু এখন নেই।তোমার মা আর আমার সাথে রুপিনের একটা আন্তরিক সম্পর্ক ছিলো।তুমি যে ধরনের সম্পর্ক আশা করছো রুপিনের সাথে,সেটা এখন সম্ভব না।কারণ তোমার মা আর নেই।আর.... 

-আর মুনা সেটা পছন্দ করছে না।

-মুনা কিন্তু এমনি এমনি রাগ করে না।তোমার কিছু বিহেভিয়ারেল ফ্ল আছে। তুমি মুনাকে নাম ধরে ডাকছো কেন? 

-তো কী ডাকবো?মা?

-মুনা আন্টি ডাকো।সে তোমার বড়, ন্যূনতম সম্মানটুকু করো।

-সম্মান তাকেই করা যায় যে সম্মানের যোগ্য।সে আমার সাথে প্রতিযোগিতা করে। মার জায়গা নেয়ার চেষ্টা করে। 

-তাকে আনাই হয়েছে এই কারণে।

-ভুল,তাকে আনা হয়েছে তোমার জন্য,আমার জন্য না।

-এ্যডজাস্ট করতে শিখো, সবসময় সব জায়গায় মনমত পরিবেশ তুমি পাবে না।

-নিজের বাড়িতেই পাই নি,সব জায়গা বাদ দাও বাবা।

-তুমি কি আমার আর মুনার ডিভোর্স করাতে চাচ্ছো?

-মুনার সাথে থেকে তুমিও কম্পলেক্স এ ভুগা শুরু করেছো।আমি সেপারেশন কেন চাবো?

-তাহলে?

-আমি শুধু রুপিন আন্টিকে চাই,উনার সাথে কথা বলতে চাই।উনি আমাকে অনেক স্নেহ করতেন,যেই স্নেহটা বহুদিন আমি পাই না।

-এটা তোমার ভুল ধারণা,তুমিই নিজের চারপাশে একটা দেয়াল তৈরি করে রেখেছো,এই দেয়ালের বাইরে না তুমি আসো,না কাউকে আসতে দাও।

-যেটা ভালো বুঝো,কিন্তু মুনাকে আমার পছন্দ না।

-এখন আমাকে কী করতে বলছো তাহলে?তুমি ভালোমত জানো আমি মুনাকে কেন বিয়ে করেছি। সে কখনো মা হতে পারবে না। তোমার জায়গা যেন কেউ না নেয়,এর জন্যই।বিয়েটা আমাকে করতে হয়েছে চাপে পড়ে। তুমি যেমন তোমার মা কে ভালোবাসো,আমিও বাসি,এটা তোমার বুঝতে হবে ভিনা।

-তাতে কী হয়েছে বাবা?আমার জন্য তোমার সময় কোথায়।ঠিকি তো তোমার সেকেন্ড ওয়াইফকেই প্রায়োরিটি দিচ্ছো।

-যে বুঝতে চায় না, তাকে বুঝিয়ে লাভ নেই।তোমাকে আমি অনেক ভালোবাসি,এমন কিছু করো না যেন এই ভালোবাসার জায়গা টুকু নষ্ট হয়ে যায়।তোমার মা যেমন সরল একজন মানুষ ছিলেন,তেমন হও।নাহলে তোমার মা ই কষ্ট পাবে।

সোহেল চলে গেলে ভিনা বালিশ চেপে ধরে কাঁদতে থাকে।তার বাবা আজ তাকে সন্দেহ করছে,তাও পর মানুষের জন্য। কেউ জানেনা,যখন মুনাকে নিয়ে তার বাবা রুমে ঢুকে,তখন চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে ভিনার,কলিজাটা ছিড়ে যেতে থাকে।অনেক যত্ন আর আর আদরে বড় হওয়া মেয়েকে যদি কেউ এক ধাক্কায় অবহেলা করে অসহায় করে ফেলে,এর কষ্ট তখন ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।


যাবির অনেক্ষণ যাবৎ ভিনা ইনজামাম নামের আইডি সার্চ করে যাচ্ছে।একেক বানানে,নাম আগে পিছে করে,বাংলা ইংলিশ সব ধরনের টাইপ করে,কিন্তু কোনোভাবেই ভিনার আইডি পেলো না।কিন্তু ওর ফ্রেন্ড নওমির আইডি পেলো।যাবির একান্ত প্রয়োজন না হলে কোনো মেয়েকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দেয় না।কিন্তু নওমিকে দিলো। প্রায় ঘন্টাখানেক পর রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট করলো নওমি।মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই আগে নক করলো যাবির।

-হাই, নওমি

-হ্যালো ভাইয়া,ভালো আছেন?

-হ্যাঁ ভালো,কিছু বিষয়ে জানার দরকার ছিলো,হেল্প করবে?

-চেষ্টা করবো,বলেন।

-আমি ভিনার ব্যাপারে জানতে চাই।

-হটাৎ?

-আজকে ওকে দেখলাম।ওর আচরণ আমার স্বাভাবিক মনে হয়নি।

-কখন দেখেছেন?

-ছুটির পর,রাস্তায়,যখন বাসের অপেক্ষা করছিলো।

-আচ্ছা....

যাবিরের প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে,কিন্তু কেন জানো নিজেকে সংবরণ করতে পারছে না।সব বিরক্তি দূরে সড়িয়ে আবার মেসেজ দিলো।

-ভিনা কি কিছু নিয়ে আপসেট?

-হ্যাঁ।

-কেন?

-কিছু মনে করবেন না ভাইয়া।ভিনা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।ওর পার্সোনাল লাইফের ব্যাপারে আমি কারো সাথে কথা বলতে পারি না,এটা আমার দৃষ্টিতে উচিৎ না,তাই কিছু বলতে পারলাম না।

-তুমি তোমার এথিক্সের দিক থেকে ঠিক, তোমার এই বিষয়টাকে আমি সম্মান করি,কিন্তু দেখো,আমি কিন্তু বড় ভিনার চেয়ে।হয়ত ও কোনো বড় সমস্যায় আছে।আমি সাহায্য করলে যদি ওর সামান্য হেল্প হয়,আমি তাতেই সন্তুষ্ট হবো।

-আচ্ছা,এ ব্যাপারে আমি আপনাকে পরে জানাই। 

নওমি মেসেঞ্জার থেকে বের হয়ে আসলো।ও জানে না কী করা উচিৎ। মাত্র এক ক্লাসের পরিচয়ে কারো ব্যক্তিগত ব্যাপারে কথা বলা, কতখানি উচিৎ হবে,সে এখনও বুঝতে পারছে না।ভিনা প্রচন্ড মানসিক যন্ত্রণায় আছে, এবং ওকে সাহায্য করার মত নওমি ছাড়া কেউ নেই,সে এটাও জানে।সব মিলিয়ে ভীষণ দ্বন্দ্বে পড়ে গেলো সে।আপাতত এ বিষয়ে কথা না বলাই উচিৎ মনে করলো। 

পরেরদিন ক্লাসে ভিনাকে দেখে আকাশ থেকে পড়লো নওমি।পুরো শরীর র‍্যাশ এ ভরা আর চোখ গুলো ফুলে লাল হয়ে আছে।জিজ্ঞেস করায় বললো বাসার মেডিসিন বক্স থেকে সব ওষুধ খেয়ে বক্স ফেলে দিয়েছে।খালি পেটে ওষুধ খেয়ে টিকতে পারেনি,তাই প্রচুর বমি হয়েছে।বমি করার পর ও ঔষুধের রিয়েকশনে পুরো শরীরে র‍্যাশ উঠেছে।আর কোনো কথা বললো না নওমি।জানে,বলে কোনো লাভ নেই।মেয়েটার ডাক্তার দেখানো দরকার,কিন্তু একা নিজের পক্ষে ভিনাকে নিয়ে যাওয়া পসিবল না,আবার নিজের ফ্যামিলিকে জড়ানোও ঠিক মনে করছে না।কে জানে হয়ত ভিনার সাথে চলাফেরাই না বন্ধ করে দেয়।অবশেষে ছুটির পরে নওমি অফিস রুমের বাইরে অপেক্ষা করতে থাকে....
.
.
.
চলবে...............................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন