অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ১৭ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


ভিনা সুতির হালকা রঙের ঢিলা একটা ফতুয়া পড়েছে,সাথে বাদামী প্যান্ট,যথারীতি চুলগুলো আলগোছে খোপা করা,হাতে পুরোনো একটা নকশা করা ছোট পার্স,আর স্যামসাং এর পুরোনো একটা টাচফোন।সবই মলিন,শুধু ওর চোখ ছাড়া।কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে পড়ে থাকা ফুলগুলো তুলে নিয়ে খোপায় দিলো সে।যাবিরকে দেখেই সাথে সাথে ফুলগুলো ফেলে দিলো।যাবির এসেই দুটো ফুল তুলে খোপায় লাগিয়ে দিলো।ভিনা লজ্জা পেয়ে আর চোখই তুললো না।

-কী ব্যাপার বলো তো,ফুল গুলো ফেলে দিলে কেন?

-এমনি

যাবির কথা বাড়ালো না এই প্রসঙ্গে।সে জানে ভিনা কেন ফেলে দিয়েছে,অযথাই প্রশ্ন করে নাজেহালের মানে নেই। প্রেমে মানুষকে চোখ দেখেই সব বুঝে নিতে হয়।প্রেম,যাবির ধীরে ধীরে বুঝতে পারছে,সে ভিনাকে ভালোবাসে।তাইতো কালকে এক্সাম থাকা সত্ত্বেও ভিনার এক কলেই নিচে নেমে এসেছে।অভ্যাসমত পকেটে হাত ঢুকিয়ে ভিনার পাশে হাঁটছে।কেউ কোনো কথা বলছে না।কেন এসেছে,কেন হাঁটছে,কিছুই যেন জানার দরকার নেই।কথা বললেই যেন কাচের মত এই নিস্তব্ধতার মধ্যে থাকা তীব্র অনুভূতিগুলো ভেঙ্গে যাবে।যে প্রেমে কথা কম,সেই প্রেমই সার্থক,সব যদি বলেই দিতে হয়,তাহলে সেটা কেমন সম্পর্ক! কিন্তু ভিনা কি যাবির কে পছন্দ করে?কেন করবে না?যাবির যে কারণে সব ফেলে এখানে এসেছে,ভিনাও এসেছে হয়ত।হয়ত না,ওকে এই কারণেই আসতে হবে!

-পার্সটা খুব সুন্দর।

-এটা আমার মার।

-ফোন?

-এটাও মায়ের ছিলো,বেশিদিন ইউজ করেনি।

-খারাপ লাগে না?
 
-মায়ের জিনিস ক্যারি করতে খারাপ লাগবে কেন?তার আগে বলো,তোমাকে খুব চিন্তিত লাগছে,কেন?

-এমনি,পড়াশোনার চাপ।

-শুধু কি তাই?

-না

-তাহলে?

-ক্রাইসিস চলছে।

-ক্রাইসিসে থাকলে ছোট জিনিসও অনেক বড় মনে হয়।এই ব্যাপারটাকে কাজে লাগাও

-যেমন?

-টাকা থাকলে পাঁচশ টাকার খাবারে যে আনন্দ,ক্রাইসিসে থাকলে পাঁচ টাকার চায়ে সেটা পাওয়া যাবে।

-চা খাবে?

-হ্যাঁ, কড়া লিকারের রঙ চা।

পাশের টঙ থেকে চা নিয়ে পুকুর পাড়ে বসলো ভিনা আর যাবির।সূর্যাস্তের সময় হয়ে আসছে,পুরো আকাশে কমলা আভা।যাবির গরম চা হাতে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে ভিনার দিকে।মাঝখানের এই চার আঙ্গুলের দূরত্ব ঘুচিয়ে ভিনা ওর কাঁধে মাথা রাখবে,এই আকাঙ্ক্ষা পৃথিবীর সব দুশ্চিন্তা থেকে এক টানে ওকে দূড়ে সরিয়ে ফেলেছে।ভিনা একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে ফেলেছে,হাতের চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে,কিন্তু তাদের মাঝখানের উষ্ণতার কাছে এটা কিছুই না।সূর্য ডুবে যাওয়ার পর,এক চুমুকেই ঠান্ডা চা খেয়ে ভিনা উঠে গেলো,যাওয়ার আগে বল গেলো-

-সমস্যা যাই থাকুক,ঠিক হয়ে যাবে সব।এবার আমি কথা দিচ্ছি। 

শুধু সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত না,জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই মেয়েটার সাথে থাকার জন্য,যাবির সব করবে,এই প্রতিজ্ঞা করলো।


রাতে ফোন দিয়ে সোহেল ভিনাকে জানিয়ে দিলো মুনার বাবা মারা গেছে, তাদের আসতে ভোর হবে।আজকে যেন ভিনা মোমেনা কে থাকতে বলে তার সাথে।ভিনা শুধু আচ্ছা বলে ফোন রেখে দেয়।মোমেনা খালা আগেই চলে গেছে,তার ছেলে আলামিন আজকে মাদ্রাসা থেকে আসবে।এখন এই কথা জানালে সোহেল চিন্তায় পড়ে যাবে।বাবা মারা যাওয়ার কথা শুনে ভিনার সামান্য হলেও মুনার জন্য মায়া লাগছে,সে চায় না এই অবস্থায় তার বাবা মুনাকে একা ফেলে আসুক।সব চিন্তা বাদ দিয়ে ভিনা নওমির কাছ থেকে রুশানের নাম্বার নিলো।

-হ্যালো রুশান?আমি ভিনা

রুশান ভিনার গলা শুনতেই একদম চুপ হয়ে গেলো।ভিনা ওকে ফোন দিয়েছে!

-হ্যালো?

-হ্যাঁ হ্যাঁ, হ্যালো,ভিনা

-ভালো আছো রুশান?

-হ্যাঁ ভালো,তুমি কেমন আছো?

-এইত ভালো। একটা হেল্প লাগবে,করবে?

-অবশ্যই!

-একটা টিউশনি লাগবে।

-কার?

-ঐযে যাবির ভাইয়ার।সে অনেক ভালো পড়ায়।তোমার পরিচিত কেউ থাকলে আমাকে জানিয়ো।আর হ্যাঁ, একটু জলদিই।

-কালকের মধ্যে আমি সব কনফার্ম করবো,ওকে?

-ওকে,থ্যাঙ্কিউ সো মাচ।আর শোনো,স্যালারি টা একটু হাই যেন থাকে,ওকে?

-ওকে। 

-তুমি নওমি থেকে ডিটেইলস নিয়ে নিও।

-তোমার আইডি নেই?

-ডিএক্টিভেটেড 

-ওহ আচ্ছা,সমস্যা নেই।

-রাখি তাহলে,বাই।

-টেক কেয়ার।

রুশান ফোন রাখার পরপরই ওর পরিচিত সব বন্ধুদের ফোন দেয়া শুরু করলো, ভিনা এই প্রথম কিছু করতে বলেছে,এটা কোনোভাবে ভুল করা যাবে না।


ভিনার খুব একা লাগছে।এত বড় বাসায় আগে কখনোই একা থাকা হয়নি। সারারাত এভাবে একা থাকা অসম্ভব।ভিনা খুঁজে বের করে তোহাকে ফোন দিলো।ফর্চুনেটলি এবার ফোন অন আছে এবং রিং হচ্ছে।ছয়বার রিং হওয়ার পরই তোহা ফোন রিসিভ করলো।

-হ্যালো তোহা আপু!আমি ভিনা!

-ভিনা?কেমন আছো?

-আছি আরকি,রুপিন আন্টি কোথায়?

-ম্যাম তো বাইরে,ফিরতে রাত হবে।

-রুপিন আন্টির নাম্বার প্লিজ দাও তোহা আপু।প্লিজ!

-আচ্ছা,লিখো।

ভিনা নাম্বার নিয়েই দেরী না করে ফোন দিলো।কিছুক্ষণ পর সেই পরিচিত কন্ঠস্বর শুনলো,যার জন্য বিগত কয়েকমাস আকুল হয়ে অপেক্ষা করছিলো সে!.....
.
.
.
চলবে.................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন