যাবির বাসায় এসে বিছানায় কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলো।সারারাত ঘুম হয়নি,তবুও ঘুম আসছে না।ভিনার সাথে পরিচয় মাত্র দিন কয়েকের। তবুও এত চিন্তা কেন, সেটার হিসাব মেলানোর চেষ্টা করছে।হতেও তো পারে এটা শুধুই সহমর্মিতা, তার বাবা নেই,ভিনার মা নেই,কারণ টা শুধু এইটাই।কিন্তু বাবা মা নেই এমন ফ্রেন্ড ও তো ওর সাথে পড়েছে।সহমর্মিতা কাজ করেছে,কিন্তু এত তীব্র অনুভূতি না।আচ্ছা,এত অল্প সময়ে কী মানুষ প্রেমে পড়ে?প্রেম?এই কথাটা মাথায় কেন আসলো?মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে,মনে হয়।পাশ ফিরে শুতেই ভিনার ব্যাগ চোখে পড়লো,গতকাল ভিনাকে বাসায় পৌঁছে দেয়ার পর কোচিং থেকে ব্যাগটা নিয়েছিলো।
ব্যাগের ভেতরে একটা খাতা,দুটো কলম,এক প্যাকেট সিগারেট,লাইটার,চার্লস ডিকেন্সের গ্রেট এক্সপেকটেশন,ডেল কার্নেগির অমনিবাস, একটা পুরোনো ডায়রি, ভিনার মায়ের একটা পাসপোর্ট সাইজ ছবি,ছোট পার্সে পয়ঁতাল্লিশ টাকা আর কিছু কয়েন পেলো। সব বাদ দিয়ে ভিনার ডায়রি দিয়ে শুরু করেছিলো যাবির।
ডায়রিটা ভিনার মতই ছন্নছাড়া।ডায়রির প্রথম পেজে লেখা,
"এটা আমার ডায়রি,শুধু আমার।এটা কেউ আমার থেকে নিতে পারবে না।অন্তত এটা নেয়া উচিৎ না,তাই না?"
এরপর ডায়রির মাঝখানে আঁকিবুঁকি আর ফাঁকে কয়েকটা করে লাইন লেখা।যেমন
"মা,এভাবে যে ছেড়ে চলে গেলে,ভেবে দেখেছো আমি কীভাবে থাকবো?তুমি তো জানতেই আমি অনেক বেশি ইমোশনাল,সবসময় আফসোস করতে,আমি কবে বড় হবো,পৃথিবী চিনতে শিখবো,তাই বলে এভাবে চলে যেতে হবে?"
"ঘুম আসছে না।কাল পরীক্ষা, আবারো বাজে স্বপ্ন দেখেছি,বাজে স্বপ্নের চেয়ে ঘুম ভাঙ্গার পর তোমাকে পাশে না পেয়ে বেশি কষ্ট লাগছে।"
"পিরিয়ড হয়েছে আমার।আমাকে বলে দিয়েছিলে কীভাবে কী করতে হয়।টেনশনে ছিলে পিরিয়ড হচ্ছিলো না দেখে।আমার সামলাতে কত কষ্ট হয়েছে জানো?দাদী তার সামনেই আসতে দিচ্ছে না আমাকে।"
"মা,তুমি এই মহিলার সাথে কীভাবে ছিলে!কীভাবে!আমি পারছিনা, তুমি ফেরৎ এসে দাদীকে পাঠিয়ে দাও।"
"বাবা কাঁদে জানো?সে অনেক কষ্টে আছে,অন্তত বাবার জন্য আসো?"
"দাদী বাবার বিয়ের কথা বলেছে।আমি কিন্তু এসব মানবো না মা,আমি কিন্তু সব ছেড়ে চলে যাবো!"
"কেউ এখন ডিজাইন করে জামা বানিয়ে দেয় না।আমার জন্য কারো সময় নেই।এবারের ইদের জামাটা একদম মলিন হয়েছে।খুব গর্জিয়াস হলেও পড়তাম না।তুমি ছাড়া কি ইদ হয়?"
"রুপিন আন্টি আর আগের মত কথা বলে না।আজকে এসেছিলো দাদীকে বোঝাতে,বেচারিও অপমানিত হয়ে চলে গেছে।"
" বাবা কিন্তু তোমাকে ভালোবাসত না মা,সত্যি বাবা তোমাকে ভালোবাসতো না।সে তোমার জায়গায় অন্য একজনকে এনেছে।আমি আর কখনো বাবার মত মানুষকে চাবো না আমার জীবনে,সে প্রতারক"
"মুনা অনেক খারাপ।এত খারাপ যে আমার প্রিয় বাকের ভাইয়ের মুনাকেও এখন ভালো লাগছে না।"
"পরীক্ষাটা ভালো হলো না মা,আমার জীবন কি এখানেই থেমে যাবে?"
"স্যরি মা,সিগারেট ছাড়া আর চলা সম্ভব না।তোমার মেয়ে ইমোশনাল ই রয়ে গেছে।দোষ তোমার,তুমি এভাবে রেখে গেছো"
"কাউকে খুন করলে কী আর তোমার দেখা পাবো না?মকবুল একটা শুয়োর!"
"আমার আত্মহত্যা করতে ভয় লাগে।কিন্তু আমি তোমার কাছে আসতে চাই।"
এগুলো ছাড়াও অনেক সুন্দর কবিতা আর ছোট গল্প আছে ডায়রির ভেতরে।এত কম বয়সে এত পাকা হাত দেখে যাবির মুগ্ধ হয়।একটা জিনিস উপলব্ধি করে।একি ঘটনা ভিন্ন মানুষ কে ভিন্নভাবে আঘাত করে।কারণ হয়ত বয়স,স্মৃতি, এটাচমেন্ট,ইমোশন।তার বাবা নেই,ব্যাপার টা সে খুবই সাধারণ ভাবে নিয়েছে,বাবার মৃত্যু গভীরভাবে তাকে স্পর্শ করেনি।কিন্তু ভিনার মায়ের মৃত্যু ভিনাকে ভেতর থেকে টুকরো করে ফেলেছে।টিন এজের এই টালমাটাল সময় নিজেকে সামলানো মুশকিল।সিগারেট খাওয়া যাবিরের একটু ও পছন্দ না।কিন্তু সে কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে ভিনার সাথে সিগারেট নিয়ে সুখ দুঃখের গল্প করতে চায়।
•
সকালে উঠে ভিনা স্যুপ খেয়ে ঔষুধ খেয়ে নেয়।স্যুপ বানিয়ে উঠার সময় সোহেলের সাথে তার দেখা হয়।
-হাতে কী হয়েছে?ব্যান্ডেজ কেন?
-ব্যাথা পেয়েছিলাম।
-কীভাবে?
-কাচের টেবিলে পড়ে গিয়ে।
-আশ্চর্য! এত বড় ব্যাথা পেলে তাও আমাকে জানানোর দরকার মনে করলে না?কই দেখি হাত দাও।
-আহ!ব্যাথা লাগছে সেলাইয়ের জায়গায়!
-সেলাই লেগেছে!ডাক্তারের কাছে কে নিয়ে গেছে?
-নওমি।
-নওমি তো ছোট মানুষ, ও কী বুঝবে,তোমার আমাকে ফোন দেয়া উচিৎ ছিলো ভিনা।
-তুমি ব্যস্ত,তাই বলিনি।
-ডাক্তারের খরচ ও কী নওমি দিয়েছে?
-না
-তাহলে?
-হয়ে গেছে কোনোভাবে ব্যবস্থা।
-ভিনা,একটা কথা বলো তো,তুমি টাকা পাচ্ছো কোথা থেকে?
-আমার চেয়ে তোমার ওয়াইফ ভালো জানবে,তাকে জিজ্ঞেস করো।
-এখন তোমার সাথে কথা বলে লাভ নেই,কিন্তু বাসায় এসে অন্তত বলতে পারতে আমাকে।
-কীভাবে বলবো,তুমি তো ডিনারে গিয়েছিলে।
-মুনাকে বলতে।
-তুমি কি মনে করো সে দেখেনি?তার সামনেই বাসায় এসেছি।এই ব্যাপারে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।আমি ভালো আছি।
সোহেলের মাথায় রক্ত চড়ে গেছে।মুনা কীভাবে এই কথাটা লুকালো!এত স্বার্থপর মানুষ কীভাবে হয়?সোহেল চিৎকার করে ডাক দিলেন...
মুনা!
.
.
.
চলবে..................................................