পরিপূরক - পর্ব ১৫ - স্পৃহা নূর - ধারাবাহিক গল্প


— হানিমুনে যাচ্ছি আমরা
— What nonsense???? বাচ্চা পেটে নিয়ে হানিমুন??? তোমাদের কি রেগুলার আমাকে একটার পর একটা চমক না দিলে হয় না?
.
.
— এতটা ওভার রিয়াক্ট করার মতো তো কিছু বলিনি আমি।
— ছিহ । তোমরা আসলেই অসভ্য। লজ্জা করে না???
— না করে না । নিজের বৌ এর সাথে হানিমুন যাব লজ্জার কি আছে???
— আমার কোন রুচিই নেই তোমাদের সাথে কথা বলার।
— কথা তো তুমি এমনিতেই বলা বাদ দিয়ে দিয়েছ আমার সাথে। আমার যে তোমার সাথে কথা না বললে ভাল লাগে না সেটা তো তুমি ভুলেই গিয়েছ।
— হ্যা আরো বেশি করে ভুলে যেতে চাই। তোমার মতো নিকৃষ্ট মানুষের সাথে কি কথা বলব?
— নিকৃষ্ট কথা ই বলবে..
— তোমার না জ্বর...কথা না বাড়িয়ে ঘুমিয়ে পড় তাড়াতাড়ি।
.
— এই ওহি ,, দ্যাখো...বৌ আমার রাগের ডিব্বা কিন্তু দরদের সিলিন্ডার।
.
— হি হি,,,আপু তুমি এত দরদ কই পাও এই পচা লোকটার ওপর???( ওহি)
— দুজনের মনেই খুব ফুর্তি ধরেছে না?? যাও তোমরা যেখানে খুশি আমার কি??? 
— হু আপু আজকে আমি অনেক খুশি। আসো চকলেট খাই। (ওহি)
— হুম অয়নী আপু আজকে আমিও অনেক খুশি আসো আপু আমরা তিনজন চকলেট খাই...
.
অহন আমার দিকে মুখ ভেঙচিয়ে বলল...মেজাজ তো আরো চরমে উঠল...
.
,— আমি চকলেট খাই না ।
.
বলে রুমে চলে আসলাম। সারারাত আর ঘুমাই নি। রাগে বড়িতে মাকে ফোন দিলাম । অনেক্ষন কথা বললাম ।তবুও আসল কথা টাই বলতে । মনে হল কে যেন বলতে ভেতর থেকে নিষেধ করেছে ..মন সায় দিল না আর।
ভাবলাম চলছেই তো ।।।চলুক না এভাবেই...
.
.

শুক্রবার রাতে টুকিটাকি কাজ সেরে রুমে এসে গান প্লে করে মাত্র শুয়েছি । 
পাশের রুম থেকে অহি অহনের বেশ হাসাহাসির শব্দ পাচ্ছি। পাশাপাশি রুম হওযাতে সব ই শোনা যাচ্ছে। 
.
তারা বাচ্চার নাম ঠিক করা নিয়ে কথা বলছে।ওহি একটার পর একটা আবল তাবল নাম বলে যাচ্ছে আর অহন হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। ওহির যেমন স্বভাব কোন কিছুতেই সিরিয়াসনেস নেই। বাচ্চার নামের বেলায় ও তাই । সে তার বাচ্চার নাম রাখতে চাইছে মেয়ে হলে কুচিপুচি ছেলে হলে কুচুপুচু ।। আরো বলছে গোল্লা, লাড্ডু, জিলাপি, গুলু,মুলু...
বাচ্চার বাবা হ্যা হ্যা করে হাসছে...সে নিজেও দু একটা নাম বলছে ওরকম ই আবল তাবল।
অথচ অহন আমাদের বাবুর কত সুন্দর নাম ঠিক করেছিল। ছেলে হলে অর্জন মেয়ে হলে ...
থাক সেসব মনে করে আর কি লাভ।।। 
কথায় বলে না সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে।।।। তেমন ই ওহির সাথে থেকে থেকে অহন দিন দিন ফালতু হয়ে যাচ্ছে মনে হয় আরো বেশি। কোন সিরিয়াসনেস নেই ভেতরে।
উফ্ফ এদের এসব শুনতে শুনতে ধৈর্যের বাধ ভেঙে গেল ।
আমি হালকা সাউন্ড দিয়ে নচিকেতার গান শুনতে শুরু করলাম চোখ বন্ধ করে শুয়ে শুয়ে। মনোযোগ গানের দিকে দেয়ার জন্য ।।
.
.
ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাওয়া এসময় 
মেনে নেয় তার পরাজয়
জীবন পরে ধুলতে হারিয়ে সঞ্চয় 
যার কথা ভাসে মেঘলা বাতাসে তবু সে দুরে তা মানি না""""
.
.
গানে যেন মনের কথা গুলোই বলছিল বার বার। 
অসহ্য আরো বেশি লাগছিল।। গান থামিয়ে আবার উপুর হয়ে শুয়ে পড়লাম রুম অন্ধকার করে।
.
এরই মধ্যে অহন এসে আমার চুলের ক্লিপ গুলো খুলতে লাগল আর আবার সেই গানটাই ধরল,,
"""রাত বেড়ে যায় ধীর পায়
বাতাসেরা যেন অসহায়
শুকনো পাতার নূপুরে কে যেন ডেকে যায়
যার উষ্ণ আচে ভালবাসা বাচে সে হৃদয় ভাঙে তা মানি না.
জানি না কেন তা জানি না।"""
.
— লজ্জা করে না এসব বলতে??
— গান বলতে লজ্জার কি আছে?? তুমি তো একটু আগে এটাই শুনছিলে ।তাই আমি ভাবলাম অন্তরা টা গেয়ে দিই।
— হয়েছে এই রাত দুপুরে আর গানুয়া হতে হবে না।
— তোমাকে না বলেছি চুলে ক্লিপ দিয়ে ঘুমাবে না?? এখনো এ স্বভাব যায় নি তাই না??
— মাঝে মাঝে ভুলে যাই এখন আর চুলে ক্লিপ খুলে দিয়ে শাসন করার মতো কেউ নেই।
— পরি বৌ নাও জিলিপি খাও।
বলেই টুপি এগিয়ে দিল। অহনের এটা একটা বাজে অভ্যাস।। মসজিদে জিলিপি দিলেই সেটা টুপির মধ্যে করে হাতে নিয়ে আসবে।। টুপির ভেতর ই রেখে দেব।আর এনেই আমাকে দেবে।আগে বাবা ও আমাকে দিত । এটা আমার শুক্রবারের একটা অভ্যাস, মসজিদে দেয়া জিলিপি খাওয়া।
— আমি খাই না এসব বাসি জিলিপি
— বাসি কেন হবে? আসরের সময় এনেছি। তুমি না মসজিদের জিলিপি পছন্দ করো নাও খাও।
— খাব না আমি। যাও ওহি কে দাও। 
— ওহি টুপির ভেতর রাখা জিনিস খাবে না বলে দিয়েছে। ওর নাকি ঘেন্না লাগে মনে হয় আমার মাথার ঘাম ভরে আছে।
— অহ আচ্ছা এই জন্য আমার কাছে আনা হয়েছে??? এক জনের রিজেক্ট করা জিনিস আমি কেন খাব?
— কি আশ্চর্য । তুমি দিন দিন অনেক বদলে যাচ্ছ অয়নী। তোমার ভেতর হিংসা চলে আসছে দিন দিন।। 
.
— আমি এরকম ই।।। 
জিলিপি গুলো নিজেই খেতে খেতে গজ গজ করে চলে গেল ।
.
.
আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল ওরা আসলে হানিমুনে যাবে না ।। হয়ত আমাকে জেলাস ফিল করাতেই এসব বলেছে।
তাই আমিও এ ব্যাপারে এমন একটা ভাব দেখাচ্ছি যে আমার ওদের এসবে কিচ্ছু যায় আসছে না । কবে যাবে, কোথায় যাবে সে সব কিছুই জিজ্ঞেস করি নি।।।।
.
.
 কিন্তু এই দুদিন হল ওহির গোছগাছ করা দেখে আমার আমি পুরো অবাক। এই মেয়ে একটার পর একটা লাগেজ গোছাচ্ছে। হানিমুনে যাচ্ছে নাকি সেখানে কাপড়ের দোকান দিতে যাচ্ছে কে জানে । 
.
 .
এসব দেখে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম,
— ওহি তোমরা যেন কবে যাচ্ছ?
— এইত আপু কাল ই ফ্লাইট
— কাল ই???
— হ্যা
— বাহ। 
— আমরা কোথায় যাচ্ছি জানতে চাইবে না?
— নাহ। ইচ্ছে নেই জনার। কিন্ত যেখানেই যাও এত লাগেজ নিয়ে গিয়ে কি করবে?? কাপড়ের দোকান দেবে নাকি দুজন ফুটপাতে বসে?
— কই আর এত আপু? ঐ আমার দুটো আর অহনের একটা । আর একটু গোছগাছ বাকি আছে কাল সকালের মধ্যে কমপ্লিট করে নেব আমরা।।
— বাহ। খুব ভাল ।খুব এনজয় করো ওকে? 
— এভাবে বলো না । 
— আচ্ছা বলব না ।
.
.
আমি অহনের প্রতি যখন ই একটু বিশ্বাস ফিরে আনতে চাই তখন ই এরা এমন এমন সব কান্ড ঘটায়।। বিশ্বাস তো দুরের কথা ঘেন্না চলে আসে কেন জানি আমার এদের ওপর। 
প্রথমে ভাবলাম সত্যি সত্যি বিয়ে করে নি তারপর ই শুনলাম ওহি প্রেগন্যান্ট,,,,, আবার মনের মধ্যে কেমন যেন কিন্ত আসছিল তখন ই আবার এই হানিমুন।।।
.
.
মন মেজাজ দুটোই যথেষ্ট খারাপ ছিল।।রুম থেকে বের ই হই নি আর।।
.
সকাল বেলা অহন রুমে এসে বলল ওহি কে নিয়ে ডক্টর এর কাছে যেতে।। বাইরে যাওয়ার আগে ওহির চেক আপ করিয়ে নিতে চায় সে।। সে কোন রিস্ক নিতে চায় না । 
ওরা যাবে হানিমুন । আর তার জন্য ওর বৌ এর হেল্থ চেক আপ করাতে আমি নিয়ে যাব।। এই কথা শুনতেই আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলে উঠল।।।রাগে মনে হচ্ছিল পাগল হয়ে যাই ।
.
তবুও শান্ত গলায় বললাম
— আমি পারব না যেতে
— কেন পারবে না?? সারাদিন তো বাড়িতেই থাকো । 
— তোমার বৌ তুমি নিয়ে যাও। অন্যদিন তো তুমিই নিয়ে যাও । অথবা মা নিয়ে যায়।
— মা অসুস্থ একটু দেখছই তো । আর আমার ও কাজ আছে আজ একটু।
— হানিমুনে যাবার শপিং বাকি আছে বুঝি???
— হ্যা ওরকম ই।
– যাই হোক আমি যেতে পারব না ওহির সাথে ।
— তো ও একা যাবে কিভাবে এই অবস্থায়??
— কেন হানিমুনে তো ঠিক ই যেতে পারছে । সামান্য ডক্টর এর কাছে যেতে পারবে না? ওসব নাটকে তুমিই ভুলতে পারো আমি না ।
.
 .
কথায় কথায় অনেক কথা বাড়ল আমাদের মধ্যে । মা ও কিছুক্ষণ পর পর আগুনে ঘি ঢালছিল। ওহি দু এক বার থামাতে চাইল। অহন ওকেই ধমক দিয়ে থামিয়ে দিল।
ঝগড়া এক সময় জঘন্য পর্যায়ে চলে গেল।
ঝগড়ার এক পর্যায়ে আমি বলেই ফেলেছি,
 বিয়ের এত তাড়াতাড়ি এ বাচ্চা কিভাবে আসল? এ বাচ্চা তোমাদের অবৈধ বাচ্চা তাই না? তোমাদের মধ্যে বিয়ের আগে থেকেই কিছু ছিল তাই না??? অবৈধ বাচ্চা বৈধ করতেই হুট করে বিয়ের নাটক করলে তাই তো??? তাছাড়া বাড়িতে বললেই তো ঘটা করেই বিয়ে দিত তোমাদের।।
রাগের মাথায় আমি আমার সন্দেহের কথা গুলই বলেছি।
এসব শুনে অহন প্রথম বারের মতো আমার গায়ে হাত তুলল। দুই গালে মোট তিনটা থাপ্পড় দিয়েছে। আরো দিত যদি না ওহি থামাতো ।
সাফ সাফ এটাও বলে দিল, আমি যেন ওহি কে নিয়ে আর একটা বাজে কথা না বলি ।।তাহলে নাকি তার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না।আমি নাকি দিন দিন অসভ্য হয়ে যাচ্ছি।। আমার মধ্যে স্বার্থপরতা আর হিংসা ছাড়া নাকি আর কিচ্ছু অবশিষ্ট নেই।।। আমি আমার মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলেছি ।। আমি নিজে মা হতে পারব না তাই ওহি কে হিংসে করছি।।।
.
অহন কথায় কথায় দু একটা পয়েন্ট ভুলে গেলেও মা সেগুলো মনে করে দিতে ভুলল না । 
অহন ও সে তালেই তাল মেলালো।। যা ইচ্ছে তাই বলে গেল। মোট কথা, তার সব কথার একটা অর্থ দাড়াল আমি স্বার্থপর আর হিংসুটে হয়ে যাচ্ছি দিন দিন।।আমার চিন্তা ধারা সব ই নাকি কুত্সিত। আমাকে প্রথম থেকে শাসন না করাই নাকি তার সব চেয়ে বড় ভুল।
মা ও তার ছেলেকে বলল, আমাকে নাকি বেশি লাই দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছে অহন।
.
.
আমি ওর শেষ কথা গুলোর কোন উত্তর ই দিই নি।। শুধু তাকিয়ে ছিলাম।।আর ওর চোখেও পানি দেখেছিলাম।
.
.
অহন চলে যাবার পর মা ওহি কে নিয়ে ডক্টর দেখাতে ঠিক ই গেল।। ওহি এসবের পর যেতে চাইল না । মা ই জোর করে নিয়ে গেল। ওহি শুধু আমাকে বলে গেল, আপু তুমি ভুলে যাও সকালের ঘটনা।। অহন যা করেছে রাগের মাথায় করেছে। আগুনে ঘি বেশি ঢাললে আগুনের শিখা তো বেশি হবেই।। পানি দিয়ে সে শিখা নেভানো তোমাকেই জানতে হবে।
.
আমি ওহির একটা কথার ও উত্তর দিই নি। আমি মনে মনে যা সিদ্ধান্ত নেয়ার নিয়ে ফেলেছিলাম।।

ওরা ক্লিনিকে যাওয়ার পর অহনের জন্য একটা চিঠি লিখলামম। কারণ আমি জানি বিকেলে বাড়ি ফিরে ও আমার কাছে মাফ চাইতে আসবে।।। কিন্ত আমি ওকে আর এবার সে সুযোগ দেব না ।।।
.
.
পুরক সাহেব,
ভালো থেকো তুমি। আর কখনো হিংসে করব না তোমাদের ..কথা দিলাম।
এই কুতসিত আর অসভ্য মনের মানুষ কে আর কোন দিন ও দেখতে হবে না তোমাদের।। 
ভেব না আজকের ব্যাপার টার জন্য চলে যাচ্ছি।প্রতিদিনের টুকরো টুকরো ক্ষত গুলো ই আজ যেন দাবানল এর মতো মনে হচ্ছে। আসলে আমি পরাজিত পুরক সাহেব। আমি তোমাদের এই নোংরা খেলায় পরাজয় মেনে নিলাম।। তুমি তো এটাই চেয়েছিলে তাই না যে আমি তোমার জেদের কাছে হার মানি? হ্যা মেনেই নিলাম হার।
তোমরা তোমাদের মতো থাকতে তাতে তো আমি কোন হস্তক্ষেপ করিনি। কিন্ত তোমরাই বার বার আমাকে তোমাদের মাঝে টেনে নিয়ে গেছ। 
আমি তো চলেই যেতে চেয়েছিলাম বাবা মার কাছে । তুমিই যেতে দাও নি। তুমিই আমাকে তোমাদের পথের কাটা করে রেখেছিলে। শুধুমাত্র আমার ওপর তোমার জেদ খাটাতে । অথচ আমি বোকার মতো সেগুলো কে ভালোবাসা ভেবে এসেছি।।।
.
পুরক সাহেব , ভয় নেই আমি তোমার দেয়া কিছুই নিয়ে যাচ্ছি না । তোমার দেয়া নাক ফুল টাও না। এই চিরকুটের সাথেই গেথে দিলাম সেটা।।।যে শাড়ি টা পড়ে যাচ্ছি সেটাও আমার বাবার দেয়া। 
আচ্ছা অহন তোমার মনে আছে, 
তুমি সব সময় বলতে আমাকে নাক ফুল টা পড়ে থাকতে।। তোমার নাকি ভালো লাগে খুব আমাকে এভাবে দেখতে।নাক ফুল কোন কারণে খুলতে দেখলেই রাগ করতে, আবার জোর করে পরিয়ে দিতে
এখন অহিকে এসব কর তাই না?? 
যাই হোক বাদ দাও,,,, পুরনো কথা মনে না করাই ভালো ।
আর হ্যা,আমাকে খামোখা খুজতে যেয়ো না ।। হয়ত পাবে কোন হসপিটালের মর্গে।।। হয়ত পাবেই না ।।আমি জানি আমাকে তোমার সেভাবে দেখতে ভালো লাগবে না ।।
কখনো আকাশ বেয়ে চুপ করে 
যদি নেমে আসে ভালোবাসা খুব ভোরে 
চোখ ভাঙা ঘুমে তুমি খুজো না আমায়
আশে পাশে আমি আর নেই
.
আমাকে নিজের দুস্বপ্ন ই মনে করো ।।।
ইতি
তোমার দুঃস্বপ্ন.....!!
.
.
.
চলবে...........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন