— আপনি আসলে চান টা কি?
— অনেক কিছু । আস্থা, বিশ্বাস, ভরসা আর হয়ত ভালোবাসা। একবারে চাইছি না ধীরে ধীরে দিলেই চলবে। আমার এসবের বড়ই অভাব।
.
— সেটা আমিও এ ক দিনে বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছি। জানেন আমার শুভ্রর ও এসবের বড় অভাব ছিল । কিন্তু পার্থক্য একটাই ওকে এসব দেয়ার মতো কেউ ছিল না আর আপনার সবাই থেকেও কেউ নেই।
— শুভ্র আসলে তুমি চলে যাবে তাই না?
— আপনি যেতে দেবেন?
— আমি আটকে রাখার কে?
— কেউ না?
— হয়ত না ।
— তাহলে এভাবে অন্যের আমানত কে বিয়ে করেছিলেন কেন?
— তুমি অন্যের আমানত তাই না?
— তো কি???
— আমি আসলে এভাবে ভাবি নি ব্যাপারটা। থ্যাংক্স এভাবে ভাবিয়ে দেয়ার জন্য ।
— আপনি ভাবতে পারবেন ও না কোন দিন । এসব ভাবতে গেলে না সুস্থ একটা মন মস্তিষ্ক থাকতে হয় আপনি তো অসুস্থ, মানসিক প্রতিবন্ধী।
— হ্যা জানি আমি সেটা।
.
.
অর্নি চলে যাবার দিন অবন্তী কে ভালো মত বুঝিয়ে গেল সে যেন অন্তত রেণু খালার সাথে অভ্রর মতো আদিখ্যেতা না করে । আর অভ্র কেও রেণু খালার থেকে যেন দুরে রাখতে চেষ্টা করে ।
অর্নি এ ক দিনে বেশ ভালো ভাব জমিয়ে ফেলেছে অবন্তীর সাথে।কথায় কথায় তার ব্যাপারে জানতে চেয়েছে কিছু জানতেও পেরেছে। তবে সেসব প্রয়োজনীয় কিছুই না । শুভ্রর ব্যাপারে আর নিজের ব্যাপারে অবন্তী যথেষ্ট সচেতন । অভ্র ছাড়া কাউকে বলে নি ।
.
তিন বার কবুল বলা সম্পর্ক হাজার হলেও। কোথাও যেন একটা আলাদা আস্থা পাওয়াই যায় তার ওপর ।
.
.
অবন্তী ঠিক বুঝতে পেরে গেছে এ বাড়ি তে দুটো দল আছে। এক দলে রেণু খালা সে সব কিছু তে অভ্র কে সাপোর্ট করে । ওকে আগলে রাখতে চেষ্টা করে ।
.
আর এক দল অর্নি আর ওর হাজব্যান্ড কথায় কথায় অভ্রর ভুল ধরে।সব কিছু তে বাবার সামনে জোর করে ছোট করার চেষ্টা করে ।
.
বাবা মোটামুটি নিউট্রাল । হ্যা বাবা শাসন ও করে। বাবা তো ভুল করলে শাসন তো করবেই
আর অর্পি আপু কে সে এখনো দেখে নি। জার্মানি থাকে স্বামী সংসার নিয়ে । অভ্র এতদিন ওর কাছেই থাকত। ওখানেও ওদের টুকিটাকি বিজনেস আছে । অর্পি আর ওর হাজব্যান্ড ওদিক সামলায়।।
.
তবে অভ্রর কাছে শুনেছে অর্পি আপু এমন নয় । অর্নির মতো নয় । রেণু খালার মতো । খুব ভালোবাসে ওকে।। কিছু দিন পর আসবে। অবন্তী কে দেখতে।
.
তবে ফোনে মাঝে মাঝে কথা হয় অর্পি আপুর সাথে। কথা বলে এটুকু বোঝা যায় সে খুব ই আন্তরিক।
.
অভ্রর মাঝে হুট করেই কিছু পরিবর্তন খেয়াল করছে অবন্তী। হুট করে রেগে গেলেও থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলে থেমে যায়। কোন কিছু বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলে বোঝে। । গল্প করতে চাইলে সারাদিন ও গল্প করে কোন কোন দিন । তবে গল্পটা শুরু অবন্তী কেই করতে হয় । অভ্র নিজে থেকে কোনদিন ও আগ বাড়িয়ে কথা বলতে চায় না । তবে অবন্তী শুরু করলে অভ্র শেষ ও করতে চায় না ।
.
.
শুভ্রর মতো গুছিয়ে কথা বলতে পারে না অভ্র। কিন্তু দিন দিন কেমন ওগোছালো কথা ই ভালো লাগে অবন্তীর । অভ্রর ভেতর কোথাও একটা চুম্বক আছে।
অভ্রর ভ্রূ নাচিয়ে , হাত নাড়িয়ে , চোখের তারা বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে,মাঝে মাঝে ফিসফিসিয়ে গল্প করার মাঝেই হয়ত চুম্বক টা আছে।
.
.
এখন রোজ দুপুর করে সাপ লুডো খেলার আসর বেশ জমে। অভ্র ,অবন্তী আর রেণু খালা । খেলার শর্ত অভ্র জিতলে সে রাতে রুম আগের মতোই ঘুটঘুটে অন্ধকার থাকবে। অবন্তী জিতলে রুমে ডিম লাইট জ্বালিয়ে রাখতে হবে আর বেলকনির দরজা বন্ধ করে রাখতে হবে । রেণু খালা জিতলে যার সাপোর্ট নেবে তা ই হবে ।
রেণু খালা ইচ্ছে করেই প্রতিদিন হেরে যায় । আর ওদের মধ্যে যে যেদিন যত বেশি চিটিং করতে পারে সে জিতে যায় । চিটিং করতে করতে প্রতিদিন ঝগড়া লেগে যায়
.
.
রেণু খালা বোঝে এগুলো ঝগড়া নয় খুনসুটি ।
খুনসুটি যে অন্যকিছুর পুর্বলক্ষণ।
খেলার ছলে কত বার যে আঙুলে আঙুলে কথোপোকথন হয়ে যায় সে হিসেব রাখা মানা।
কিন্তু ঐ যে আঙুলে আঙুল রাখলেও হাত ধরা বারণ।
এমন একটা ব্যাপার থেকেই যায় ।
এখন অভ্রের যেমন রাতে আলোতে থাকার অভ্যেস হয়ে গেছে অবন্তীর ও অন্ধকারে থাকতে তেমন ভয় লাগে না।
.
.
সন্ধ্যের আগে আগেই অভ্র ঘুমিয়ে পড়ে । ঘুম থেকে ওঠে রাত আট টা নটায় । তারপর সারারাত জেগে থাকে । কোন কোন দিন ভোরে আবার ঘুমিয়ে পড়ে । অভ্রর এসব আজগুবি অভ্যাস একদম ভাল লাগে না অবন্তীর। কেমন হুতুম প্যাচাদের মতো ।
.
সেদিন ও সন্ধ্যায় ঘুমোচ্ছে অভ্র। রেণু খালা তার রুমে কোরান পড়ছে। অবন্তীর এ সময় টা একদম একা একা লাগে। কেউ থাকে না কথা বলার। নামাজ শেষে টিভি সামনে একা একা বসে থাকতে হয় । টিভিতে রেসিপির শো দেখতে দেখতে মনে পড়ে গেল বাবা তার হাতের রান্না খেতে চেয়েছিল একদিন।
.
আজই রান্না করবে বাবার জন্য । সন্ধ্যার নাস্তায় বাবা কে সারপ্রাইজ দেয়া যাবে। নিজের বাবা কে প্রায় ই রান্না করে খাওয়াত অবন্তী। রান্না বেশ খারাপ হতো । তবুও বাবা আর ভাইয়া চেটেপুটে খেত।
.
.
রান্নার কাজে অবন্তীর তেমন কারো হেল্প নেয়া পছন্দ নয়। শুধু শুধু ভুল ধরে । রান্নার লোকদের রুম থেকে বের করে দিয়ে নিজেই রাধতে শুরু করল চিংড়ির পেয়াজী । এটা সে বেশ ভালো বানাতে পারে ।
.
.
শাড়ি পরে রান্না করাটা বেশ কষ্টকর লাগে তার কাছে । শাড়ি সামলাবে নাকি রান্না? দুটো তেই যে এখনো কাচা । তবে বাড়ির বৌ শাড়ি ই পড়তে হবে এমনটাই নিয়ম। কোমরে কোন মতো শাড়ির আচল গুজে শুরু করল কাচা হাতের রান্না।
.
গরম তেলে পেয়াজী গুলো ছাড়তেই দু এক ফোটা তেল ছিটে আসছে। এখনো ডুবো তেলে রান্না করার কায়দা ঠিক মতো শিখে উঠতে পারে নি।
.
.
দু তিনটে পেয়াজী ছাড়তেই অভ্র হুট করে দৌড়ে এসে গ্যাস স্টোভের আগুন নিভিয়ে দিল।
— কি হলো এটা?
.
অবন্তী প্রশ্নটা শেষ করার আগেই ডান গালে দুটো চড় খাওয়া শেষ ।
.
আবার কিছু বলার আগেই অভ্র বুকের ভেতর ওকে জাপটে ধরে নিয়ে রান্নাঘর থেকে বাহিরে নিয়ে এলো।
.
অভ্র এতো শক্ত করে জাপটে নিয়েছে মনে হচ্ছে বুকের খাচার ভেতর ঢুকিয়ে নেবে ওকে ।
অবন্তী না পারছে কোন কথা বলতে না পারছে নড়াচড়া করতে । অভ্র যে খুব ভয় পেয়ে গেছে এটা ছাড়া আর কিছুই বুঝতে পারছে না সে।
বেশ অনেক্ষন পর ছেড়ে কোলে তুলে সোজা নিজের রুমে নিয়ে গেলো । অবন্তীকে বেডে বসিয়ে দিল ।নিজে ফ্লোরে বসে অবন্তীর কোলের ভেতর মুখ লুকিয়ে ফোপানো শুরু করল।
.
দু দুটো থাপ্পড় থেকেও অবন্তীর কোন রাগ ই লাগছে না ।থাপ্পড় দুটো যে খুব আস্তে ছিল তা ও নয়। রাগের চেয়েও কৌতূহল এখন মুখ্য।
.
.
আর তাছাড়া এখন আর রাগ হয় না তার প্রতি তেমন। কেমন যেন মায়া হয় ।
.
— হঠাত এমন করছেন কেন? ক দিন তো ভালোই ছিলেন। কি হলো আবার?
.
কোল থেকে মাথা তুলে চোখ মুছতে মুছতে শাসনের স্বরে জবাব দিল অভ্র,
.
— তুমি হঠাত এমন করলে কেন?
— কি করেছি আমি?
— তোমার মরে যাবার খুব শখ তাই না?? আমার ওপর এত রাগ তোমার? অভ্র কে একটু ও ভাল লাগে না তাই না? শুভ্র কেই চাই তো?? শুভ্র কেই পাবে তুমি। কথা দিলাম।
— সত্যিই শুভ্র কে পাব?
— হ্যা, কথা দিলাম তো ।
— আপনি আপনার এই পরিণয়ের বাধন থেকে মুক্তি দেবেন আমায়?
— শুভ্রর বাধনেই বাধা পড়বে তুমি।বলছি তো । অভ্র তো অনেক খারাপ । অভ্র ভালো না ।কিন্তু তবুও এরকম করো না পায়ে পড়ি । আমার ওপর রাগ করে ওসব কি করতে যাচ্ছিলে তুমি??? মরে কেন যেতে হবে তোমার? আমি তো এখন তোমার সাথে মানিয়ে চলার ই চেষ্টা করি । ড্রিংক্স করা ছেড়েছি, সিগারেট ছেড়েছি, অযথা রাগ করা ছেড়ে দিয়েছি,...
.
অবন্তী বেশ বুঝতে পারছে অভ্রর জেদ চড়ে বসছে এসব বলতে বলতে। থামানো উচিত ওকে। তাছাড়া আবার পাগলামো শুরু করবে।
.
— অভ্র , অভ্র চুপ চুপ। কি হয়েছে? আমি মরে যাব কেন? এত কৈফিয়ত কে শুনতে চেয়েছে আপনার কাছে? আমি শুধু জিজ্ঞেস করেছি কি হয়েছে? কেন এমন করছেন?
— তুমি কিচেনে কেন গিয়েছিলে? আমি একটু ঘুমিয়েছি আর তুমি আমাকে ফাকি দিয়ে, মার মতো তুমিও চলে যেতে চাও তাই না?
— মার মতো মানে? আমি তো রান্না করতে
— সেদিন মা ও এভাবে চলে গেছিল আমাকে ছেড়ে।
— কোন দিন? কিভাবে? বলুন আমায়। ছোট বাচ্চাদের মতো আরো কতক্ষণ কান্নাকাটি করবেন হুম? আপনার তো শুধু মা নেই । আর আমার যে বাবা,মা, ভাইয়া ও নেই?
— ওরা তো আর তোমার জন্য মরে যায় নি । আমার মা আমার জন্য মারা গেছে আবার এখন তুমিও আমার ওপর রাগ করে
— আমি রাগ করি নি। বিশ্বাস করুন। খুলে বলুন না আমায় সব টা ।
— বলব না । অনেক বার বলেছি কেউ বিশ্বাস করে না আমায়। তুমিও করবে না জানি ।
আমি আমার মাকে খুন করেছি এটাই সত্যি। আমার কাছে মিথ্যে হলেও সবার কাছে সত্যি।এটাই সবাই বিশ্বাস করে । তুমিও করো আমি জানি। বার বার একই বুলি আওরাতে আওরাতে আমি ক্লান্ত। এখন আর ইচ্ছে করে না নিজের সাফাই নিজে গাইতে ।
.
.
শত চেষ্টা করেও অভ্রর মুখ থেকে কিছুই বের করতে পারলো না অবন্তী।
ব্যাপার টা প্রায় ভুলেই গেছিল সে। তবে আজকের কথার ধরন শুনে সে যা বোঝার অর্ধেক বুঝে গেছে । বোঝাটাই স্বাভাবিক। এতটুকু কথোপকথনে যে কেউ ই বুঝে যাবে।।
.
.
.
চলবে........................