পরিণয়ে পরিপূরক - পর্ব ০৮ - স্পৃহা নূর - ধারাবাহিক গল্প


আমার কাছে কেউ কিছু চাইলে তা যদি আমার সাধ্য মতো হয় তবে আমি তাকে তা দিতে ভালবাসি। আর উনি আমার কাছে থেকে বিশ্বাস চেয়েছেন।
.
.
অভ্র অবন্তির কাছ থেকে চারটে জিনিস চেয়েছিল।
আস্থা, বিশ্বাস, ভরসা আর হয়ত ভালবাসা।

শেষটা সে দিতে পাবে কি না জানে না, শেষ টা হয়ত বাধা পড়ে আছে অন্য কারো কাছে। তবে প্র‍থম তিনটে তো দেয়াই যায়। এসবের ক্ষেত্রে ধরা বাধার কোন প্রশ্ন নেই। 
শেষ টার ক্ষেত্রে ধরা বাধার একটা প্রশ্ন থেকেই যায় ।
.
.
সকাল থেকে অভ্রর আবভাব বা চাল চলনে মনেই হচ্ছে না গতকাল রাতে মানুষটা এতটা ভেঙে পড়েছিল কি ছোট্ট একটা ব্যপার নিয়ে ।বরং অন্য দিনের চেয়েও বেশি স্বাভাবিক লাগছে তাকে । 
দু হাতের দুটো আপেল পালাবদল করে খেতে খেতে অভ্র টিভির স্ক্রিনে খুব মনোযোগ দিয়ে মুভিটা দেখছে। মুভির নাম 'দ্যা প্রেস্টিজ' ।
এক বার ডান হাতের আপেলে এক কামড় দিচ্ছে তারপর আবার বাম হাতের।
.
.
— ছিহ। আপনার মাঝে তো দেখছি কোন কৃতজ্ঞতা বোধ ই নেই আমি একটা মানুষ সারারাত আপনি খেলেন না বলে না খেয়ে বসে থাকলাম।আর আপনি সকালে নাস্তা করার সময় আমাকে এক বার ডাক ও দিলেন না?। আর কি নোংরা আপনি । এখন আবার বাম হাত ডান হাত দু হাতেই আপেল খাচ্ছেন তাও মে বি আপেল গুলো না ধুয়েই। আপনার পেটে কৃমি হয় না?

.
অভ্র টিভির স্ক্রিনে চোখ রেখেই বিড় বিড় বলল,
— এইত শুরু হলো অশান্তি। 
— এই কি বললেন আপনি? আমি অশান্তি? আর আপনি যে অভদ্রর মতো একটার পর একটা আচরণ করছেন সকাল থেকে?
.
অভ্র বাম হাতের অর্ধেক খাওয়া আপেল টা অবন্তীর দিকে এগিয়ে দিল।
— হাঙ্গার ভালো ভালো মানুষ কেও বদলে দেয়। তোমার যে খিদে পেয়েছে বুঝতে পেরেছি তো । এত খিটমিট করার কি আছে আমার সাথে?। নাও অর্ধেক রেখেছি তোমার জন্য ।
— আপনি কি আমাকে অপমান করছেন?
— না তো । আসো মুভি দেখি।
— কি মুভি এটা? ওহ আচ্ছা দ্যা প্রেস্টিজ । এইটা আমি দেখেছি অনেক আগে । আমি কিন্তু টুইস্ট টা জানি। বলে দিই?
— 7th টাইম দেখছি। আশা করি কানের কাছে আর প্যান প্যান করবে না ।
— এত বার দেখছেন তাও এত মনোযোগ দেয়ার কি আছে? জানেন ই তো পুরো কাহিনি টা । যত্ত সব আজগুবি প্রতিদ্বন্দীতার কাহিনি। বাস্তবে কি আর এরকম মানুষ কপির মেশিন পাওয়া যায়? নাকি ম্যাজিক এর নেশায় , অন্যকে ডিঙানোর আশায় নিজেই নিজের একটার পর একটা কপি মেরে ফেলা যায়? দুটো ম্যাজিশিয়ান যে নিজের নাম যশের আশায় , একে অন্যকে হারানোর নেশায় এত নিচে নামতে পারে ।
— সত্যি নিজের কপি নিজে করা গেলে তো ভালোই হত । তবে এ মুভির মতো আমি কিছু করতাম না ।আমি আমার অনেক গুলো কপি বানাতাম। আর আমি আমাকেই বার বার মেরে ফেলতাম । মজা না? সবাই আমাকে আমার মায়ের খুনি না বলে বলত অভ্রর খুনি অভ্র নিজেই। কিন্ত কোন অভ্র আসলে কোন অভ্রকে মেরেছে সেটা কেউ বুঝত না ।
.
অভ্র বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে অট্টহাসি দিতে দিতে কথা গুলো বলতে লাগল।
.
— আবার এসব আবোল তাবোল কথা বলছেন? দেখতে হবে না এসব আজগুবি মুভি। যতই মাস্টারপিস হোক। এসব দেখে দেখে মাথাটা আরো গেছে। 
 .
অবন্তী রিমোট নিয়ে টিভিটা অফ করে দিতেই কি যেন মনে হয়ে আবার পেছন ফিরে অভ্রর দিকে তাকালো।
.
— এই আপনি কোন মুভি থেকে ইন্সপায়ার্ড হয়ে আমাকে বিয়ে করেছেন বা কিনে নিয়েছেন বলুন তো? আমি রেণু খালার থেকে আপনার জেদ আর পাগলামো দুটো সম্পর্কেই যথেষ্ট ধারনা পেয়েছি। জেদ করে যে আমাকে কিনে নিয়েছেন তা ভালোই বুঝতে পেরেছি। কিসের জেদ ,কার ওপর জেদ আপনার? শুভ্রর ওপর নয় তো??? তাহলে আবার যে কাল কথা দিলেন? ফিরিয়ে দেবেন আমায়? মুক্তি দেবেন আমায়? শুভ্র কেই পাব আমি?সত্যি করে বলুন তো জেদ টা কার ওপর?
.
অভ্র চট করে উঠে দাড়াল।।
— কথা দিয়ে ফেলেছি বুঝি?
— মনে নেই আপনার? নাকি কথা না রাখার ফন্দি আটছেন?
— কথা যখন দিয়েছি কথা তো রাখতেই হবে । আমি কথা রাখতে ভালোবাসি। ও হ্যা শোন...আমার কারো প্রতি কোন জেদ নেই । আমি শুধু কান্না ভালোবাসি,কান্নার রং ভালোবাসি। কি সুন্দর করে কাদো তুমি। একদিন সারাদিন আমার জন্য কাদবে? আমি চেয়ে চেয়ে দেখব । আর তোমার চোখের অশ্রু গুণব।
.
অবন্তী এসব কথার কোন উত্তর খুজে পায় না। অবাক চোখে অনেক্ষন তাকিয়ে থাকে তার দিকে। চোখ দিয়ে কেন যেন দুফোটা জল ও গড়ে । অভ্র সেই জল গড়া দুচোখে ভালোবাসার শুদ্ধতম স্পর্শ একে দেয়। অবন্তী কোন এক মোহে বাধা দিতেও নিজের ভেতর থেকে বাধা পায়।
.
.
আর যা কিছু হই বা না হই
পরের জন্মে তিতাস হবো 
দোল মঞ্চের আবীর হবো 
শিউলি তলার দূর্বো হবো 
শরতকালের আকাশ দেখার 
অনন্তনীল আকাশ হবো 
আর কিছু হই বা না হই
তোমার প্রথম পুরুষ হবো 
মনে থাকবে?
.
.
অভ্র কবিতাও বলতে পারে?
.
বেশ খানিক্ষন পর কবিতা আর স্পর্শের রেশ কাটা মাত্র চোখ মেলে তাকিয়ে অবন্তী নিজেকে একা আবিষ্কার করে । সামনের মানুষটি চলে গেছে অনেক্ষন।
.
.
— কি সুন্দর করে হাসো তুমি। তোমার ঐ চোখের হাসি বড্ড ভালোবাসি গো পিচ্চি।
.
অবন্তী আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজের দু চোখের দিকে নিজেই অপলক তাকিয়ে আছে । আর দুটো মানুষের দু রকম কথার সংমিশ্রণ নিজের চোখে খুজে পাবার চেষ্টা করছে ।  
মানুষ দুটো আলাদা, আকর্ষণ এক জায়গাতেই। তবে আকর্ষণের ব্যখ্যা আলাদা।
মন না চাইলেও চোখ এখন দ্বিতীয় আকর্ষণ কেই প্রাধান্য দিচ্ছে। অনবরত অশ্রু ঝরছে । হ্যা চোখ বুঝি কারো অপেক্ষা করছে সে কখন এসে অশ্রু গুনবে। কিন্ত মন তো চায় অন্য কেউ আসুক তার চোখের হাসির কম্পন গুনুক।
.
.
দুরত্ব নয়, দিনের পর দিন যোগযোগহীনতা একটা সম্পর্কে মরিচা ধরাতে সক্ষম। আর তা যদি হয় প্রণয়ের সম্পর্ক।
 তবে পরিণয় ব্যাপারটা আলাদা। এটা আল্লাহর দেয়া বিশেষ নেয়ামত । এ সম্পর্কের শক্তি অনেক বেশি থাকে। দুরত্ব, যোগাযোগহীনতা সব কিছু তুচ্ছ এসম্পর্কে, যদি মনের বন্ধন অটুট থাকে।
.
.
সে বার পহেলা বৈশাখে মেয়েটা বেরোনোর প্রথম অনুমতি পায় বাড়ি থেকে। তাও মা কে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে ,বান্ধবীদের সাথে বেড়াতে যাবার মিথ্যে নাম করে । কারণ একটাই ভাগ্যক্রমে এবার শুভ্রর ছুটি পরেছে এ মাসেই।  
তবুও কোয়ার্টার থেকে রওনা দিলে আসতে আসতে ঘণ্টা চারেক। এটা তাদের প্রথম কোন উতসব এক সাথে পালন করা । 
অবন্তী সকাল থেকে মায়ের লাল শাড়িটা পড়ার চেষ্টা করছে । কিন্তু কুচিগুলো বড্ড বেসামাল।পরে মা ই অবশ্য ঠিক করে দিয়েছে। হাতে পায়ে লাল আলতা রাঙিয়ে নিল নিজেই । সাথে ম্যাচিং করা পোড়া মাটির গহনা পড়ে নিল। চুলে খোপা বাধবে নাকি এলোকেশি বেশে থাকবে সেসব ভাবতে ভাবতেই বান্ধবীরা চলে এলো নিতে। তাই চুল গুলো আর বাধা হলো না।
.
মেয়েটা সারাদিন হাতে পাঞ্জাবির প্যাকেটটা নিয়ে অপেক্ষা করল কখনো দাড়িয়ে কখনো বসে । মানুষ টার আসার কোন নাম ই নেই।বন্ধুরাও অপেক্ষা করতে করতে নিজেদের মতো ঘুরতে চলে গেল । 
.
সে এক জায়গায় ই ঠায় রইল। শুভ্র এশহর তেমন চেনে না। এসে যদি খুজে না পায়। এখানে অপেক্ষা করবে এমন ঠিকানা ই দিয়েছিল।
সকাল থেকে এক বার ফোন করেও খোজ নেয়া হয় নি। কাল রাতে শেষ বার কথা হয়েছিল।  
অবন্তী পার্স থেকে ফোন বের করতেই ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠল ভোর বেলায় আসা ম্যাসেজ,
.
সরি, 
কাল দেখা হবে না পিচ্চি। আমাকে মাঝ পথ থেকেই আবার ফিরতে হচ্ছে। জানি মন খারাপ করবে না । মানিয়ে নিতে শিখে গেছ তো?
Pray for my next mission..catch you soon...
শুভ্রনীল 
.
.
সকাল থেকে মেয়েটা এত এক্সাইটেড আর নিজেকে নিয়ে ব্যাস্ত ছিল এক বার ফোন হাতে নিয়ে চেক ও করার সময় পায় নি। কি আর করার ম্যাসেজ টা পড়ে চারদিকে শূন্যতার দৃষ্টি তে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। প্যাকেট থেকে পাঞ্জাবি টা বের করে নিজ হাতে করা সুতোর বুনন গুলো নিজেই ছুয়ে দেখল। অনলাইন থেকে কত খুজে খুজে পাঞ্জাবিতে করা সুতোর কাজের নকশা পছন্দ করে নিজেই আকিয়েছিল। তারপর সাদা সুতো দিয়ে রাত জেগে জেগে নকশা গুলো লাল পাঞ্জাবির বোতাম গুলোর পাশে সেলাই করেছিল। নিজ হাতে নকশা করা পাঞ্জাবিটা দেবে বলে। 
 পাঞ্জাবিটা কুরিয়ার করে দিয়ে ছোট্ট একটা টেক্সট পাঠিয়ে দিল ,
.
প্রিয়,
কুরিয়ার করেই ভালোবাসা পাঠলাম,
ফেরার দিনে উঠিয়ে নিও। 
.
অবন্তী জানে ফোন এখন সুইচড অফ। মিশন শেষে ফোন অন হবে। টেক্সট টাও তখন পৌছুবে।
.
.
.
চলবে...........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন