আমি আমার মাকে খুন করেছি এটাই সত্যি। এটাই সবাই বিশ্বাস করে । তুমিও করো আমি জানি।
.
.
শত চেষ্টা করেও অভ্রর মুখ থেকে কিছুই বের করতে পারলো না অবন্তী।
ব্যাপার টা প্রায় ভুলেই গেছিল সে। তবে আজকের কথার ধরন শুনে সে যা বোঝার অর্ধেক বুঝে গেছে । বোঝাটাই স্বাভাবিক। এতটুকু কথোপকথনে যে কেউ ই বুঝে যাবে।
.
.
অভ্র সারারাত নিজেও রুম থেকে বেরোয় নি অবন্তী কেও বেরোতে দেয় নি। রাতের খাবার ওপরেই আনিয়ে নিয়েছে।
বেলকনি তেই বসে রইল সারারাত।
খাবার আনিয়ে নিলেও নিজে কিছুই খেল না ।
চোখের সামনে একজন না খেয়ে বসে আছে । এ অবস্থায় নিজে তো আর খাওয়া যায় না ।
.
কি করা উচিত এখন? তার পাশে কি একটু বসা উচিত?
আজকের দুঃখ তো কিছুটা একই রকম । একটু তো ভাগ করে নেয়াই যায় ।
আর তাছাড়া ঐ যে কেমন যেন মায়া ব্যাপার টা ।
.
ফ্লোরে খাবারের প্লেট সামনে রেখে পাশে বসে খাওয়ার ইশারা করতেই অভ্র পা দিয়ে প্লেট টা সরিয়ে দিল।
— ছি ছি । এটা কেমন আচরণ খাবারে কেউ পা দেয়? খাবেন না?
.
মাথা নাড়িয়ে না সূচক নির্দেশ করল।
.
— আমি খাইয়ে দেই?
অভ্র আবার মাথা নাড়ালো ।
.
— রেণু খালা কে ডেকে আনি? উনি খাইয়ে দিলে তো খাবেন?
.
অবন্তী রেণু খালাকে ডাকতেই উঠছিল। অভ্র হাত ধরে টেনে পাশে বসালো ।
— আমার পাশে একটু বসলেও কি খুব ক্ষতি?
.
.
অবন্তী উপায় না পেয়ে চুপচাপ বসে পড়ল ।
অভ্র যেন থমকে গেছে । চুপচাপ অবন্তীর হাত ধরে মায়ের কবরের দিকে চেয়ে আছে একদৃষ্টিতে।
.
ফজরের আযানের ডাকে অবন্তীর ঘুম ভেঙে গেল । অভ্রর কোলে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল কে জানে। অভ্র তখন ও ঘুমে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে বসে ।
.
অবন্তী সাবধানে হাত ছাড়িয়ে উঠে গিয়ে অজু করে নামাজ আদায় করে নিল। অভ্র কে আর ডেকে দিল না । ঘুমোচ্ছে ঘুমোক।
.
নামাজ শেষে সে চলে গেল রেণু খালার কাছে ।
রেণু খালা নামাজ শেষে জায়নামাজে বসে খুব মনযোগ দিয়ে কোরান তেলাওয়াত করছেন।কেউ ঘরে ঢুকেছে তা খেয়াল ই করেন নি ।
কি সুন্দর সুরে উনি তেলাওয়াত করতে পারেন । অবন্তী চুপচাপ খাটের এক কোনে বসে শুনছে সে তেলাওয়াত। এমন তেলাওয়াত শুনলে যে কারো মন ভালো হতে বাধ্য।
.
অভ্রর কাছে শুনেছে তিন কুলে আপন বলতে কেউ নেই রেণু খালার। মা গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছিল ওদের তিন ভাই বোনের দেখভাল করতে আয়া হিসেবে । অভ্র কোনদিনও তাকে আয়া মনে করেনি। মা ই মনে করে ।
বয়স সাতচল্লিশ কি আটচল্লিশ হবে ,কিন্তু দেখে চল্লিশের বেশি মনেই হয় না । এ বয়সেও কেউ চেহারায় এতটা লাবণ্য , ছিপছিপে দেহের গড়ন ধরে রাখতে পারে এটা অবন্তীর জানা ছিল না ।
পড়াশোনায় উচ্চমাধ্যমিক পাস হলেও রুচিবোধ, চাল চলন, কথা বার্তায় এযুগের উচ্চশিক্ষিত দের তুলনায় কোন অংশে কম নয় । সুন্দর ভাবে শাড়ি পড়ার হাতেখড়ি অবন্তী রেণু খালার থেকেই পেয়েছে।
.
.
— অবন্তী তুমি কখন এলে? ডাকো নি যে?
— এইত খালা কিছুক্ষণ।
— অভ্রনীল কাল খুব বেশি পাগলামো করেছে তাই না?
— খালা আপনি কিভাবে জানলেন?
—ঐ ঘটনার পর থেকে ও আমাকেই কখনো কিচেনে যেতে দেয় না । আর তোমাকে নাকি দেখেছে কাল কিচেনে। আমি কোরান পড়া শেষে শুনেছি পুরো ব্যাপারটা।। পরে দেখলাম রুমের দরজা ভেতর থেকে লক করে রেখেছে। তাই আর বিরক্ত করতে ডাকি নি। ভাবলাম তুমি সামলে নেবে। — হ্যা খালা পাগলের মতো কি সব বলল
—পাগলামো করাটাই স্বাভাবিক।তুমি বোঝ না ও তোমার প্রতি কতটা সেন্সেটিভ হয়ে পড়ছে দিন দিন।
— খালা সত্যিই কাল খুব বেশি সেন্সেটিভ হয়ে পড়েছিল। জানেন খালা, এতটা সেন্সেটিভ যে উনি রাগের বশে ,জেদের বশে বা ভুল করে আমাকে কথা দিয়ে ফেলেছেন...
.
কথা টা বলেই অবন্তী থেমে গেল । রাগের বা জেদের বশেই হোক বা ভুল করেই হোক শুভ্রর ব্যাপারে কথা তো সে দিয়েইছে।। খামোখা রেণু খালা কে এসব বলে নিজের বিপদ ডেকে আনা একদম উচিত নয় । রেণু খালা কখনো ই চাইবে না তার আদরের অভ্রনীলের সংসার ভাঙুক । যেমন ই হোক বিয়ে তো, সংসার তো । সে ঠিক ই অভ্র কে বুঝিয়ে সুঝিয়ে কথা ফিরিয়ে নিতে বলবে। তাকে কাছে রাখতে বলবে। এসব সাত পাচ ভেবে কথা টা এড়িয়ে গেল অবন্তী ।
.
— কি কথা দিয়েছে??
— না না তেমন কিছু না । আমার ওপর আর রাগ করবে না এটাই ।
— ও তো রাগ করা ছেড়েই দিয়েছে তোমার ওপর । আমার ছেলেটা কতটা স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে দিন দিন ।
— খালা আজকে উনার মায়ের গল্প বলুন না । আর তাছাড়া উনি সব সময় এমন কেন ভাবে?
— 'উনার মা' এটা আবার কেমন কথা? অভ্রনীলের মা তোমার মা নয়? শাশুড়ি কে নিজের মা ভাবা যায় না বুঝি?
— না না, আসলে তেমন কিছু নয় ।মানে আমার শাশুড়ি মায়ের
— হয়েছে হয়েছে ।আমি বলি কি একটু আপন করে নিতে শেখো না । ক্ষতি তো নেই ।
— হুম। খালা আপনি কি মায়ের নিজের বোন?
— না, বুঝতে পেরেছি তুমি তনু আপা আর আমার দুজনের ব্যাপারেই জানতে চাইছ তো?তাহলে আবার অভ্রনীলের কথা বাদ যাবে কেন? তাহলে তোমাকে শুরু থেকেই বলি কেমন?
সত্যি বলতে আমি তনু আপার তেমন কোন কাছের আত্নীয় না । দুসম্পর্কের বোন আর কি। আমি যখন নিজের সব কিছু হারলাম তখন তনু আপার মা মানে তোমার নানী শাশুড়ি আমাকে তাদের বাড়িতে আশ্রয় দেয় । তনু আপা বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে ছিল। আপার অনেক আগেই বিয়ে হয়ে গেছিল তাই তারা আমাকে নিজেদের মেয়ের মতো ই কাছে রাখতে লাগল।। আমি চাচা চাচির দেখভাল করতাম।ও বাড়িতে আমি মোটে ছিলাম দু বছরের মতো । আমি খেয়াল করতাম আপা বাড়ি আসলেই কান্নাকাটি করত। মাঝে মাঝে অর্পি অর্নি কে রেখে একাই রাগ করে চলে আসত। ভাইজান দু চার দিন পরে এসে নিয়ে যেত।
আপা আসলে একা ছিল ভীষণ। নিজের কথাগুলো বলার মতো ও কেউ ছিল না । ভাই বোন না থাকলে যা হয় আর কি।
আপা আস্তে আস্তে কিছু দিনের মধ্যে আমাকে আপন করে নিল। সব বলত আমায়। আপার সংসারের অশান্তির কারণ ছিল একটাই। একটা ছেলে জন্ম দিতে পারছিল না আপা। ছেলে না হলে সে বংশের হাল ধরবে কে? জমিদারি বংশ অথচ সে বংশ বিলীনের পথে একটা ছেলের অভাবে । আপার শাশুড়ি এসব নিয়ে সব সময় খোটা শুনাত। ভাইজানের ও একি কথা ছিল ছেলে চাই।পর পর চার চারটে মেয়ে ।
— চারটে?
— হ্যা বলছি তো শোন, অর্পি অর্নির পর আপা আরো দু বার কনসিভ করে । সনোগ্রাফির পর মেয়ে হবে শুনে দু বার ই ভ্রূণ মেরে ফেলা হয় । এত মেয়ে দিয়ে কি হবে? ছেলে চাই তো । আপা এসব নিয়ে খুব ই মন মরা হয়ে থাকত সব সময় ।
তারপর আপা আবার কনসিভ করল। আপার মনের ভেতর ভয় ঢুকে গেছিল। আবার যদি মেয়ে হয়। বাচ্চা টা পৃথিবী তে আসার আগেই ওরা মেরে ফেলবে। আপা নাওয়া খাওয়া একদম ছেড়ে দিল। সারাদিন নামাজে বসে থাকত, কোরান পড়ত। এ বাড়িতে আপার আদর যত্ন ও কমে গেছিল। খেল কি খেল না সে খোজ কারো নেয়ার তেমন সময় ই নেই। ভাইজান অফিস, ব্যবসা নিয়েই ব্যাস্ত।। অর্পি তখন ক্লাস এইটে অর্নি ক্লাস ফাইভ।
আপা ধীরে ধীরে নাওয়া খাওয়া ছেড়ে চিন্তায় চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়ল। চাচি তখন আমাকে এ বাড়ি পাঠালেন তনু আপার আর বাচ্চাদের দেখাশোনা করার জন্য । আমি আপাকে জোর করে করে খাইয়ে দিতাম। আপা সারাদিন কান্নাকাটি করত। এবার ও যদি ছেলে না হয়। ভাইজান যদি ছেলের আশায় আবার বিয়ে করে । আর এই বাচ্চাটাকেও যদি নষ্ট করায়।
তবে এবার আপার দিকে আল্লাহ মুখ তুলে চাইলেন। কয়েক মাস পর সনোগ্রাফিতে বোঝা গেল ছেলে হবে। আপা সেদিন ও খুশিতে সারাদিন কেদেছিল। আপার আদর যত্ন দিন দিন বাড়তে থাকল। শাশুড়ি মার ও প্রিয় হয়ে উঠল। কিন্তু আপা দিন দিন কেমন অসুস্থ হয়ে পড়তে শুরু করল। খামোখা কি কি সব দুশিন্তা করার জন্য । ছেলে সুস্থ মতো হবে কি না, সত্যি ছেলেই হবে তো এইসব।
তারপর যাই হোক অভ্রনীল আসল। সে ছেলের ও জন্মের সাথেই নিউমনিয়া। সে অবশ্য কয়েক দিনেই সেরে গেছিল। এদিকে ওর জন্মের পর আপা আরো অসুস্থ হয়ে পড়ল।আগের দুটো বাচ্চা সিজারিয়ান, তারপর আবার দুটো বাচ্চা এবোর্ট, এরপর অভ্রনীল ও সিজারিয়ান, আর সাথে মানসিক অশান্তি তো ছিল ই । এত ধকল আপা সামলে উঠতে পারেনি । ডক্টর একদম বেড রেস্ট দিল।।
আপা ওকে কোলেও নিতে পারত না ঠিক মতো । এত দুর্বল হয়ে পড়েছিল। আমাকে বলত তুই ওকে কোলে নিয়ে আমার পাশে বসে থাক। আমি সারাদিন অভ্রনীল কে কোলে করে নিয়ে আপার পাশে বসে থাকতাম। ওকে ঘুম পাড়াতাম, খাইয়ে দিতাম, খেলা করতাম।কান্নাকাটি করলে রাতের পর রাত ওকে কোলে নিয়ে হেটে বেড়াতাম । আপা সব সময় ই বলত আমার যদি কিছু হয়ে যায় আমার ছেলেটাকে তুই দেখিস রেণু।
বাড়ির সবাই ওর খেয়াল ই বেশি রাখতে শুরু করল । মায়ের কোল পেত না সারাদিন কাউকে না কাউকে কোলে নিয়ে থাকতেই হতো । তারপর ও সে ছেলে এত কান্নাকাটি করত।
এদিকে অর্পি অর্নি ওকে হিংসে করতে শুরু করল। ও ছেলে বলে সবাই ওকে বেশি আদর করে, ওর জন্য মা এত অসুস্থ হয়ে পড়েছে এসব ভাবত। ওরা বুঝতেই চাইত না অভ্রনীল খুব ছোট আর মায়ের আদরের বিকল্প হিসেবে আমাদের ওকে বেশি আদর যত্ন করতে হতো । ওরা যখন ওমন ছোট ছিল তখন ওদের ও সবাই এরকম ই দেখভাল করত এটাই ওরা বুঝত না ।অর্নি আরো বেশি হিংসে করত।এত দিন সে বাড়ির সব থেকে ছোট ছিল ।সব আদর সে পেত। এখন অভ্রনীল পায় এটা ও সহ্য ই করতে পারত না ।
তবে ভাইজান আর আপা ওদের ভালোবাসায় ও কোন কমতি রাখে নি।
অভ্রনীল ধীরে ধীরে বড় হতে লাগল। আপাও কিছুটা সুস্থ হতে লাগল। কিন্ত যত বড় হচ্ছিল ওর দুস্টামির মাত্রা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছিল । ওর দাদী ওকে তেমন শাসন করতে দিত না ।
ও খেলার তেমন সাথি পেত না । বাড়ির বাহিরে যাওয়া বারণ। কার না কার সাথে মিশবে।
অর্পি অর্নির সাথে খেলতে চাইলে ওরা ঘর থেকে বের করে দিত। ওদের ঘরেই ঢুকতে দিত না অভ্রনীলকে বলত মা আর রেণু খালার কাছে যা । ও ধীরে ধীরে যারা এ বাড়িতে কাজ করত তাদের ছেলে মেয়েদের সাথে মিশতে শুরু করল। খেলতে খেলতে ওদের সাথে বাড়ির বাহিরে চলে যেত। ওদের মতো করে কথা বলত, চাল চলন ও ওদের মতো হয়ে যেতে শুরু করল।
তনু আপা এসব একদম পছন্দ করত না । এদিকে ছেলেকে শাসন করাও মানা ।তাই আপা এ বাড়িতে কাজের লোক দের থাকা বন্ধ করে দিল। যার যতটুকু কাজ সে সেটুকু করেই বাড়ি চলে যাবে।
এতে কোন কাজ ই হলো না। অভ্রনীল লুকিয়ে লুকিয়ে বাড়ির বাহিরে চলে যেত। ওর খেলার সাথি চাই ই চাই । ওর অভিযোগ ওকে কেউ সময় দেয় না, বাবার সারাদিন কাজ , মা ও অসুস্থতার জন্য সময় দিতে পারে না তেমন , বড় দু বোনের অবহেলা, দাদীও মারা গেল ।আমাকে আপার দেখভাল, অর্পি অর্নির কাজও করতে হতো । আমি যখন ওসবে ব্যাস্ত থাকতাম ও ফাকি দিয়ে চলে যেত।
এসবের জন্য ভাইজান ওকে প্রায় ই রুমে লকড করে রাখতে শুরু করল। আপা ও মাঝে মাঝে একি শাস্তি দিত।ওকে মারা বারণ ছিল।ভাইজান ই বারন করত। । তাই এভাবেই শাসন করত। অভ্রনীল প্রথম প্রথম খুব ভয় পেয়ে যেত একা একা রুমে ওভাবে আটকে থাকতে।কান্নাকাটি করত। আপা ভাইজান ভাবত ভয় পেয়ে এসব অভ্যেস ছেড়ে দেবে ।কিন্ত না অভ্রনীল ধীরে ধীরে এটাতেও মজা পেতে শুরু করল।
ওর ও কারো ওপর রাগ হলে বা কাউকে পছন্দ না হলে চট করে দরজা বাহিরে থেকে লক করে দিত। ও এটা একটা খেলা মনে করত ।
অর্পি অর্নি কে তো বহুবার কারণ ওদের সাথে ঝগড়া ওর লেগেই থাকত, আমাকে , ভাইজানকে আর আপাকেও মাঝে মাঝে।।
স্কুলে থেকেও এটা ওটা অভিযোগ আসতে শুরু করল। মারামারি,রেজাল্ট খারাপ, টিচারের কথা না শোনা, স্কুলের ওয়াশরুমেও ও অনেককেই ওভাবে বাহিরে থেকে লক করে দিত।
আর সাথে জেদ তো আছেই। যখন যেটা চাই তো তখন ই চাই।
আপা ভাইজান দিন দিন ওকে নিয়ে অতিষ্ট হয়ে পড়ছিল। কিন্তু আদরের ছেলে। নিজেরাও তেমন শাসন করত না আবার সময় ও দিতে পারত না ওকে তেমন । ।
আর আমি তো আয়া আমার শুধু আদরের অধিকার, শাসনের অধিকার তো নেই ।
.
তখন অভ্রনীল ক্লাস ফাইভে উঠেছে সবে । সেদিন রাতে ভাইজান আর আপার মধ্যে খুব ঝামেলা হয়। অভ্রনীল দিন দিন বেয়াড়া হয়ে যাচ্ছে । আপা মানুষ করতে পারছে না ওকে ঠিক মতো এসব ব্যাপারে। কথায় কথায় কথা ভালই বেড়ে যায় । আপা ও ভাইজান কে দোষ দিতে থাকে ভাইজানের ও ছেলের প্রতি কর্তব্য আছে, এত রাত করে বাড়ি ফেরে, মাঝে মাঝে ড্রীঙ্ক্স করে আসে, ক্লাবে যায় জুয়া খেলতে ছেলে এসব দেখে আর কি শিখবে । আর তাছাড়া আপা ভাইজান কে অন্য সন্দেহ ও করত বেশি রাত করে বাড়ি ফেরার জন্য । তাছাড়া আপা বহুদিন বেশ অসুস্থ থাকায় নিজেকে অক্ষম মনে করতে শুরু করে। ভাবত ভাইজান বুঝি অন্য কারো সাথে.... এসব নিয়েও প্রায় ই ঝামেলা হত ওদের মধ্যে। সেদিন রাতে একটু বেশি ই ঝামেলা হলো । ভাইজান নাকি হাত ও তুলেছিল আপার ওপর ।
সকাল বেলা অভ্রনীল বায়না ধরল স্কুলে যাবে না । কারণ হিসেবে বলল সারারাত বাবা মায়ের ঝগড়া মারামারি দেখেছে। এখন নাকি সে ঘুমোবে।
এসব শুনে আপা ভাইজান এর ওপর যত রাগ ছিল সব অভ্রনীলের ওপর দেখাতে লাগল। ঐ দিন ই আপা ওর ওপর প্রথম হাত তোলে । পরে অবশ্য ভাইজান এসে থামায়।
.
তবুও ওর জেদ তো জেদই। স্কুলে গেলই না। সেদিন আবার ওর স্কুলের ফিস দেয়ার ডেট ছিল ।তাই আপা আমাকেই পাঠিয়ে দিল ফি'স দিয়ে আসতে।
ওর স্কুল দশটায় । তাই আমি ন'টার পর পর ই বেরিয়ে যাই । দশটা নাগাদ পৌছে ফি'স দিয়ে আসব। অর্পি ভার্সিটিতে, অর্নি কলেজে, ভাইজান ও অফিসে চলে যায় এরপর
। বাড়িতে অভ্রনীল আর আপা একাই ছিল ।
এখন এর পরের সময়ের মধ্যে ওদের মধ্যে আবার কিছু হয়েছিল কি না কে জানে। অভ্র তো বলে ওর মা নাকি পরে সরি বলেছিল । আর ও নাকি তবুও রাগ করে ছিল। তাই আপা ওর পছন্দের কিছু রান্না করতে গেছিল কিচেনে। বাচ্চারা রাগ করলেই আপা ওদের পছ্ন্দের খাবার বানিয়ে দিত।
.
এদিকে অর্নি সেদিন বাড়িতে কোন কারণে বেশ আগেই ফিরে আসে। এসে ও দেখে পোড়া গন্ধ বেরিয়ে গেছে। অভ্রনীল কিচেনের দরজার সামনে দাড়িয়ে আছে । দরজা লক করা ।তারপর অর্নি দরজা খোলে, ততক্ষণে গ্যাস সিলিন্ডার ব্লাস্ট হয়ে যা হবার হয়ে গেছে
.
— খালা এসব সত্যি? সামান্য কারণে উনি? মানলাম মা মেরেছে তাই মায়ের ওপর রাগ করে না হয় অভ্যেস মতো লকড করেই দিল । কিন্তু আগুন লাগার ব্যপার টা?
.
— হুম,অভ্রনীলের আগুনের নেশা ই ভালোই ছিল বলা চলে । ছোট খাট পোকা মাকড় মারলেও সেগুলো খেলার ছলে আগুনে পোড়াত ।
— খালা পোকা মাকড় আর মা কি এক হলো নাকি? ছোট বেলায় তো আমিও মাঝে মাঝে মশা মেরে কয়েলে পোড়াতাম আমাকে কামড় দেয়ার শাস্তি স্বরূপ।
.
— সেটাই তো মা,, ওর মাথায় যে আসলে কি চলছিল তখন কে জানে।
ও তো বলে ও নাকি ঘুমিয়ে পড়েছিল। আপার চিতকার শুনে ওর নাকি ঘুম ভেঙে যায় । নিচে গিয়ে দেখে কিচেন বাহিরে থেকে লক করা । ভেতরে আপা চিতকার করেই যাচ্ছে দরজা খোলার জন্য । অভ্রনীল নাকি চেষ্টা ও করেছিল লক খোলার পারে নি।
— উনি লক খুলতে পারল না অর্নি আপু সাথে সাথে কিভাবে খুলল?
— কিভাবে খুলবে ওর কাছে কি চাবি ছিল নাকি? তালা তো চট করেই দেয়া যায় । কিন্ত চাবি ছাড়া কি খোলা যায়? চাবি তো তনু আপার আচলে থাকত। আর চাবির ডুপ্লিকেট কপি ওপরে আপার ঘরেই থাকত। অর্নি জানত সেটা। অভ্র ছোট মানুষ অত কিছু তো আর জানত না । রাগের বশে হয়ত লক করে দিয়েছে মাকে। ভেতরে এত বড় এক্সিডেন্ট ঘটে যাবে হয়ত আন্দাজ ও পায় নি। ছোট মানুষ তালা ধরে পরে টানা হেচড়া করলেই কি খোলে বল?
আবার অর্পি অর্নি তো এটাও সন্দেহ করে গ্যাসের লাইনও ও ই লিক করে রেখেছিল। তাছাড়া সকালে রান্না হলো তখন কিছু হলো না। আর ওর ছোট খাট জিনিস পত্র পোড়ানোর স্বভাব তো ছিল ই।
হয়ত বুঝতে পারে নি মা মরে যাবে।
আর পরে ভয়ে হয়ত সেসব স্বীকার করছে না ।
— বাড়িতে অন্যান্য কাজের লোক ছিল না?
— না ওসময় কারো তেমন কারো কোন কাজ থাকত না ।তাই কোন কাজের লোক বাড়িতেও থাকত না ।
তারপর আমি বাড়ি ফিরে দেখি আপার পোড়া দেহ নিয়ে এম্বুলেন্স উঠছে অর্পি। বাড়িতে বেশ ভিড় জমে গেছে ।আর অর্নি তো বাড়ির ভেতর অভ্র কে মেরেই যাচ্ছে । তাও ও স্বীকার ই করছে না বার বার একি কথা বলছে কিচেন নাকি আগে থেকেই লক ছিল। ও নাকি খুলতে গেছিল।
— বাবা তখন ও আসেনি?
— না, ভাইজান অনেক পরে এসেছিল । মিটিং ছিল নাকি জরুরি। টেলিফোন রিসিভ করতে পারে নি । একারনে এসব ঘটনা ও পরে জানতে পেরেছিল।। এসেই ভাইজান ও ওকে ইচ্ছে মতো মারতে শুরু করল সব শুনে। ঐ দিন ই প্রথম বাবা,, বোন সবার হাতে মার খেয়েছিল। কিন্তু না তবুও এক কথা ও নাকি কিছুই করে নি। ততক্ষণে কিচেনের আগুন নেভানো শেষ । ও রুমে জানলা ছিল না , দরজা ও লক ছিল। তাই আগুন বাড়ির ভেতর তেমন ছড়ায় নি। এত মারার পর ও যখন স্বীকার করল না ভাইজান তখন ওকে ঐ পোড়া কিচেনেই বন্ধ করে রাখল। আমাদের ও কড়া ভাবে বলে দিল আমরা যেন না খুলে দিই। ওর এসব লক করে রাখার মজা সারা জীবনের মতো চুকিয়ে যেন যায় ।
এদিকে আপার অবস্থা খুব ই খারাপ ছিল। কথা ই বলতে পারে নি। দু দিন বেচে ছিল ওভাবেই। আমি সারাদিন আপার পাশে বসে থাকতাম।এ পৃথিবীতে আপা ই আমার আপনজন হয়ে উঠেছিল। সেই আপাকে চোখের সামনে এভাবে কস্ট পেতে দেখতে একদম ভাল লাগত না আমার । আপার পাশে বসে কান্নাকাটি করতাম সারাদিন। আপা ইশারায় মানা করত কাদতে। তা দেখে আমি আরো বেশি কেদে ফেলতাম।
কি সুন্দর ছিল আপার চেহারা ,গায়ের রং, অর্পি আর অভ্রনীলের মতো ।। অথচ সে রং চেহারা কি বীভতস্য হয়ে গিয়েছিল। যে কেউ ভয় পাওয়ার মতো । শেষ দিন ইশারায় আমার কাছে অভ্রনীল কে দেখার কথা বলল। আমি ভাইজান কে বললাম এবার অন্তত ছেলেটা কে মায়ের কাছে আসতে দিন । এদিকে অন্ধকার পোড়া কিচেনে ওভাবে দেড় দিন আটকে থেকে ভীষণ ভয় পেয়ে গেছিল অভ্রনীল । খাবার যা দেয়া হত কিছুই খেত না । জ্বরে উঠতেই পারছিল না। আমি ওকে কোন মতো কোলে করে নিয়ে আপার কাছে আসলাম । ও আপার ঐ বিভতস্য চেহারা দেখা মাত্রই সেন্সলেস হয়ে যায় ।
আপা সেদিন রাতেই মারা গেল। মারা যাবার খানিক্ষন আগে আমাকে কেবল ঠোট নাড়িয়ে ইশারায় বলেছিল আমার অভ্র কে দেখিস । ও খুব ছোট । আমি আপাকে কথা দিয়েছিলাম তার ছেলেকে আমি আগলে রাখব।
.
— পুলিশি কেস হয় নি?
— না এ বাড়িতে এসবের নিয়ম নেই। বাড়ির বৌ এর লাশ পোস্ট মর্টেম হবে অন্যরা কাটা ছেড়া করবে । আর তাছাড়া সব কিছু মেলালে দোষ অভ্রর ঘাড়েই চাপে ও যতই স্বীকার না করুক। সেজন্য কেউ ই আর কেসের দিকে এগোয় নি।
— ওহ
— হুম। কিন্তু মা মরে যাবার পর অভ্র আরো অসুস্থ হয়ে পড়ল। মা মারা গেছে এটা ও মানতেই পারছিল না । আর সবাই ওকে যেভাবে দোষ দিচ্ছিল যে ওর জন্য ই এসব হয়েছে । ও ই মেরে ফেলেছে ।এসব শুনে শুনে আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ত। বার বার সেন্সলেস হয়ে পড়ত।ওকে কেউ বিশ্বাস করে না বার বার একই কথা আওরাত। রাতেও উঠে গিয়ে আপার কবরের পাশে বসে থাকত ।বাড়ির সবার নামে নালিশ দিত আপাকে। তারপর নতুন বায়না ধরল নিজের রুমে থাকবে না । এখন তোমরা যে রুমে থাক ঐ রুমে থাকবে ও রুমের বেলকনি থেকে মায়ের কবর ভালো ভাবে দেখা যায় ।
ওর পাগলামো ধীরে ধীরে বাড়তেই থাকল । এবার নিজেই রুম ভেতর থেকে আটকে একা একা থাকতে শুরু করল।
ডক্টর বলল ওর মায়ের বিকল্প কাউকে চাই। আমি একদম তনু আপার মতো আচরণ করতাম ওর সাথে । ও আস্তে আস্তে আমাকে অবলম্বন ভাবতে শুরু করল। ধীরে ধীরে একটু স্বাভাবিক হলো ।
অর্পি ও আগের মতো রইল না। বড় বোন হিসেবে ওকে আগলে নিল। অর্পি ও ধীরে ধীরে ওর মা হয়ে উঠল।
তারপর অর্পি স্কলারশিপ পেল ইউ কে তে। এদিকে অভ্র তো এক বছর হলো স্কুল পড়াশোনা ছেড়েছে। তখন ও মানসিক ভাবে বেশ অসুস্থ। অর্পি ঠিক করল ওকেও নিয়ে যাবে । এসব থেকে দূরে থাকলে হয়ত সব ভুলে গিয়ে ঠিক হয়ে উঠবে পড়া তেও মন দিতে পারবে আবার । ট্রিটমেন্ট ও ভাল পাবে।ভাইজান ও মত দিল।
তারপর অর্পি ওকে নিয়ে গেলো ইউ কে। কয়েক বছর পর আহমেদ এর সাথে বিয়ে । অতপর শিফট করল জার্মানি । অভ্র কে তখন ও ওদের সাথেই রাখল।। তারপর ওর পড়াশোনা শেষ হলো । ভাইজান ওকে জোর করেই দেশে ফিরিয়ে আনল। বাড়ির ছেলে এভাবে আর কত দিন বাহিরে থাকবে।
তারপর তো দেখছ ই এখন কার অব্স্থা।
— হুম সব ই তো বুঝলাম। কিন্তু মাকে আসলেই কি উনি মেরেছে? ভুল করেই হোক আর ইচ্ছে করেই হোক?
— সেটা তো মা এখনো সবার অজানা । কোত্থেকে যে কি হয়ে গেল ।এখন তো আবার বলে ও ই নাকি মেরেছে
— সেটা তো অন্যরা বিশ্বাস করে না বলে জেদ করে বলে।
কাল রাতের কথার ধরনে আমার এটুকুই মনে হয়েছে। জানিনাহ। তবে আমি আবার উনাকে জিজ্ঞেস করব। বার বার জিজ্ঞেস করব। আমার কাছে কেউ কিছু চাইলে তা যদি আমার সাধ্য মতো হয় তবে আমি তাকে তা দিতে ভালবাসি। আর উনি আমার কাছে থেকে বিশ্বাস চেয়েছেন।
.
.
.
চলবে.............................