পরিণয়ে পরিপূরক - পর্ব ০২ - স্পৃহা নূর - ধারাবাহিক গল্প


অবন্তী মোটামুটি নিশ্চিত আজ রাত ই তার জীবনের শেষ রাত। সকাল হলেই পাঠার মতো বলি দেবে তাকে । এজন্য ই এমন হাত পা বেধে রেখেছে। লোকটা কে এমনিতেও অবন্তির সাইকো মনে হয়েছিল । আচ্ছা লোকটা নেক্র্ফিলিক নয় তো? হতেই পারে ......
.
বার বার পেছনের কবর গুলোতে তাকাচ্ছে সে। ক্রাইম পেট্রলেও এমন কাহিনি দেখেছে সে। ভয়ে ঘেমে একাকার অবস্থা। পানি তেষ্টা ও পেয়েছে প্রচুর। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে।
নাহ কিচ্ছু করার নেই । না পারছে কথা বলতে না পারছে নড়াচড়া করতে।
.
আচ্ছা এই অভ্র যদি ওকে মেরে ফেলে শুভ্র কি জানতেও পারবে কোন দিন ও? নেটওয়ার্ক রেঞ্জে চলে আসলেই নিশ্চই ফোন দেবে ওকে। কিন্তু ফোন তো চাচারা কেড়ে নিয়েছে । এখন যদি অভ্র মেরেও ফেলে চাচারা এক বার ও খোজ নেবে না । তারা তো বোঝা মুক্ত করেছে। জয়েন ফ্যামিলি ছিল তাদের। বাবার পর চাচারা ই ছিল গার্জিয়ান। শুভ্র তো কিছু দিন পর ই ফিরত। কি হত আর কিছু দিন তাদের কাছে রাখলে। শুভ্র কে তো ফ্যামিলিতে মেনেই নেয়া হয়েছিল। প্রণয় অতপর পরিনয়ে রুপ নিতে চলেছিল সম্পর্ক টা । শুভ্রর বাবা ছিল না । বাবা মারা যাবার পর মায়ের আবার বিয়ে হয়ে যায় ।দাদির কাছে থেকে মানুষ হয়েছে। দাদী মারা যাবার পর আর তেমন কেউ ছিল না । মাঝে মাঝে ফুফুর বাড়ি যেত দেখা করতে। সেখানেই কোন এক চৈত্রের দুপুরে অবন্তীর সাথে দেখা হয়েছিল প্রথম। অবন্তীর নানা বাড়ি ছিল ওখানে।। বছরে মোটে দু এক মাস দেখা হত অবন্তীর শুভ্রর সাথে। বেশির ভাগই সাগরে থাকতে হয় তাকে।
.
শুভ্র ফিরে এসে যখন জানতে পারবে নিশ্চই ভাববে আমি লোভী । ভালো অপশন পেয়ে বিয়ে করে নিয়েছি । চাচারা তো আর আসল সত্য টা বলবে না যে তারাই আমাকে বিক্রি করে দিয়েছে। শুভ্র অভ্র,অভ্র শুভ্র , শুভ্র অভ্র।
.
এসব ভাবতে ভাবতে অবন্তীর চোখ যেন অন্ধকার হয়ে আসছিল।
.
এদিকে অভ্র ঘুমের ভান করে পড়ে থাকলেও আসলে সে জেগেই আছে। একদৃষ্টে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে । ঘুটঘুটে অন্ধকারের ভেতর শুধু অবয়ব টা ছায়ার মতো দেখা যাচ্ছে। এটাও বোঝা যাচ্ছে মেয়েটা বার বার পেছনে তাকাচ্ছে। কিন্ত অভ্র'র নজর সরছে না কোন ভাবেই মেয়েটার দিক থেকে।
.
অভ্র অবন্তী কে প্রথম দেখেছিল ঠিক চার দিন আগে । যেদিন ওর ফ্যামিলির সবার এক্সিডেন্ট হয় । বাবার সাথে গিয়েছিল ওদের বাড়ি ডিলের জন্য । ওর বাবা বাকিদের সাথে ডিল নিয়ে আলোচনা করছিল। কিন্তু অভ্র বার বার রুমের বাইরে উঠোনে একটা মেয়ের দিকে আড় চোখে তাকাচ্ছিল।হ্যা সে মেয়েই অবন্তী ।তবে সেদিন কি আর জানত এই মেয়ে টাই তার পরিপূরক। তার সাথেই লেখা আছে ভবিষ্যত ।
অবন্তী তিনটে লাশের সামনে বসে প্রলাপ বকছিল আর বার বার জ্ঞান হারাচ্ছিল। সে দিন অবশ্য তার মুখ ঠিক মতো দেখতে পারে নি অভ্র। সাদা ওড়না দিয়ে মাথায় ঘোমটা দেয়া ছিল। শুধু কান্নার আওয়াজ টা ঠিক মতো পাচ্ছিল। 
.
অভ্র'র মনে আছে মা যেদিন মারা যায় সেদিন ঠিক এভাবেই কেদেছিল অভ্র।। নাহ এর চেয়ে বেশি ও হতে পারে। সেদিন রেণু খালা ছাড়া কেউ ওকে আগলে নেয় নি একবারের জন্য । কেউ না বাবা ও না, বড় দু বোন ও না ।সেদিন থেকে মায়ের পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া লাশের মতো কয়লা হয়ে গেছিল তার জীবন। হয়ত কয়লা হয়ে গেছিল তার মন ও।সবার দোষারোপে সে ও ধীরে ধীরে বিশ্বাস করে নিয়েছে মায়ের মৃত্যুর জন্য সে নিজেই দায়ী।
.
অনেক্ষন অবন্তীর দিকে চেয়ে চেয়ে এসব পুরনো কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখ লেগে এলো অভ্র বুঝতেই পারে নি। এ চোখে যে বড়ই ক্লান্তি। এ ক্লান্তি কি কোন দিন ও শেষ হবার? 
.
ভোরে রেণু খালার জোরে জোরে দরজা ধাক্কানোর আওয়াজে ঘুম ভাঙল অভ্রর। 
চোখ ঘুষতে ঘুষতে দরজা খুলে দিল সে।
— কি ব্যাপার রেণু খালা তুমি জানো না আমি এত সকালে ঘুম থেকে উঠি না । 
— অভ্রনীল আর কত পাগলামো করবে বাবা আমার?? দেশে ফিরেছ সবে সাত দিন। ফিরে থেকেই আবার একটার পর একটা পাগলামো শুরু করে দিয়েছ?? এসব করতে থাকলে বাবা কিন্ত আবার পাঠিয়ে দেবে দেশের বাইরে।
.
— আমি তো আবার চলে যেতেই চেয়েছিলাম রেণু খালা । বাবা এবার পাসপোর্ট ,ক্রেডিট কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স সব নিয়ে নিয়েছে আমার। বলেছে ঐ মেয়েটার সাথেই নাকি থাকতে হবে তাও এ দেশেই।। আমার জাস্ট অসহ্য লাগে লোকটাকে । যখন আমি তার কাছে থাকতে চাইতাম তখন সে আমাকে কত দুরে পাঠিয়ে দিল আবার এখন চলে যেতে চাইছি এখন আবার পায়ে শেকল পড়িয়ে দেবার মতো করে আটকে রেখেছে
.
— হয়েছে হয়েছে সে শেকল পড়ানোর জন্য কে দায়ী তা তুমি নিজেই জানো।তাই বলে তুমি মেয়েটা কে ওভাবে বেধে রাখবে?? এসব কি অসভ্যতা অভ্রনীল? আমি তো তোমাকে এমন শিক্ষা দিই নি। নাকি বড় বোনের কাছে এতদিন থেকে এসব শিখে এসেছ? অর্পির কাছে থেকে থেকে তো অসভ্যতার মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছ তুমি দিন দিন। এতটা বেপরয়া হওয়া ঠিক না ।যাও খুলে দাও বলছি।
— ও হ্যা আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম । কি করব বড্ড প্রশ্ন করছিল মেয়েটা । তুমি কোত্থেকে দেখলে?
— শুধু আমি না সকাল বেলা গার্ডেনে যারা কাজ করে ওরাই আগে দেখেছে। তারপর আমাকে ডেকে দেখিয়েছে। গার্ডেন থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তোমার বেলকনি। আর লাল বেনারসি পড়া তোমার বৌ। ভাইজান দেখার আগে তাড়াতাড়ি খুলে দাও ওকে । 
— অহ হ্যা ঠিক ই বলেছ। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি উফ্ফ। সকাল হয়ে গেছে বুঝতেই পারি নি। আর রেণু খালা শোন আমার অর্পি আপু অনেক ভালো । বাবার চেয়ে অনেক ভাল। তুমি তার নামে কিছু বলবে না ।অর্পি আপু আমার বোন নয় মা আমার ।
.
— আর আমি???
— তুমি তো রেণু খালা।। হা হা জেলাস ফিল করো? শোন এই পৃথিবীতে আমার তিনটে মা। আমার মা হচ্ছে আমার প্রথম মা, তুমি আমার দ্বিতীয় মা, আর অর্পি আপু আমার তৃতীয় মা। 
.
— হয়েছে যাও বৌ কে খুলে দাও এবার । বাড়ির সব কাজের লোকজন হাসাহাসি করছে বলছে বাসর রাতে বৌ কে বেধে রেখেছে ছোট সাহেব। 
— কিসের বৌ ধুর বাদ দাও তো 
.
অভ্র বেলকনিতে গিয়ে দেখতে পেল অবন্তী ওভাবে দাড়িয়ে দাড়িয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। বাধন গুলো খুলে দিতেই ঢলে পড়ল অভ্রের ওপর ।
এ মেয়ে কেমন মেয়ে রে বাবা দাড়িয়ে দাড়িয়ে ঘোড়ার মতো ঘুমোয়। দু একবার ডাক দিয়ে সাড়া না পাওয়ায় বুঝতে পারল এটা ঘুম নয়। সেন্সলেস হয়ে পড়েছে।
.
অভ্র আর রেণু খালা মিলে খুব সাবধানে জ্ঞান ফেরালো অবন্তীর। বাবার কানে এসব গেলে খবর আছে।।
— অবন্তী এই অবন্তী ঠিক আছ?
— পানি দেবেন প্লিজ
অভ্র ওকে পানি দিতে দিতে বলল
— পানি কিন্ত দিচ্ছি তবে একটা শর্ত আছে। পাকনামো করে কাল রাতের কথা বাবাকে বলবে না কিন্তু বলে দিলাম। তাহলে আজ রাতে সিরিয়াসলি মাটির নিচে চাপা দিয়ে ফেলব তোমায়।
— আ,,,আমি বেচে আছি?
— মানে কি?
— আমাকে কি আপনারা আজ ই বলি দেবেন?
— কি দেব???
.
.
— অভ্র তুমি কি কাল রাতে নিজে মদ খেতে খেতে তোমার বৌ কেও খাইয়েছ? আর কত নিচে নামবে তুমি?
— না না ।কি বলছ খালা এসব ? আমি তো শুধু একটু বেধে রেখেছিলাম রাগ করে । 
— হয়েছে থাক। অবন্তী তুমি বরং ঘুমিয়ে নাও একটু। এখন তো ভোর । কিছুক্ষণ পরে ডেকে দিলে নিচে নেমো একটু সুন্দর করে শাড়ি পরে । তোমার শশুড় তোমাদের সাথে সকালের নাশতা করবেন বলেছেন।
.
.
খাবার টেবিলে অভ্র ভেজা বেড়ালের মতো মাথা নিচু করে বসে বসে খেয়েই যাচ্ছে। না তাকাচ্ছে বাবার দিকে না তাকাচ্ছে অবন্তীর দিকে। কখন বুঝি এই মেয়ে সব বলে দেয় বাবাকে।
অবন্তী কোন কথা ই বলছে না । সত্যিই যদি মেরে চাপা দেয় মাটিতে।
.
.
মৌণতা কাটিয়ে অভ্রর বাবা আজমির চৌধুরী বলে উঠলেন
— অভ্র তোমার রুমে আজকাল দড়ি ও থাকে??
— কিহ?? দ...দ..দড়ি ??? কই না তো । কে বলেছে এসব ফালতু কথা? অবন্তী?? এ..এই মেয়ে তো একটা ফাজিল মেয়ে ।ও নিজেই দাড়িয়ে ছিল ওভাবে ।
— বাহ । মিথ্যে বলাটাও তো ঠিক মতো শিখে উঠতে পারো নি ঠিক মতো ।
—ঠিক ই বলেছ সত্যিই মিথ্যে বলতে পারি না আমি ঠিক ভাবে। আমার মিথ্যে ভালো লাগে না ।
— এক্ষুনি সরি বলো সবার সামনে সরি বলো । কান ধরে বলো । ওঠ দাড়াও।
— আশ্চর্য । ঐ মেয়েটা আমাকে রাগিয়ে দিয়েছিল তাই আমি । শোন বাবা আমি ইনোসেন্ট ।
— আশ্চর্যের দেখেছ কি? সারারাত বৌ কে সং সাজিয়ে বেধে দাড় করে রাখা হয়েছিল তাই না? এবার তুমি সং সেজে দাড়িয়ে থাকবে আজ সারাদিন। সবার খাওয়া শেষ হলে এই ডায়নিং এ উঠে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে আজ সারাদিন। তাছাড়া ক্রেডিট কার্ড তো নিয়ে নিয়েইছি এ মাসের পকেট মানি যা দিয়েছি তাও নিয়ে নেব বলে দিলাম। বেশি আস্কারা পেয়ে পেয়ে দিন দিন বাদর থেকে শিম্পাঞ্জি হয়ে উঠছ তুমি।
.
.
অভ্রর কিছু করার নেই এ মুহুর্তে এছাড়া আর। সবার নাস্তা শেষে টেবিলে উঠে দু কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে । তারপর অবন্তী কে সরি বলেছে। ভবিষ্যতে এমন করবে না সে প্রতিজ্ঞা ও করেছে।
.
অবন্তী ওকে দেখে খিলখিলিয়ে হেসেই যাচ্ছে । এ বাড়ির সবাই এই প্রথম অবন্তী কে হাসতে দেখল। 
.
আজমির সাহেব ওর মাথায় হাত রেখে বললেন
— মা তুমি এভাবেই হাসিখুশি থাকবে সব সময় । বাড়ির মেয়ে মন মরা হয়ে থাকলে বাবার কি ভাল লাগে বলো? আমি তো তোমার বাবা ই তাই না? আমার আরো দুটো মেয়ে আছে। তাদের তুলনায় ভালবাসা তুমি কম পাবে না বলে দিলাম। যা হারিয়েছ তার চেয়ে বেশি কিছু দেয়ার চেষ্টা করবে এ বাড়ির সবাই তোমায়। আর আমার ছেলেটাকে একটু মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করো । ও তো তোমার ই পরিপূরক। ওকে শুধরে নেয়ার দায়িত্ব ও তোমার।
.
— বাবা আপনি ভুল বললেন। আমি উনার পরিপূরক নই। আমি শুধুই উনার জন্য কিনে দেয়া এক দাসী। আপনি শুধুমাত্র আপনার আদরের ছেলের মনোরঞ্জন আর খামখেয়ালিপনা মেটানোর জন্য আমাকে কিনে দিয়েছেন ওকে।
— দেখো মা আমি তোমার বাবার বয়সী । আমার সাথে কথা বার্তা তোমার আর একটু সংযত ভাবে বলা উচিত। আর আমার ছেলেকে তুমি ভুল বুঝছ। ও আর যাই হোক এমন নয় ।
— তো আমি তো ঠিক টাই বুঝতে চাই, জানতে চাই। জানিয়ে দিন আমায় ঠিকটা । 
— যাই হোক সন্ধ্যায় রিসেপশন পার্টি আছে। বাবা বলে ডেকেছ যখন আশা করি পার্টি তে সবার সাথে স্বাভাবিক থেকে বাবার মান রাখবে।
— জ্বি আমি চেষ্টা করব। কারণ প্রথম দেখায় আমি আপনার মাঝে কোথাও যেন আমার বাবাকে খুজে পেয়েছি।।কিন্ত আপনারা আমাকে সব প্রশ্নের উত্তর না দিতে চাইলেও আমি নিজেই খুজে বের করব সব উত্তর। 
.
.
— সেসব প্রশ্নের উত্তর তুমি কখনোই খুজে পাবে না অবন্তীকা আফরিন অবন্তী। এ বাড়িতে অনেক পুরনো প্রশ্নের উত্তর ই আজো মেলেনি। আর তোমার এসব তো নতুন প্রশ্ন। এরা শুধু জানে..নাহ থাক বললাম না । এদের মান সম্মান বড্ড বেশি ।
.
অভ্র ওর বাবার চোখে চোখ রেখে তাচ্ছিল্যের সাথে কথা গুলো বলল। তারপর টেবল থেকে নেমে বাড়ির বাহিরে গার্ডেনে চলে গেল । অভ্রর বাবা এবিষয়ে আর কথা বাড়ালেন না ।।
.
.
অবন্তী বেলকনিতে দাড়িয়ে ঠিক দেখতে পাচ্ছে অভ্র প্রথম কবর টার পাশে বসে ফিসফিসিয়ে কিছু বলছে। মুখভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছে কোন ব্যাপারে বিচার জানাচ্ছে। 
অভ্রর এসব কান্ড দেখে কেমন যেন অদ্ভুত ভয়ে শরীর হিম হয়ে আসছে। ঘরের পাশেই এরকম গোরস্থান । দাদির কাছে ছোট বেলায় বিভিন্ন গোরস্থান নিয়ে অনেক কিছু শুনেছে সে। 
হুট করে কাধে কারো শীতল হাতের স্পর্শ পেল সে
.
.
.
চলবে........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন