দশ তালা এই বাড়ির প্রতি ফ্লোরে দুটো করে ইউনিট।আট আর নয় তালায় মোট চারটি ফ্ল্যাট কিনে ডুপ্লেক্স বাসায় থাকে তারা।রাত বারোটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত এই বিল্ডিং এর লিফট বন্ধ থাকে।যাবিরের মেসেজ পাওয়ার পর তড়ি ঘড়ি করে দৌঁড়িয়ে নামতে থাকে ভিনা।বিল্ডিং এর দাঁড়োয়ান সিদ্দিক চাচা ছোট থেকে ভিনাকে চিনে,স্নেহ ও করে।মাঝ রাতে এভাবে ভিনাকে দেখে আধো আধো ঘুমে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে।
-চাচা,জলদি মেইন গেটের চাবিটা দিন,জলদি!!
-এত রাইতে এমনে দৌঁড়াইতেসো ক্যান মা?
-চাচা এত কথার সময় নাই,চাবি দেন।
-কারো অসুখ হইসে?
-না রে চাচা!আপনি আমাকে দেন চাবি,আপনার আসা লাগবে না,আমি যাবো আর আসবো।আপনি চাবি দেন
সিদ্দিক চাচা চাবি দিলেন আর বলে দিলেন সবচেয়ে বড়টাই গেটের।ভিনা হাপিয়ে গিয়ে রাস্তায় খুঁজতে লাগলো যাবির কে,কোথায় গেলো ছেলেটা!আচমকা কেউ হাত রাখে কাঁধে,ভিনা ভয়ে পেয়ে পেছনে তাকায়...
যাবির!
-আপনি এখানে কেন এসেছেন?বলেন তো।
-আসতেই হলো,বলেছিলাম ফোন অন রাখতে, তা তো রেখেছো,কিন্তু ফোন ধরে কথা বলতে বলিনি,তাই বলোও নেই,কত বাধ্য মেয়ে তুমি,আমি তো অভিভূত!
-স্যরি.....আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
-তার মানে ঔষুধ ও খাওনি,তাই না?
-খেলেও কী না খেলেও কী...
-অনেক কিছু।
ভিনা কিছুটা বিরক্তি নিয়ে যাবিরের দিকে তাকালো।যাবির এই চাহনি কে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে কথা চালিয়ে গেলো।
-এখন কয়টা বাজে?
-জানি না তো,ঘড়ি নেই।
-খুব সম্ভবত পৌনে চারটা বাজে,ভোর হয়ে যাবে এক ঘন্টা পর,ভোর দেখবে?
ভিনা নিশ্চুপ থেকে উত্তর দিলো,
-দেখবো।
যাবির মুচকি হাসি দিয়ে হাঁটা শুরু করলো,দুই হাত পকেটে। ভিনা যাবিরের পাশে অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটতে লাগলো,সে নিজেও জানে না কেন এই মাঝরাতে একজন প্রায় অপরিচিত মানুষের সাথে রাস্তায় হাঁটছে। হয়ত চেনা মানুষের থেকে কষ্ট পেয়ে ভরসাটাই উঠে গেছে। হাঁটতে হাঁটতে কলোনিতে ঢুকে গেলো যাবির।ভিনা অবাক হলো,কারণ কলোনিতে মাঝরাতে অপরিচিত কেউ ঢুকতে পারে না,সিকিউরিটি গার্ড পাহাড়ায় থাকে।
-আপনি কলোনিতে থাকেন?
-হুম,বাবা সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন,মারা গেছেন আগেই।কোয়াটারের বাসাটা বাবার কলিগের,উনি এখানে থাকেন না,তাই আমাদের থাকতে দিয়েছেন।
ভিনা মাথা নিচু করে হাঁটতে লাগলো।কী আশ্চর্য ব্যাপার,বাসার এত কাছে থেকেও কখনো দেখা হয়নি তার সাথে। পথ চলতে দেখে থাকলেও কে জানত কোনো একদিন মাঝরাতে এরা হাঁটবে!
-জানো ভিনা,জীবন না খুব অদ্ভুত, যখন আমার বাবা মারা যায়,আমি তখনি টের পাই,অন্য দশটা বাচ্চার মত আমার জীবনটা না।
-আপনার বাবা কবে মারা গেছেন?
-আমি যখন পাঁচ বছরের,তখন।
ভিনা যথাসম্ভব কম কথা বলছে।শুধু শুনে যাচ্ছে।যাবির ভিনার দিকে তাকিয়ে কথা আছে, মেয়েটা এর মায়াবি কেন?উশকো খুশকো চুল,চোখে হালকা কালি পড়া,ক্লান্ত চাহনি আর শুকনো ঠোঁটের মাঝেও যে এত মায়া কাজ করে,আগে জানা ছিলো না।কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলা শুরু করলো সে।
-বাবা মারা যাওয়ার পর আমার মা একদম বদলে যায়।খুব বদমেজাজি হয়ে যান উনি।আমি আমার মা কে কখনো হাসতে দেখিনি।তাই আমার জীবন টা ছোট থেকেই একদম রুক্ষ ছিলো। প্রয়োজন ছাড়া এখনো আমার মা আমার সাথে কথা বলে না।
যাবির তাকিয়ে দেখলো ভিনা তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
-আমি কি জানতে পারি,আমাকে এগুলো বলার কারণ?এগুলা একান্তই আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাই না?
- জানতে পারো,কারণ তোমার জানা দরকার ভিনা।তোমার ও তো মা নেই।
ভিনার হাত শক্ত হয়ে এলো।ধীরে ধীরে সব পরিষ্কার হলো,নওমি সেদিন তাহলে অফিসে এগুলো বলতেই গিয়েছিলো।
-আনইজি ফিল করো না।নওমিকে আমিই ফোর্স করেছিলাম,তোমাকে সুইসাইড এটেম্পট করতে দেখে।
-কবে দেখলেন?
-এইত,যেদিন আমাদের প্রথম দেখা হলো,সেদিন।
বিশেষণ শুনে ভিনার কেমন যেন লাগলো।আবার লজ্জাও লাগছে যে মাত্র দিনকয়েকের পরিচয়েই তাকে দুইবার সুইসাইড এটেম্পট নিতে দেখে ফেলেছে।
-দেখো ভিনা,তুমি তো তাও জীবনের অনেক খানি সময়ে মাকে পেয়েছো,আমি তাও পাইনি,এমনকি বাবার সাথের স্মৃতি গুলো আমার মনেও নেই।
-স্মৃতিগুলোর জন্যই যে আমার জীবনটা আরো কঠিন হয়েছে,সেটা কি জানেন?আপনার মা তো আর দ্বিতীয় বাবা ঘরে আনেনি।আনলেও খুব একটা যায় আসতো না,আপনি ছোট ছিলেন যথেষ্ট।
-জীবন কিন্তু চলেই যায়, থেমে থাকে না কারো জন্য।এই বয়ে যাওয়াকে আমরা সহজ করতে পারি ইচ্ছা করলে।তুমিও করো।অন্যের জন্য নিজেকে অবমূল্যায়ন করো না,জীবন তোমার থেকে যা কেড়ে নিয়েছে,সেটা যেভাবেই হোক ফেরৎ দিবে।সবার জীবনে সুখ দুঃখ সমান,সৃষ্টিকর্তা এতও নিষ্ঠুর না যে এক জনের জীবন সুখে ডুবে থাকবে,আরেকজনের বেঁচে থাকাটাই কষ্টকর হয়ে যাবে,কথাটা মনে রেখো।
-হুম...চেষ্টা করবো।
-করতে হবে,এত সহজে হার মানলে চলবে না,এত যত্ন করে পৃথিবীতে তোমাকে পাঠানো হয়েছে,না দেখেই চলে যাবে?
-নিরুপায় না হলে কেউ যেতে চায় না।
-নিরুপায় কেন?শুধু বেঁচে থাকাই একটা কারণ হওয়া উচিৎ বেঁচে থাকার।সময় দেখতে দেখতে চলে যায়।তাকিয়ে দেখো,ভোর হচ্ছে।
দুইজন হাঁটতে হাঁটতে কলোনির পুকুর পাড়ে এসে পড়েছে।পুকুরের চারপাশ বাঁধানো,বাঁধানো জায়গায় দুইজন বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।
-উপায় খুঁজে নিতে হয়,প্রতিদিন এই সুন্দর ভোর দেখাকেই একটা উপায় করে নাও,দেখবে চোখের পলকে জীবন পার হয়ে গেছে।
-হুম...হয়ত
-হয়ত না।
পকেট থেকে যাবির মোবাইল বের করলো।
-এখন সোয়া পাঁচটা বাজে।আমি সামান্য মিথ্যা বলেছিলাম,তখন পৌনে চারটা না,পৌনে তিনটা বেজেছিলো।কথা খুব বেশি আমরা বলিনি, কিন্তু দেখো,আড়াই ঘন্টা কীভাবে কেটে গেছে,এভাবেই জীবন টা কাটিয়ে দাও।
ভিনা অনেক্ষণ যাবিরের দিকে তাকিয়ে রইলো।কেউ কোনো কথা বলছে না,তবুও বিন্দুমাত্র বিরক্তি কাজ করছে না। আস্তে আস্তে হেঁটে হেঁটে ভিনাকে বাসা পর্যন্ত পৌছে দিলো যাবির। উপর থেকে মুনা দেখলো সব।
ভিনা রুমে ঢুকে দরজা আবার বন্ধ করে দিলো,একটা গান মাথায় বাজছে,
"তুমি চেয়ে আছো তাই,আমি পথে হেঁটে যাই,হেঁটে হেঁটে বহুদূর,বহুদূর যেতে চাই..."
.
.
.
চলবে..............................................