অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ০৮ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


একজন মহিলা দৌঁড়াচ্ছে,প্রচন্ড পিপাসা লেগেছে তার,কিন্তু পিছে কেউ তাকে তাড়া করে যাচ্ছে। সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে,বেগুনি শাড়ির রঙ হটাৎ সাদা হয়ে যায়।মহিলাটা ছটফট করতে থাকে,কেউ তার বুকের বা পাশে ছুড়ি বসিয়ে দেয়,অনবরত ছুড়ি চালাতে থাকে,একসময় সে মারা যায়,সাথে সাথে রক্ত দিয়ে চারপাশ ভরে যেতে থাকে,হাঁটু সমান রক্তের মাঝে এক নৌকায় ছোট একটা মেয়ে বসা,সে মারা যাওয়া মহিলাটার কাছে যেতে চাচ্ছে,পারছে না।

ভিনার ঘুম ভেঙে যায়,পুরো শরীর ঘামে ভিজে গেছে।পানি খাওয়ার জন্য বোতল না পেয়ে নিচে নেমে আসে।পানি খাওয়ার পর ও অস্থিরতা কমছে না।এমন স্বপ্ন দেখার মানে কী?পুরো হাতে ব্যথা করছে,সেলাইর জায়গাগুলো বেশি।মানুষের যখন শরীর খারাপ থাকে অথবা প্রচন্ড মানসিক চাপে থাকে,তখন দুঃস্বপ্ন দেখে।আগে শুধু পরীক্ষার আগে দুঃস্বপ্ন দেখতো।পরীক্ষার সময়ে রাতে মা তার সাথে ঘুমাতো,স্বপ্নে ছটফট করতে থাকলে মা ই ঘুম ভাঙিয়ে বুকে টেনে নিত।সব ভেবে ভিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।বয়স কতই বা তার?এখনি এত বাস্তবতা দেখে ফেলছে,আর সামনে কী করবে?

উপরে উঠে মাস্টার বেডের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ভিনা অদ্ভুত শব্দ পেলো,কিসের শব্দ বুঝতে পেরে ঘৃণায় গা গুলিয়ে আসলো।মধ্যবয়সী এক মহিলা সেক্সের সময় এমন বিশ্রী শব্দ করতে পারে,ভাবতেই পারছে না সে।তার বাবা মা র সময়ে তো কখনো,ভুলেও এমন বাজে সিচুয়েশন ফেস করতে হয়নি।দাদী বিয়ে করানোর জন্য আর কাউকে পেলো না!মুনার চেয়ে বেশি নিজের বাবার উপর ঘৃণা লাগছে।পুরো হাতের জায়গায় ব্যান্ডেজ নিয়ে ব্যাথায় ঘুম আসছে না ওর,এদিকে তার বাবা অন্য মহিলার সাথে মেতে আছে বিছানায়।অবশ্য তার বাবা জানেও না যে ভিনা এত বড় ব্যাথা পেয়েছে,সেদিনের ঝগড়ার পর থেকে মুনা সন্ধ্যায় দরজা খোলাই রাখে,ভিনার মুখোমুখি হয় না।সিড়ি দিয়ে উপরে উঠার সময় মুনা শুধু বলেছিলো যে সে বাইরে যাবে তার বাবার সাথে।ভিনা কিছু না বলে উপরে এসে দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে গেছে।


মুনার একটু খারাপ লাগছে। সে পেছন থেকে দেখেছে ভিনার হাতে ব্যান্ডেজ করা।কিন্তু না কিছুই বলেনি।আজকে যদি আবার সোহেল এই অজুহাতে বাইরে যাওয়াটা ক্যান্সেল করে দেয়?বিয়ের পর এই প্রথম মুনাকে নিয়ে বাইরে যাচ্ছে সে,বিয়ের পর সেভাবে সোহেলের একান্ত সময় কাটানোই হয়নি।সে গুনে বলে দিতে পারবে,বিয়ের পর এখন পর্যন্ত কয়বার সোহেল তার সাথে শুয়েছে।এরকম জীবন তো সে চায়নি।চাহিদা থেকে না,ভালোবাসা থেকে অন্তরঙ্গতা আসুক,খুনসুটি হোক,শেষ বিকেলে কেউ অধীর আগ্রহে তার জীবনের গল্প শুনুক,কষ্ট গুলো ভাগাভাগি করুক,এটা কী খুব বড় চাওয়া?রেস্টুরেন্টে ডিনারের সময় ও কোনো কথা বলেনি সোহেল। বাসায় এসে মুনা একটা মুভি দেখতে চেয়েছে,এডাল্ট মুভি। সোহেল শুরু থেকে দায়সারা ভাবে দেখলেও সেক্সের সিনে সে ভালো লাগছে না বলে বিছানা থেকে উঠে ওয়াশরুমে চলে যায়।মুনা চোখে পানি নিয়ে তাকিয়ে থাকে,আর সাউন্ড ইচ্ছে করেই বাড়িয়ে দেয়।কেন,সোহেল কেন বুঝে না তার কিছু আশা আকাঙ্ক্ষা আছে,মা হতে পারবে না দেখে কী স্ত্রীর সাথে পতিতাদের মত ব্যবহার করতে হবে?মুনা কিছুক্ষণ পর ল্যাপটপ বন্ধ করে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে। সোহেল সিগারেট হাতে ছাদে চলে যায়।
শিউলি তার জীবনের প্রথম এবং শেষ প্রেম।প্রেমের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়,যখন ভার্সিটিতে টিফিন বক্সে শিউলি খাবার নিয়ে আসত।বিয়ের পর ও সোহেলকে খায়ানোর সময় একটা টিফিন বক্সেই খাবার নিয়ে বসত।শিউলি কখনো বউ হওয়ার জন্য আলাদা কোনো বোঝা চাপিয়ে দেয়নি। দুঃসময়ে কখনো হাত ছাড়েনি।মন খারাপ হলে জোর করেনি কিছু করার জন্য।আগের মতই গান শুনাতো,কবিতা শুনাতো। বউ এর আলাদা অধিকার সে কখনোই সোহেলের উপর ফলায়নি।যার কারণে সোহেল স্বেচ্ছায় এবং তৃপ্তি নিয়েই সব দায়িত্ব পালন করত। যাদের মানসিকতায় মিল থাকে,তাদের আর আলাদা করে কিছুই করা লাগে না,সম্পর্কের নাম আর ধরন বদলালেও সম্পয়র্ক বদলায় না।মুনার সাথে এই সম্পর্ক সে কখনো আগাত না।শিউলির সাথে বিয়ের পর তার মা অনেক কষ্ট পেয়েছে,চোখের পানি ফেলেছে,অপমান সহ্য করেছে। তাই দ্বিতীয়বার আর কষ্ট দেয়ার সাহস করেনি। প্রতিদিন মুনা আর ভিনার দ্বন্দ্ব দেখে সোহেল অতিষ্ঠ হয়ে গেছে।অনিচ্ছা নিয়েই মুনার সাথে স্বাভাবিক একটা সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করছে।যদি এ কারণে মুনা ভিনার সাথে মাতৃসুলভ আচরণ করে আর তাদের মাঝের দ্বন্দ্ব দূর হয়ে যায়।ভিনার সাথে যে অদৃশ্য দেয়াল তৈরি হয়েছে,সেটা ভাঙার জন্যই এগুলো প্রয়োজন।নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয় যখন সে টের পায় দ্বিতীয় বিয়ের জন্য ভিনা প্রচন্ড কষ্টে আছে।যে মেয়েকে বুকে না নিয়ে ঘুম আসত না,সে মেয়েকে এখন তার প্রতিদিন দেখাও হয় না। প্রচন্ড আত্মঅনুশোচনা নিয়ে মাথায় হাত ও বুলিয়ে দেয়া হয় না।সিগারেট শেষ হয়ে গেলেও তার ভাবনা শেষ হয় না।


ভিনা শোয়ার আগে দেখলো তেতাল্লিশটা মিসকল।চেক করে দেখে উনিশটা নওমির,বাকি গুলো এক আননোন নাম্বার থেকে।এটা যে যাবিরের, বুঝতে বাকী থাকে না। ফোন চেক করে দেখে আটটা মেসেজ ও রয়েছে।

"ভিনা, আমাকে ফোন দিস,আমার চিন্তা হচ্ছে"

"তুই কোথায়,আবার কিছু করিস নি তো?"

"ফোন ধর জানোয়ার!"

এই তিনটা নওমির পাঠানো।এবার আননোন নাম্বার থেকে আসা মেসেজ চেক করলো 

"স্যুপ খেয়ে ঔষুধ খেয়ে আমাকে জানাও"

"ঔষুধ টা নিয়েছো?এন্টিবায়োটিক কিন্তু"

"রিপ্লাই দিলে ভালো হত,আমি টেনশন ফ্রি হতাম।"

"উল্টাপাল্টা কিছু করো না ভিনা,ফোন ধরো, কথা বলো আমার সাথে।"

"আমি নিচে আসছি,কিন্তু তুমি কোন ফ্লোরে থাকো আমি জানি না।যদি মেসেজ দেখে থাকো,প্লিজ নিচে তাকিয়ে জানাও যে তুমি ঠিক আছো"

লাস্ট মেসেজ পরে ভিনা ব্ল্যাংক হয়ে গেলো।মেসেজটা সাতান্ন মিনিট আগের,তার মানে যাবির নিচে দাঁড়ানো!.....
.
.
.
চলবে..............................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন