অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ২৩ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


আজকে থেকে ভিনার কলেজ শুরু হলো।কম্বাইন্ড কলেজ, বাসা থেকে হেঁটেই যাওয়া যায়।এমন কলেজে ভর্তি হওয়ার কারণ হলো সে বেশি সময় বাসায় থাকবে,আর পড়ায় মন দিবে।আর্টস নেয়ার সময় সোহেল অনেক অবাক হয়েছিলেন।

-তুমি সত্যিই আর্টস নিচ্ছো?

-হ্যাঁ 

-কিন্তু আমি তো ভেবেছি,তুমি সাইন্সেই পড়বে। 

-এখন পড়বো না।

-দেখো ভিনা,পার্সোনাল লাইফের সমস্যাকে নিজের ক্যারিয়ারে প্রভাব ফেলতে দিও না।আমি জানি তুমি মেধাবী মেয়ে। এখন চেষ্টা করলেই খুব ব্রাইট একটা ভবিষ্যৎ হবে তোমার।

-কে বলেছে আর্টসে পড়লে ভালো কিছু হবে না?তুমি নিজেই সাইন্সে পড়ে এখন ব্যবসা করছো।কোনো সমস্যা তো হচ্ছে না।

মেয়ের যুক্তির কাছে পরাস্ত হয়ে চুপ করে গেলেন।তার মাথায় একটাই চিন্তা ঘুরছে,মুনার সাথে বিয়েটাকে খুব সিরিয়াসলি নিয়ে যেন নিজের ক্ষতি না করে।ভিনার প্রতিটা ভুল সিদ্ধান্তের জন্য কেন যেন ঘুরে ফিরে নিজেকেই দোষী মনে হয় সোহেলের।একটা মৃত্যু জীবনের সবকিছু এলোমেলো করে দিয়েছে।যে মানুষের সাথে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত থাকার কথা ছিলো,এখন তার ঘরেই আরেকজনকে নিয়ে থাকতে হচ্ছে,এমনই একজনকে, যাকে ছেড়ে যাওয়া সম্ভব না।ভাগ্য বড় নিষ্ঠুর। এই নিষ্ঠুরতা সে দেখায় জীবনের বড় প্রতিজ্ঞা আর পরিকল্পনাকে ঠিক বিপরীতমুখী করে।


কলেজের প্রথম দিনেই ব্যাগ নিয়ে কোণায় একদম লাস্ট সিটে বসেছে ভিনা।রুমে চারটা রো।দুইটা ছেলেদের,দুইটা মেয়েদের।সবাই বেশ গল্প গুজবে ব্যস্ত।স্কুল কলেজ একসাথে এখানে।বেশিরভাগ স্টুডেন্ট ই এই স্কুলের।তাই সবাই সবাইকে মোটামুটি চিনে জানে।

-এক্সকিউজ মি,তুমি প্লিজ পাশের রো তে যাবে?এটা ছেলেদের রো।

-শিওর।

-তুমি নতুন তাই না?

-হ্যাঁ। 

-কোন স্কুল?

ভিনা নাম বললো।

-তোমাদের ও না কলেজ আছে?

-হ্যাঁ, আছে।কিন্তু বাসার কাছে কলেজেই পড়তে চাচ্ছি।

-গ্রুপ কী?

-আর্টস। 

-স্যরি টু সে,তুমি রুমও ভুল করেছো।এটা সাইন্সের রুম।তবে এই রুমেও তুমি ক্লাস পাবে।জেনারেল সাব্জেক্ট গুলো এখানেই হবে,যেমন ইংলিশ বাংলা।

-আচ্ছা

-তোমার নামই জানা হয় নি,নাম কী তোমার?

-ভিনা ইনজামাম।তোমার নাম?

-ওয়াসিম রশিদ।

-নাইস টু মিট ইউ।

-এই,তোমার সিরিয়াল কত বলো তো

-কিসের সিরিয়াল?

-ভর্তি রিসিটে যে সিরিয়াল ছিলো,আপাতত কয়দিন ঐ অনুযায়ীই সিট এ্যরেঞ্জড হবে।

-৫৬

-৫৬?

সাথে সাথে ওয়াসিম দৌড়ে বাইরে চলে গেলো।কিছুক্ষণ পর চারজনের ছোট খাটো একটা গ্রুপ নিয়ে ঢুকলো। 

-আরশি,এইযে তোর পাশের মেয়ে।

গ্রুপ থেকে এলোমেলো চুলের বেশ লম্বা আর শ্যামলা একটা মেয়ে এগিয়ে এলো।মেয়েটার চেহারায় ক্লান্তির ছাপ,যেন খুব বড় ধকল গেছে। বেশ বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে বললো

-নতুন নাকি?

-হ্যাঁ। 

-দুই বছর গেলো আমার।নতুন কারো সাথে আলগা পিরিতি লাগাতে আমার ভালো লাগে না।বুঝি না এই কলেজের সমস্যা টা কী।নিজেদের স্কুলের গুলোকে কলেজে নিতে পারে না।

ভিনা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো।এই মেয়ের সাথে আগামী প্রায় দুই বছর থাকতে হবে ভেবেই গা শিউরে উঠছে।

-এসব কী আরশি?নতুন আসছে মেয়েটা,এখনি এত রুড হলে চলবে?

-এত দরদ ভালো না ওয়াসিম,ভালোমানুষি পরে দেখাইস।

ওয়াসিম আরশিকে আর কিছু বললো না।আরশিও সেখান থেকে চলে গেলো।

-তুমি মনে করো না কিছু,ও এমনই,কয়েকদিন পর ঠিক হয়ে যাবে।অন্যদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।

-হ্যাঁ অবশ্যই। 

ভিনা অতিকষ্টে নিজের হাসি দিয়ে কথাটা বললো।নওমির কথা ভীষণ মনে পড়ছে।আগে জানলে।কখনোই অন্য কলেজে ভর্তি হওয়ার চিন্তা সে করত না।

-ও হচ্ছে কথা।তার পাশে আবির,আর তার পাশে সাদ।কথা,আবির আর আমি সাইন্সে,সাদ কমার্স আর আরশি আর্টসে। আমাদের সাথে ক্লাস না হলেও তোমার দেখা হবে।আর আরশির কথায় কিছু মনে করো না।

তখনি কথা বললো

-আরশি খুব রাগী,কিন্তু যদি একবার ভালো সম্পর্ক করে ফেলতে পারো,ও তোমার জন্য জীবনটা দিয়ে দিবে।

তখনি ঘন্টা পরে যাওয়ায় কথা আর তেমন আগালো না।ভিনা ব্যাগ নিয়ে চুপচাপ বসে গেলো,আরশি ক্লাসে আসলো লেটে।টিচারের বকা খেয়ে রাগে লাল হয়ে সে ভিনার ব্যাগ নিচে নামিয়ে পাশে বসে পড়লো।ভিনা কিছুই বললো না।প্রথম দিনেই ঝামেলা লাগানোর কোনো দরকার নেই। শুধু বাসা কাছে হওয়াটা কারণ না,আগের স্কুলে গত কয়েক মাসে বেশ খারাপ একটা ইম্প্রেশন হয়েছে ওর,গার্জিয়ান আর মেয়েদের কথার মূল বিষয়ই থাকতো ভিনা।সেখানকার পরিবেশ বিষের মত লাগত ওর কাছে।এসব থেকে বেড়িয়ে সে একটা নতুন পরিচয় তৈরি করতে চাচ্ছে।যেভাবেই হোক এবার সে ধৈর্যের সাথে সব সিচুয়েশন হ্যান্ডেল করে আগের ভিনাকে ফিরিয়ে আনবে।ক্লাস ব্রেকের সময় আরশি চলে গেলে পেছন থেকে একটা মেয়ে এসে ভিনার পাশে বসে।

-নতুন তাই না?

-হুম

-ভাগ্যও বলতে হবে, এসেই আরশির পাশের সিট পেলা।তোমাকে দেখেই মায়া লাগছে,নাম কী তোমার?

-ভিনা

-সুন্দর,তুমি মনে হয় কথা কম বলো,কথা কম বলাই ভালো।আরশির সাথে নাইলে টিকতে পারবা না।

-কেন?সবাই ওকে ভয় পায় কেন?

-ভয়?সিরিয়াসলি?পাগল মেয়ে।ওকে কেউ ভয় পায় না।আসলে কেউ ওকে পছন্দ করে না।থার্ড ক্লাস একটা মেয়ে।দুনিয়ার বয়ফ্রেন্ড ওর।একটা ধরে একটা ছাড়ে।আছো তো দুই বছর সামনে,সব কাহিনী শুনতে পারবা।

ভিনা ঢোক গিললো,আরশির কথা শুনে না,মেয়েটার বর্ণনার ধার দেখে। এই মেয়ের কানে কারো উল্টাপাল্টা খবর আসলে,তার জীবন শেষ। সে মরে গেলেও কোনো মানুষের কাছে ভালো হতে পারবে না।

টিফিন টাইমে কথা আর আবির আসলো ভিনার কাছে-

-ক্যান্টিনে যাবা?

-হ্যাঁ চলো।

ভিনা ক্যান্টিন যাওয়ার সময় কথা আর আবির খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব চিনিয়ে দিলো।এরপর ক্যান্টিনে সাদের সাথে দেখা হলো।সাদ গ্রুপ টাকে দেখে বেশ অবাক।

-ওয়াসিম তোদের সাথে নেই?

-না তো,কেন?

-আমি তো ভাবছিলাম তোদের সাথে।

-ও এসে পড়বে নে।চিন্তা করিস না।

টিফিন কিনে সবাই মাঠে গোল হয়ে বসলো।এরপর যার যার স্কুলের কাহিনী শোনানো শুরু করলো।ভিনা অবাক হয়ে শুনছে সব।ওর খুব ভালো লাগছে,নতুন মানুষদের কাছে এতটাও আন্তরিকতা আশা করেনি সে। টিফিন শেষের ঘন্টা পড়ার পর ও ওয়াসিম আসলো না।ক্লাসের জন্য যাওয়ার সময় কোথা থেকে যেন ওয়াসিম এসে বললো

-দেখলি!আরশি প্রথম দিনেই কলেজ বাঙ্ক দিয়েছে!
.
.
.
চলবে..............................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন