সোহেল টান দিয়ে মুনাকে বসা থেকে উঠালেন।
-আমার মেয়েটার হাতে ব্যান্ডেজ ছিলো,তুমি দেখোনি?
-আমি খেয়াল করিনি
-একটা মানুষ তোমার সামনে দিয়ে হেঁটে বাসায় আসলো আর তুমি খেয়াল করোনি?এমনি দিন তো ও ঘরে ঢোকা মাত্র ছোট থেকে ছোট জিনিস খেয়াল করে কম্পলিন দাও,এমনকি ওর ঘরে যেয়ে হলেও তদারকি করো,কালকে কী হয়েছিলো?
-তোমার মেয়ে কি বোবা?বাসায় এসে জানাতে পারত না?সব আমারই বুঝে নিতে কেন হবে?
-সব তুমি বুঝো?বুঝো শুধু দোষ গুলো।মেয়েটা সারারাত কষ্ট করেছে!
মুনা কালকের ভিনার বের হয়ে যাওয়ার ঘটনা বলতে যেয়েও বললো না।এই মুহূর্তে এগুলো বললেও সোহেল বিশ্বাস করবে না,মেয়েকে কিছুই বলবে না।সে চুপ করে রইলো।
-তুমি শুধু স্ত্রীর অধিকারের জন্য পাগল হয়ে আছো।মনে রেখো তোমাকে বিয়ে করে আনা হয়েছে আমার মেয়ের জন্য।ওর জন্যই এই ঘরে তোমার জায়গা হয়েছে।মায়ের দায়িত্ব পালন না করলে স্ত্রীর অধিকার চাইতে আসবা না।
-আমার প্রতি কি তোমার কোনো অনুভূতিই কাজ করে না?শুধু মেয়ের দেখাশোনার জন্যই আমাকে বিয়ে করে এনেছো?তাহলে একজন ন্যানি রাখলেই পারতে তোমার আদরের দুলালির জন্য!
-বেশি বাড়াবাড়ি করো না মুনা,আমি তাহলে তোমার বয়স্ক বাবার লেহাজ করবো না,ডিভোর্স দিতে বাধ্য হবো।
কথাটা তীরের মত মুনার বুকে লাগলো।তাহলে কী শুধুই চাপিয়ে দেয়া সম্পর্ক কে দায়সারা ভাবে মেনে নিয়েছে সোহেল?নিজেকে খুবই ছোট লাগছে, শারীরিক ত্রুটির জন্য তাকে অনুভূতিহীন প্রাণির মত ট্রিট করছে সবাই।সামান্য ভালোবাসা,সেটাও পর্যন্ত তার ভাগ্যে নেই।প্রথমে পরিবারের দায়িত্ব পালন করত,এখন সংসারের।শুধু দায়িত্ব আর দায়িত্ব, ভালোবাসা নেই কোথাও।
•
ভিনা ঘুম থেকে উঠে মোবাইল খুঁজতে লাগলো।মোবাইল নিয়েই সে মেসেজ আর ফোন লিস্ট চেক করলো।যাবিরের মেসেজ দেখে মনের অজান্তেই একটা ভালো লাগা কাজ করে তার।
"আজকে কিন্তু ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।কোচিং এ আসার দরকার নেই,রেস্ট নাও।বিকালে পারলে বের হয়ো।আমি অপেক্ষা করবো।"
মনে খচখচ লাগছে ভিনার। কতগুলো টাকা বিল হলো কে জানে।সে স্টুডেন্ট মানুষ, না জানি কীভাবে ম্যানেজ করছে।এবার রাগ ফেলেই টাকা চাইতে হবে,উপায় নেই।রুম থেকে বের হয়ে বাবার রুমে যেতেই মুনা বললো
-ভিনা দাঁড়াও,কথা আছে
-বলুন।
-তোমার বাবা এই খামটা তোমাকে দিতে বলেছে।
-কিসের খাম?
-খুলে দেখিনি।
-আচ্ছা ঠিক আছে।থ্যাঙ্কিউ।
-তোমার হাতের অবস্থা কেমন?
-আগের চেয়ে ভালো।
মুনা আর কিছু বললো না,রুমে চলে গিয়ে দরজা ভিড়িয়ে দিলো।ভিনা রুমে এসে খাম খুলে দেখলো দশটা এক হাজার,ছয়টা পাঁচশ,পাঁচটা একশ আর কিছু খুচরো টাকা দেয়া খামের ভেতর। মোট চৌদ্দ হাজার টাকা।
সাথে ছোট একটা চিরকুট,তাতে লেখা
"আমি এখনো তোমার বাবা।এখনো তোমায় ভালোবাসি।অন্তত তোমার মায়ের মত তুমি দূরে সরে যেয়ো না।"
ভিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় বসে পড়লো।কালকে রাতে যা হলো ভুলতে পারছে না।তার দিকে নজর দিচ্ছে না এটা যতটা না কষ্ট দিচ্ছে,অন্য মহিলার সাথে মায়ের বিছানা টা ভাগাভাগি করায় বেশি কষ্ট হচ্ছে।টিন এজার মেয়ের সামনে এসব ঘটনা ঘটলে যে কী পরিমাণ যন্ত্রণা হয়,সেটার ব্যখ্যা দেয়া সম্ভব না।সব চিন্তা বাদ দিয়ে ভিনা নওমিকে ফোন দিলো। নওমি শরীরের খোঁজখবর নেয়ার পর জানালো যে নেক্সট উইক এর মাঝামাঝি তে রেজাল্ট দিবে খুব সম্ভবত।
রেজাল্ট!হাহ্.......
•
যাবির সকালের নাস্তা রেডি করে নিজের মা কে ডাক দিলো।সাহরা খাতুন ধীরে ধীরে টেবিলে এসে বসলেন।
-ক্লাস কেমন চলছে?
-ভালো মা,ডিম দিবো?
-দাও,কুসুম ছাড়া দিও।
-কুসুম আলাদা করেই রেখেছি।
-টিউশনি তে যাও নি যে?
-একটু সমস্যা হয়েছিলো।
যাবির এর সাথে তার মার সারাদিনে দুইবার কথা হয়।সকালের নাস্তায় আর রাতের ডিনারে।এছাড়া কখনোই উনি কথা বলেন না,এমনকি যাবিরের রুমে উঁকিও দেন না।কিন্তু একটা জিনিস ভেবে যাবির অবাক হয় যে তার মা সব খেয়াল করে। সে যে কালকে টিউশনিতে যায়নি,এটাও খেয়াল করেছেন উনি।যাবিরের জন্য এটাই অনেক বেশি।জীবনের কাছে খুব বেশি চাওয়া পাওয়া নেই তার। আচ্ছা ভিনা কি এই কেয়ারটুকু পায় না?কে জানে।সব কথায় ভিনা আসছে কেন।আজব।
•
রুশান মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে কোচিং এর বাইরে।আজকে ভিনা আসে নি।ভিনাকে কেন যেন ওর অনেক ভালো লাগে। অন্য সবার চেয়ে আলাদা।কম কথা বলে,বই পড়ে,আবার লেখেও মনে হয়।একদিন কোচিং এ স্যার আসতে দেরী করেছিলো,তখন দেখেছে,পুরোনো একটা চামড়ার ডায়রিতে লেখালেখি করছে। আজ পর্যন্ত ভিনা ওর সাথে ভালোমত কথা বলেনি। কিন্তু তবুও ভিনাকে ভালো লাগে,শুধু ভালো না খুব ভালো লাগে।নওমিকে জিজ্ঞেস করতে হবে, কেন আজকে আসলো না ও।
•
যাবির দুপুরে ক্লাস শেষে বেরিয়ে দেখলো মোবাইলে অনেক মেসেজ জমে রয়েছে।ভিনাকে সকালে দেয়ার মেসেজটার রিপ্লাই এসেছে,"আচ্ছা"।এছাড়াও জেরিনের মেসেজ এসেছে অনেক গুলো।জেরিন কে টিউশনি করায় যাবির।ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে।এই মেয়েকে যাবিরের ভালো লাগে না।তবুও পড়াতে হয় কারণ মাস শেষ পনেরো হাজার টাকা এই একটা টিউশনি থেকেই আসে। ইংলিশ ভার্সনে পড়ে,সব সাব্জেক্ট পড়ায়, সপ্তাহে পাঁচদিন করে। জেরিন মেসেজ দিয়েছে।
"আজকে আসলে না কেন?অপেক্ষায় থাকি তো।"
ইশশশশ!তুমি তুমি করে উল্টায় যাচ্ছে।ইয়ার দোস্তো লাগি তোমার!যত্তসব।
জেরিনের মা মেসেজ দিয়েছে-
"টিউশনিতে না আসলে জানিয়ে দেবে,আর এ মাসে আরো এক্সট্রা পড়িয়ে দেবে"
যাবির আজকেও যাবে না টিউশনিতে। কিন্তু জানাবেও না।এদের দেখলেই মেজাজ টা চরম লেভেলের খারাপ থাকে।মানিব্যাগ বের করে দেখলো পনেরো শ টাকা আছে।আজকে কত যায় কে জানে।আবার ঔষুধ ও কেনা লাগবে মার। খানিকটা চিন্তায় পরে গেলো।
"ব্যবস্থা হয়ে যাবে একটা" নিজেকে বুঝ দিয়ে হাঁটা ধরলো যাবির।ভিনাকে নিয়ে যাচ্ছে,ভাবতেই মনটা উৎফুল্ল হয়ে যাচ্ছে,আজব!......
.
.
.
চলবে................................................