ভিনা ছুটির পর কোচিং থেকে বের হওয়ার সময়ে নওমিকে না পেয়ে অপেক্ষা করতে থাকে বাইরের চেয়ারে।অনেক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরও নওমি না আসায় অফিসের ভিতরে নক করার জন্য উঠে দাঁড়ায়,কিন্তু এর আগেই মাথা ঘুরিয়ে পাশের কাচের টেবিলে পড়ে যায়।কাঁচ গুড়ো হাতে লেগে বেশ ইঞ্জুরড হয় ভিনা।ছুটির পর গার্জিয়ান ছিলো না কোনো,অফিস রুমের ভেতর থেকে নওমি আর যাবির আর এদিকে অফিসের পিয়ন সবুজ দৌঁড়ে আসে।সবকিছু দেখে যাবির অফিস থেকে মানিব্যাগ আর মোবাইলটা নিয়ে আসে।
-ওকে মেডিকেলে নিয়ে চলো,গাড়ি আছে না তোমার?
-হ্যাঁ আছে।
-দেরী করা যাবে না।
যাবির ভিনাকে কোলে নিয়ে দ্রুত লিফটের দিকে আগালো।কিন্তু খারাপ সময়ে সবই খারাপ হয়।লিফট আউট অফ সার্ভিস ছিলো।যাবির সাবধানে আর দ্রুত গতিতে ভিনাকে নিয়ে সিড়ি দিয়ে নামতে লাগলো।এরি মধ্যে নওমি ড্রাইভারকে ফোন করে গাড়ি গেটের সামনে আনতে বলে।গাড়ি তে নওমি সামনের সিটে বসে,পেছনে যাবির ভিনাকে নিয়ে।যাবিরের কোলে ভিনার মাথা রাখা,হাত থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত পড়ছে। পেছন থেকে টিস্যু বক্স নিয়ে ভিনার হাত মুছে দিতে থাকলো যাবির।
-পানি হবে নওমি?
-শেষ হয়ে গেছে।
-সামনের কোনো দোকান থেকে এক বোতল পানি কিনো। আর জলদি ওর বাবাকে ফোন দাও।
-ওর বাবার নাম্বার আমার কাছে নেই ভাইয়া।
-নেই মানে!তুমি নাকি ওর বেস্ট ফ্রেন্ড,তোমার তো সব জানার কথা।
-হ্যাঁ,কিন্তু ভিনাই দেয়নি।
-ভিনার মোবাইল আছে?
-ওর ব্যাগ কোচিং এর ভেতরেই রয়ে গেছে। আর ও মোবাইল ইউজ করে না।
-মানে কী!এই যুগে আবার মোবাইল না ইউজ করে নাকি!
-হ্যাঁ, ও বাইরে মোবাইল নেয় না।বাসায় একটা পুরনো টাচফোন আছে,খুব প্রয়োজন হলে সেটাই ইউজ করে।
-ওর বাবা মা, মানে বাবা আরকি,উনি খোঁজ নেন না?
-ব্যস্ত মানুষ উনি,আর বাকীটা ভিনাই ভালো বলতে পারবে।
সামনের দোকান থেকে পানি কিনে ভিনার মুখে পানি ছিটে দেয় যাবির।
ভিনা আস্তে করে চোখে খুলে,কিন্তু পুরোপুরি সেন্সে আসে না।
-মা,মা রে।কই তুমি......
ঘোরে মাকে খুঁজতে থাকে ভিনা।যাবির এক হাত দিয়ে ভিনাকে জড়িয়ে রাখে,আরেক হাত দিয়ে ভিনার হাত ধরে।
-সব ঠিক হয়ে যাবে।কথা দিচ্ছি,সব ঠিক করে দিবো....
যাবির আস্তে করে পকেট থেকে মোবাইল বের করে নওমির হাতে দেয়।
-নওমি,লক টা খুলো,6738
-এরপর দেখো কন্ট্যাক্টস এ,তানভির নামে একটা নাম্বার আছে, কল করে লাউড স্পিকারে দাও।
নওমি দ্রুত কল করে লাউড স্পিকারে দিলো।
-হ্যালো?যাবির
-তানভির,ভাই তোর একটা হেল্প লাগবে রে।
-হ্যাঁ, বল বল
-আমি একটা মেয়েকে নিয়ে আসছি মেডিকেলে এখনি।এসে সব বলছি,তুই একটা বেডের ব্যবস্থা করে রাখিস।
-আচ্ছা,আমি দেখছি কী করা যায়,তুই আয়।
তানভির যাবিরের ছোটবেলার ফ্রেন্ড।তানভির এখন মেডিকেলে পড়াশোনা করছে,যাবির আইবিএতে।তানভির সবে সেকেন্ড ইয়ারে, হয়ত খুব একটা ইনিশিয়েটিভ কিছু করতে পারবে না,কিন্তু ছেলেটা দায়িত্বশীল,একটা ব্যবস্থা করবেই।
যাবির ভুল ছিলো না।তানভির এত ভীড়ের মাঝেও ওর এক পরিচিত সিনিয়রকে এনে রেখেছে।একটা বেডের ও ব্যবস্থা করেছে।ডাক্তার সব পরীক্ষা করে, এরপর কিছু ঔষুধ লিখে দিলেন।যেহেতু আগে বমি হয়েছেই তাই খুব ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু কী ধরনের ঔষুধ খেয়েছে এবং এর সাইড এফেক্ট সব বোঝার জন্যই ব্লাড টেস্ট দিলেন।ভিনার ততক্ষণে জ্ঞান ফিরেছে, নিজেকে হস্পিটালে দেখে হকচকিয়ে গেছে।নওমি বেশিক্ষণ থাকতে পারলো না,বাসা থেকে অনবরত ফোন দেয়ায় চলে গেলো।যাওয়ার আগে যাবিরকে রিকোয়েস্ট করলো থাকার জন্য।যাবির মাথা নাড়িয়ে চলে যেতে বললো নওমিকে।নার্স এসে ব্লাড নিয়ে গেলো,এরপর কেটে যাওয়া জায়গায় ঔষুধ দিলো।চারটা সেলাই পড়লো ভিনার হাতে। ভিনা দাঁত মুখ চেপে রাখলো সেলাইয়ের সময়,চোখ থেকে পানি পড়ছে।যাবিরের কেন যেন মনে হলো ভিনা ব্যাথার জন্য কাঁদছে না,ওর মাকে মনে করে কাঁদছে।
যাবির আস্তে করে মাথায় হাত রাখলো,চাপা কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলো।দুইদিনের পরিচয়েই মেয়েটার প্রতি মায়া জন্মে গেছে যাবিরের।তার বাবা মারা যাওয়ার জন্য নিজেকে সবচেয়ে অভাগা ভাবতো সে।কিন্তু যার মা নেই,আর বাবা থেকেও নেই তার কষ্ট অনুভব করে মনটা ভারী হয়ে গেলো।একে তো এই বয়সটাই দ্বন্দ্বের,এর উপর মাঝরাস্তায় একা হয়ে যাওয়ায় মেয়েটা অকূল পাথারে পড়ে গেছে, আর একা মেয়ের জন্য পৃথিবীটা যে হাজারগুণ কঠিন!
সেলাইয়ের পর নার্স স্যালাইন লাগাতে চাইলে, ভিনা মানা করে দিলো।তার বাসায় যেতে হবে।
-স্যালাইন টা জরুরি, তোমার শরীর অনেক দূর্বল।
-স্যালাইন শেষ হতে সময় লাগবে,আমার জলদি বাসায় যেতে হবে।
-তোমার বাবাকে ফোন দাও।
-না,বাবাকে আনার দরকার নেই।
-এসব ক্ষেত্রে গার্জিয়ান দরকার হয় ভিনা।
-আমার গার্জিয়ান এর দরকার নেই।
-জিদ করো না,আই রিকোয়েস্ট।
-বাবা যদি জানে আমি সুইসাইড এটেম্পট করেছি,বাসায় ঝামেলা হবে।
-জানোই যখন, করেছো কেন।
-বোকা যে,তাই।মেডিসিনে মানুষ মারা যায় না,সেটা আগেই ভাবা উচিৎ ছিলো।সুইসাইড এটেম্পট এর পর যারা বেঁচে যায়,তাদের যন্ত্রণা বেশি।বাবাকে বলে এই যন্ত্রণা বাড়াবেন না।
-ঠিক আছে।কিন্তু তোমাকে কিছু মেডিসিন দিয়েছে,এগুলা টাইমলি নিও। আর তোমার নাম্বার টা দাও।
-নাম্বার কেন?
-মেডিসিনের কথা মনে করিয়ে দিবো।আর খোঁজখবর নিবো।
-আমি নিজের খেয়াল রাখতে পারবো,আপনার দুশ্চিন্তার কিছু নেই।
-নাম্বারটা দাও, নাহলে তোমার বাবাকে খুঁজে বের করতে হবে।
ভিনা বুঝলো তর্ক করে লাভ নেই। তাই নাম্বার টা দিলো।
-ফোন যেন অন থাকে।
যাবিরের এ কথায় ভিনা প্রচন্ড বিরক্ত হলো,কারণ সে সত্যিই ফোন বন্ধ রাখার চিন্তা করছিলো।মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলেই সে উঠে দাঁড়ালো।যাবির সিএনজি করে ভিনাকে বাসার কাছে পৌঁছে দিলো,পুরো রাস্তায় ভিনা কোনো কথা বলেনি।নামিয়ে দেয়ার আগে যাবির ভিনার হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিলো।
-ইন্সট্যান্ট স্যুপ, স্যালাইন আর গ্লুকোজ আছে এতে,কষ্ট করে স্যুপ টা খেয়ে ঔষুধ খেয়ে নিও,বেশি খারাপ লাগলে স্যালাইন অথবা গ্লুকোজ খেয়ো।আর ফোন কাছেই রেখো।শরীর যদি বেশি খারাপ লাগে,যত রাতই হোক,ফোন দিতে দ্বিধা করো না।
ভিনা প্যাকেট টা হাতে নিয়েই দৌড়ে চলে গেলো।যাবির বুঝতে পারলো ভিনা হয়ত এত কেয়ার বহুদিন পায়নি,অতিরিক্ত কেয়ার ও মানুষ নিতে পারে না,মানুষ বড় অদ্ভুত।একি সিএনজি নিয়ে যাবির কোচিং এ গেলো,সবুজকে বলে অফিস খুলে ভিনার ব্যাগ খুঁজতে লাগলো........
.
.
.
চলবে................................................