অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ১৯ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


রুপিন ভিনার কাছে আসার আগেই সোহেলকে এই বিষয়ে জানিয়ে এসেছে।সোহেল আপত্তি করেনি।শুধু কষ্ট পেয়েছে এই কারণে যে মেয়েটা দিন দিন দূরত্ব বাড়িয়েই চলেছে।ভোরে ফজরের পর জানাযা শেষে দাফন এর কাজ শেষ হয়েছে আজিমপুর কবর স্থানে।গ্রামে এম্বুলেন্সে করে লাশ নিয়ে যাওয়া সময় আর খরচ সাপেক্ষ ব্যপার।এর জন্যই ঢাকাতেই দাফন করা হয়েছে,আর তাছাড়াও মৃত্যু বার্ষিকীতে তারেক যেয়ে জিয়ারত ও করতে পারবে।মৃত্যুর পর সন্তানের দোয়াই সবচেয়ে কাজে লাগে।নানাদিক বিবেচনায়ই এই সিদ্ধান্ত নেয়া।দাফন শেষে মুনা আর মায়ের বাড়িতে যায়নি,এবং সে এটা জানে যে এই বাড়িতে হয়ত আর যায়াও হবে না।বিশেষ করে তার মা এটা একটুও পছন্দ করবে না। আশ্রয়ের শেষ জায়গায় ও আর থাকলো না।ছোট থেকেই সে সব সময় সব ব্যাপারে স্যাক্রিফাইস করে এসেছে।নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে চাপিয়ে চলাই স্বাভাবিক,কিন্তু বড় মেয়ে আর শারীরিক ত্রুটির কারণে তাকে সবসময় অবহেলায় থাকতে হয়েছে।বিয়ের সময় এমন অবস্থা সম্পন্ন পরিবারের কথা শুনে তার খটকা লেগেছিলো, এরপর এ জানতে পারলো যে তার স্বামীর এটা দ্বিতীয় বিয়ে,শুধু তাই না,ঘরে সেয়ানা মেয়েও আছে।অবশ্য এমন কিছুই সে আশা করেছিলো,তাই খুব বেশি কষ্ট পায়নি।শুধু একটাই আশা ছিলো,স্বামীর নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আর কেয়ার সে পাবে,কিন্তু তাও হলো না।বিয়ের আগে ভিনার সাথে এমন বিমাতা সুলভ আচরণ করার কোনো উদ্দেশ্য তার ছিলো না,বরং সন্তান যেহেতু হবে না,তাই ভিনাকে নিয়েই সে স্বাভাবিক সংসার জীবনের পরিকল্পনা করেছিলো।তার ধারণা ছিলো না যে সোহেল আর ভিনার থেকে সে এমন আচরণ পাবে।সতেরো বছরের মেয়ের বাবার বিয়ে হচ্ছে,মেয়ে যে খুবই ছোট তা কিন্তু না।সে চাইলেই জানাতে পারত যে বাবার দ্বিতীয় বিয়েতে তার মত নেই,সোহেলের মত মানুষ অবশ্যই মেয়ের কথা ফেলত না।তা না করে বিয়ের পর অভিমান করে ভিনা নিজেও কষ্টে আছে,তার সংসারও আর করতে দিচ্ছে না।ভাবতেই নিজেকে খুব ছোট লাগছে যে,টিন এজার এক মেয়ের মন মর্জিতে তার পুরো জীবন নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।গাড়িতে পুরো সময় জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে এসব ভাবছিলো মুনা।সোহেল মুনার দিকে তাকাতেই খুব মায়া হলো।আসলেই তো,মুনার কোনো দোষ নেই,কিন্তু শাস্তি তাকে পেতেই হচ্ছে।আচ্ছা,সে কি একটু চেষ্টা করবে জীবন টাকে নতুন করে সাজানোর?


সকাল সোয়া সাতটার দিকে রুপিন চলে যায় নিজের বাসায়,যাওয়ার আগে কথা দেয়,সে ভিনার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখবে।আর কিছুক্ষণ পরই মোমেনা খালা এসে পড়বে,তাই চিন্তার কিছু নেই। রুপিন যাওয়ার পরই মোবাইল নিয়ে বসে সে।যাবিরের মেসেজ সবার আগে ওপেন করে পড়ে।

"শুভ জন্মদিন ভিনা।তোমার জীবন সুন্দর হোক,ঠিক যেমনটা তুমি চাও"

"কী ব্যাপার?সমস্যা হয়েছে কোনো?"

"মনে হয় ঘুমিয়ে গেছো,আমার এক্সাম, আমি জেগে আছি,ঘুম ভাঙলে ফোন দিও"

"পরীক্ষা দিতে গেলাম,দুপুরের দিকে কিন্তু নওমির সাথে এসে পড়ো"

ভিনা জানে না এই সম্পর্ককে কী নাম দেয়া যায়।বন্ধুত্ব? নাকি প্রেম?কখনো তো কিছুই বলা হয়নি।নাম না জানা সম্পর্ককে কি তাহলে শুধু ভালোবাসার সম্পর্ক নাম দেয়া যায়?যাবির বলেছিলো,অজানার নাকি আলাদা সৌন্দর্য আছে।সেই সৌন্দর্যকে নষ্ট করে কোনো লাভ নেই।থাকুক এমন,বছরের পর বছর....


দুপুরের দিকে সোহেল আর মুনা বাসায় আসলো।মোমেনা আগেই রান্না করে রেখেছিলো।মুনার খাওয়ার মত অবস্থা ছিলো না,তাই যেয়েই বিছানায় শুয়ে পড়ে।সোহেল অল্প একটু ভাত খেয়ে এক ঘন্টা বিশ্রাম নিয়ে বের হয়ে যায় কাজে।ভিনা জানে যে আজকে জন্মদিন পালনের মত অবস্থা নেই,কিন্তু ওর কষ্ট লাগছে যে তার বাবার মনেই নেই।অন্তত উইশ সে করতেই পারত।নওমি ফোন দেয়ায় ভিনা নিচে নেমে আসলো।যাওয়ার সময় মোমেনা খালাকে বলে গেলো যে, ঘুম থেকে উঠলে যেন মুনাকে খাবার দিয়ে দেয়।রেস্টুরেন্টে যাওয়ার আগেই ভিনা জানিয়ে দেয় সে সেলিব্রেট করবে না।

-তুই সেলিব্রেট করবি না কেন?

-মুনার বাবা কালকে মারা গেছে।

-কী বলিস!

-হুম,এর জন্যই বাসায় একটা থমথমে পরিবেশ বাসায়।আমারো মন তেমন একটা ভালো নেই।তাই খেয়েই চলে আসবো।

-যেটা ভালো মনে করিস,আমার কোনো সমস্যা নেই। 

রেস্টুরেন্টের একটা ছোট কর্ণারে সুন্দর করে বেলুন দিয়ে সাজানো।যাবির হাসিমুখে ভিনাকে স্বাগত জানালো।

-ওয়েলকাল বার্থডে গার্ল!

-থ্যাংকিউ

-কী ব্যাপার,বার্থডে গার্লের মুখটা মলিন কেন?

তখন নওমি সব খুলে বলার পর যাবির বললো

-এক কাজ করো,আমি আর ভিনা খাবার প্যাক করে নিয়ে যাই।আমাদের হয়ে তোমরা বার্থডে সেলিব্রেট করো।

ভিনা মানা করলো না।নওমি প্রথমে জোড়াজুড়ি করলেও পরে রাজি হয়ে গেলো।তানভির সুন্দর একটা ঘড়ি আর নওমি এক জোড়া কানের দুল গিফট করলো।ভিনা গিফট আর খাবার নিয়ে বের হয়ে গেলো।এর পেছনে আরেকটা কারণ ও আছে,সে চাচ্ছে নওমি আর তানভির কিছুটা সময় কাটাক একসাথে।একা একা তানভিরের সাথে দেখা নওমি করবে না,যাবির ও মনে হয় একথাটা বুঝেছে,তাই কিছু বলেও নেই।রাস্তায় এক বক্স খাবার এক ছোট বাচ্চাকে দিয়ে আরেক বক্স রেখে দিলো যাবিরের জন্য।

-তুমি খাবে না?

-আমাকে না দিয়ে খাবে?

যাবির মনে মনে খুব খুশি হলো।ধানমন্ডি লেকের এক জায়গায় বসলো তারা।

-তোমার জন্য আলাদা কোনো গিফট আনিনি। 

-তাতে কী হয়েছে?

-যাই হোক,কিন্তু গিফট তোমার পাওনা থাকলো।আমার বিশ্বাস সেটা তোমার পছন্দ ও হবে।

-তাই?

-প্রমিস!

এরপর দুইজন মিলে শেয়ার করে খাওয়া শুরু করলো,যাবির খেয়াল করলো আজকে তাদের মাঝে চার আঙ্গুলের দূরত্বটা আর নেই......
.
.
.
চলবে..............................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন