" উফ্ফ! সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে!"
অভ্রের এ কথায় শুভ্রের ভ্রম কেটে গেল অবন্তীর।
.
— আপনার আবার কি সর্বনাশ? এটা তো চৈত্র মাস নয়।
— চৈত্র মাসের সাথে সর্বনাশের কি সম্পর্ক?
— আছে সম্পর্ক
—
— এই আশ্বিনের সকালে চৈত্রের সর্বনাশ খুজে বেড়ানোর মানে কি? আমি তোমার কথার আগা গোড়া কিচ্ছু বুঝি না বিলিভ মি।
.
.
— ওসব বোঝার মতো মন মস্তিষ্ক কোনটাই আপনার নেই
— কিহ?
— কিছু না । হুট করে ঘুম থেকে এমন ধরফরিয়ে উঠলেন কেন? কি সর্বনাশ হয়েছে?
— সর্বনাশ হবে না? সকাল হয়ে গেছে আমাকে ডেকে দাও নি কেন তুমি? রেণু খালা কই? সে ও ডাকল না । এখন আমি বাইরে বেরোবো কিভাবে?।
— রেণু খালা পাশের রুমে । কেন নিজের বাড়িতে বাইরে বেরতে কি প্রবলেম?
— তুমি জানো না এ রুমে আমি লুকিয়ে এসেছি? আমাকে ওপরের রুমে লক করে রেখেছে?
— বাহ। চুরি করে অন্যের রুমে ঢোকেন? চুরি বিদ্যায় তো ভালোই এক্সপার্ট দেখছি।
— প্রয়োজনে মাঝে মাঝে চুরি বিদ্যায় ও এক্সপার্ট হতে হয় ।। রেণু খালা আসলে বলে দিও আমি আমার রুমে চলে গেছি। আর শোন একটা কথা ছিল।
.
— জ্বি
— কাল রাতের জন্য সরি। আমার আসলে মাথা ঠিক ছিল না
— তা আপনার মাথা কখন ঠিক থাকে?
— কেউ রাগিয়ে না দিলেই।
— কেউ রাগিয়ে দিলেই রেগে যেতে হবে বুঝি? জানেন না রেগে যাওয়া হেরে যাওয়ার পুর্ব লক্ষণ?
.
.
অভ্র কিছুক্ষণ শান্ত ভাবে তাকিয়ে রইল।
— সত্যিই?
— হুম । সত্যি তো ।
— তুমি বেশ কথা বলতে পারো —হুম আমার শুভ্র আরো সুন্দর কথা বলতে পারে । আমি ওর থেকে কিছু কিছু শিখেছি।
— শোন মেয়ে তুমি এখন শুভ্রর না তুমি অভ্রর
.
.
অভ্র পেছন দরজা দিয়ে বাহিরে গিয়ে বেলকনি দিয়ে আবার নিজের রুমে চলে গেল । নিজের রুমে নিজের এভাবে বন্দি হয়ে থাকতে বেশ ভালোই লাগে । দরকার হলে তো বেরোনো ই যায় । শুধু একটু সাবধানে বাবা আর বোনের চোখ ফাকি দিয়ে ।
.
.
তিন দিন পর অভ্রর রুমের লক খুলে দেয়া হলো, অবন্তী কে আবার ফিরতে বলা হলো ওপরে অভ্রের রুমে।
.
.
সারাদিন আর দুজনের কোন কথা হলো না ।
.
রাতে ঘুমের ভেতর ই ঘাড়ে কারো উষ্ণ হাতের স্পর্শ অনুভব করল অবন্তী। ঘাড়ের চুল খুব সাবধানে সরানো হচ্ছে বোঝাই যাচ্ছে।
.
.
অন্য সময় হলে হয়ত এত সাবধানে ছোয়া স্পর্শ অবন্তী ঘুমের ঘোরে বুঝতেই পারত না । বড্ড ভারী ঘুম মেয়েটার। কিন্তু এখন সে যথেষ্ট সজাগ থেকে ঘুমোনোর চেষ্টা করে । পাশে অভ্র আছে যে ।
.
আর তাছাড়া রুমের একদম নীচ বরাবর খুন করা পোড়া লাশের কবর। ছোট বেলায় শুনেছে এসব খুনের আত্না নাকি রাতে অতৃপ্ত আত্মা হয়ে ঘুরে বেড়ায়।যদিও কতটা সত্যি সে জানে না । তবুও ভয় তো করেই।
আর অভ্র এত জোরে টেনে হিচড়ে চেইন আর হার গুলো খুলছিল সেদিন ঘাড়ের আর গলার কালসিটে দাগ টা আছেই এখনো সাথে ব্যথাও কিছু টা । তাই হাত পড়তেই সাথে সাথে জাগা পেয়ে গেছে ।
.
.
স্পর্শ টা ঘাড় থেকে গলার দিকে যেতেই উঠে বসল অবন্তী।
— গলা টিপে মেরে ফেলতে চান? নাকি ঘাড় মটকিয়ে?
— সেদিন অনেক বেশি ব্যাথা দিয়ে ফেলেছি তাই না? এখনো কালসিটে পড়ে আছে দেখছি।
— এই ঘুটঘুটে অন্ধকারে আপনি কি করে দেখলেন? আপনি কি হুতুম পেচা?
— বাড়ি ফিরে সাথে সাথে একটু ঠান্ডা পানি দিতে পারো নি? তাহলে তো আর কালসিটে দাগ টা পড়ত না । ব্যথাও ঠিক হয়ে যেত তাড়াতাড়ি।
— আপনার কি আমার ছোট খাট কোন প্রশ্নের ও উত্তর দিতে ইচ্ছে করে না?
— আচ্ছা বলো উত্তর দিচ্ছি
— এই যে এই ঘুটঘুটে অন্ধকারে কিভাবে দেখলেন?
— আমি অন্ধকারেও সব দেখতে পাই। এই যে এখন দেখতে পাচ্ছি তুমি ভয় পাচ্ছ। আমার অন্ধকারে সব দেখতে পাওয়ার কথা শুনে ঢোক গিলছ। আর আমি এটাও বুঝতে পারছি তোমাকে দেখে এখন তোমার পানি খেতে ইচ্ছে করছে ।
— সিরয়াসলি ? আপনি কিভাবে দেখছেন? আমি তো আপনার আওয়াজ ছাড়া কিছুই ...
— হুম।
— আপনি আসলে মানুষ নাকি অন্যকিছু?
—কে বলেছে আমি মানুষ? তুমি যে ব্যাপারে সব চেয়ে বেশি ভয় পাও সেটাই আমি।
— মা ...মা..মানে?
— অতৃপ্ত আত্মা আমি। তোমার ঘাড়ের রক্ত খেয়ে তৃপ্তি নেব।
— এই আ.. আমি কিন্ত এবার আগুন জ্বালব। আমি জানি এসব জ্বিন ভুত আগুনে ভয় পায় ।
— আগুন তো এবার আমি জ্বালব।
.
এক টানে বাহুর ভেতর নিয়ে নিল অভ্র ।
— জ্বালাও এবার আগুন। আগুন জ্বালিয়ে ভয় দেখাবে নাকি আমাকে? দেখি না কার আগুনে কে বেশি জ্বলে?
.
অভ্র বুঝতে পারছে অবন্তীর শ্বাস আর নিশ্বাস এর মধ্যবর্তী সময় এর পার্থক্য ক্রমশ কমে আসছে। ভয় পেয়েছে ভীষণ মেয়েটা।
.
— এই মেয়ে এতো ভয় পাও কেন আমাকে বলো তো? উফ্ফ ভয়ের রানি একটা । আমাকে তোমার মানুষ মনে হয় না?
.
অভ্র বাহুডোর থেকে ওকে ছেড়ে দিয়ে হাসতে হাসতে কথা গুলো বলল।
.
.
—না মানে আপনি দেখতে মানুষের মতো ই কিন্তু আচার আচরণ..এতো অন্ধকারে কেউ কি করে থাকে? তার মধ্যে এ রুমেই কেন থাকতে হয় আপনার? রুমের নীচেই ভূতের বাড়ি।
— হা হা । আমি আছি না এত ভয় কিসের তোমার? আমি আছি তো নাকি? সারারাত তো প্রায় জেগেই থাকি আমি । সমস্যা নেই ভুত আসলেও তোমার কিচ্ছু হতে দেব না ।
— আপনি নিজেই তো একটা ভুত। রাত হলেই আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই বোঝা যায় না, দেখাও যায় না । অথচ নিজে নাকি সব ই দেখে।
.
.
অভ্র অবন্তীর ডান হাত টা নিয়ে বুকের বা পাশে শক্ত করে চেপে ধরল।
— কিছু দেখতে পাও না, বুঝতে পারো না, অনুভব তো করতে পারো নাকি???
.
কি যেন মনে হয়ে হাত টা ছেড়ে দিয়ে টি শার্ট খুলে ফেলে আবার একি জায়গায় অবন্তীর একই হাত চেপে ধরল অভ্র।
— কি হচ্ছে এসব? কি অনুভব করব আমি?
— কেন আমার হার্টবিট ।
— ওটা তো টি শার্ট পড়েও বোঝা যেত। আর আমি আপনার হার্টবিট ফিল করে কি করব?
— কি আবার করবে আমাকে ভয় পাওয়া বন্ধ করবে। দাড়াও স্টপ ওয়াচ চালু করছি। দেখো তো এক মিনিটে কয় বার বিট দেয়?
.
অভ্র ফোনের স্টপ ওয়াচ অন করে পাক্কা এক মিনিট ওভাবেই চেপে ধরে থাকল অবন্তীর হাত।
ফোনের হালকা আলোতে অভ্রের হাসি মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অবন্তী আজ প্রথম মানুষটা কে হাসতে দেখছে। হ্যা সে হাসতেও পারে।
.
.
ষাট সেকেন্ড হওয়া মাত্র ই অভ্র হাত ছেড়ে দিয়ে আবার টি শার্ট পড়ে নিল
— কি কত বার বিট দিল?
— গুনিনি আমি
— তো কি করলে এতক্ষণ? হুম?
— জানিনা
— যাই হোক এটা তো বিশ্বাস করেছ আমার হার্ট বিট দেয়?? তার মানে আমি মানুষ? তুমি যেসব ভুত প্রেত মনে করো আমাকে তাদের কিন্তু হার্ট বিট দেয় না । ঠান্ডা হিম হয়ে থাকে তাদের হার্ট আর দেহ। আমার বডি তে কিন্তু এখন নর্মাল মানুষের মতো ই থার্টি সিক্স থেকে থার্টি সেভেন ডিগ্রি সেলসিয়াস টেমপারেচার ই আছে। সেটা বুঝতে পেরেছ তো? সে জন্য ই টি শার্ট খুলেছিলাম । অত ভয় পাবার কিছু নেই । বরং ভয় পেয়ে নিজেই ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছ।
— জ্বি বুঝতে পেরেছি এখন।
— আর ভয় পাবে না তো আমাকে?
— না।
.
.
অভ্র উঠে গিয়ে রুমের লাইট জ্বালিয়ে অবন্তীর দিকে চকলেট এগিয়ে দিল।
অবন্তী নিতে না চাইলে নিজেই প্যাকেট ছিড়ে এক কামড় খেয়ে আবার এগিয়ে দিল।
— নাও বিষ নেই এতে। আমি নিজেই তো খেয়ে প্রমাণ দিলাম । তুমি না চকলেট পছন্দ করো?
— হ্যা কিন্তু আপনি জানলেন কি করে?
— আগে এটা খাও তার পর বলছি
.
.
— হুম এখন বলুন
— অনুমান করে বলেছি। ব্যাস আর কিচ্ছু না । কথা টা আগে বললে খেতে না । তাই পরে বললাম। কিছু খেয়ে পানি খাওয়া ভালো । তোমার তো তেষ্টা পেয়েছিল। নাও পানি নাও ।
.
.
পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে অভ্র ফার্স্ট এইডের বক্স নিয়ে এসে হাটু গেড়ে বসে অবন্তির ঘাড়ে মেডিসিন লাগিয়ে দেয়ার জন্য ডান হাত এগিয়ে দিতেই অবন্তি হাতের কাটা ব্যান্ডেজ করা জায়গাটা মুচড়ে ধরল।
— কি মনে করেন নিজেকে? শক্তি কিন্তু আমার ও আছে। টাচ করার বাহানা খোজা হচ্ছে একটু পর পর তাই না?
— উফ্ফ ছাড় । এত শক্তি তো কাটা জায়গায় মুচড়ে ধরেছ কেন? গ্লাস ঢুকেছিল আমার এখানে এখনো ড্রেসিং করতে হয়। ছাড় বলছি লাগছে তো । অন্য হাত ধরে দেখো।
— এই হাত ই তো এগিয়ে আনছিলেন । এটাই তো ধরব।
— আশ্চর্য আমি তো তোমার ভালোর জন্য ই মেডিসিন টা
— অনেক ভালো করেছেন আমার আর করতে হবে না । একদম এভাবে বাহানা দেখিয়ে ছোবেন না আমায় বলে দিলাম
— কেন,? ছুলে কি করবে তুমি হ্যা?? তোমার শুভ্র তো ঠোটের স্পর্শ দিতে ঘাড়ে । আর আমি প্রয়োজনে তাও আবার তোমার ভালোর জন্যই হাতের স্পর্শ দিলেও সমস্যা তাই না?? নাকি ঠোটের স্পর্শ ই চাই?
— আর একটা বাজে কথা বলবেন না আপনি।
— বাজে মন মাইন্ডের মেয়ে তো তুমি নিজে। যার ছোয়ার কোন অধিকার নেই সে ছুলে তোমার সমস্যা হয় না
অথচ যার অধিকার আছে সে ভদ্র ভাবে সামান্য হাত দিয়েছে তাতেও তোমার প্রবলেম হচ্ছে তাই না?
— আপনি কিভাবে জানলেন শুভ্র আমার ঘাড়ে ছুয়েছিল?
— বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড তোমরা । এসব ইজি ব্যাপার তো হতো ই বোঝা ই যাচ্ছে। এটা আবার জানতে হয় নাকি? আমি কি এতই বোকা? আরো কত কিছু করেছ কে জানে ।
.
— আপনার কি মনে হয় আমি বাজারের মেয়ে? শুভ্র আমাকে এক দিন ই ঘাড়ে স্পর্শ করেছিল । আমি সেদিন ওকে থাপ্পড় ও দিয়েছিলাম । অনেক কথা কাটাকাটি হয়েছিল আমাদের সেদিন এ ব্যাপার টা নিয়ে । পরে ও আমাকে সরি বলেছিল। পাচ দিন লেগেছিল সব কিছু ঠিকঠাক হতে।
— তোমার এসব প্রেম কাহিনি শোনার না আমার একদম ধৈর্য নেই। নাও নিজেই মেডিসিন লাগিয়ে নাও। ব্যাথা কমে যাবে। আমি শুভ্রর মতো অত অভদ্র নই যে হুট হাট কাউকে ছোয়ার বাহানা খুজব। আবার শুভ্রর মতো অতটা ভদ্র ও নই যে সরি বলব।
.
— আপনার আসলে সমস্যা টা কি??
— সমস্যা আমার নয় সমস্যা আসলে তোমার। তুমি পরিণয়ের চেয়ে প্রণয় কে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছ।
.
— আপনি আসলে চান টা কি?
— অনেক কিছু । আস্থা, বিশ্বাস, ভরসা আর হয়ত ভালোবাসা। একবারে চাইছি না ধীরে ধীরে দিলেই চলবে। আমার এসবের বড়ই অভাব।
.
.
.
চলবে.........................