অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ৩৩ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


সুমনাকে ক্লাসের বাইরে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভিনার গলা শুকিয়ে গেলো।ওর চোখ দেখে যা বোঝা যাচ্ছে তা হলো 'খুব তো ঘুরলা কালকে,আজকে একটু প্যাদানি না খাইলে হবে?'

চুপচাপ ক্লাসে গিয়ে বসলো ভিনা।আরশির জন্য অপেক্ষা করছে। সারাবছর কলেজে লক্ষ্মী বাচ্চাটা থাকার পর,এই সময়ে যাদি গার্জিয়ান কল করে,তাও আবার কলেজ বাঙ্ক দেয়ার জন্য,তাহলে কয়েক মাস পরে না,আজকে সন্ধ্যায়ই বাড়ি ছাড়তে হবে।

ভিনার ব্যাগটা নিচে ফেলে আরশি পাশে বসলো

-কি রে,চেহারা এত শুকনা কেন?

-সুমনা কালকে আমাদের কলেজ বাঙ্ক দিতে দেখে ফেলেছে।

-বলিস নাই কেন আগে?

-সবাই এঞ্জয় করছিলো,তাই..

-তুইও এঞ্জয় করছিলি,এটাই আসল কথা।

-এখন কী করবো?

-কী করবি মানে?

-গার্জিয়ান কল করবে তো।

-সাস্পেন্ড ও করতে পারে।

-আরশি....

-কী?

-তুই বুঝছিস না। 

-কিছুই হবে না।

-হবে।

-বললাম তো হবে না।চুপ করে থাক।

ভিনার আত্মা শুকিয়ে গেলো রিতু মিস কে দেখে।প্রথমে ক্লাসে এসেই রোল কলের আগে ওকে দাঁড়া করালো।

- কী ব্যাপার ভিনা,কালকে আসো নি কেন?তুমি তো পুরা কলেজ এর সময় একটাদিন ও গ্যাপ দাও নাই।গতকাল না দিলে তুমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট এ্যটেন্ডেন্সের জন্য প্রাইজ পেতা এ্যনুয়াল প্রাইজ গিভিং সেরেমোনিতে।আসলে না কেন?

-কালকে অসুস্থ ছিলাম ম্যাম।

ভিনার হাত ঠান্ডা হয়ে এসছে।মনে হচ্ছে এক্ষুনি সুমনা দাঁড়িয়ে বলে দিবে কালকে ওরা বাংক দিয়েছে।

-কী হয়েছিলো?

-মাইগ্রেনের ব্যথা (মিথ্যা কথা,জীবনেও মাইগ্রেন ছিলো না)

-মাইগ্রেনের ব্যাথা তো একদিনে ঠিক হয় না। বেশ কয়দিন থাকে তো।

-কালকে বেশিই ছিলো,আজকে কম আছে। 

-আহা,ঠিক আছে।বসো।

ভিনা বসা মাত্রই আরশি আয়েশ করে হাত রাখলো ওর কাধে।

-কী,বললাম না কিছু হবে না।

-তুই জানলি কীভাবে কিছু হবে না। 

-তুই ছোট মানুষ বুঝবি না।

মনে মনে সুমনার প্রতি কৃতজ্ঞ হলো ভিনা।মেয়েটাকে যতটা ভয়ানক ভেবেছিলো,ততটাও না সে।ভালোই আছে বলতে গেলে।

টিফিন টাইমে ওয়াসিম এসেই ভিনাকে জিজ্ঞেস করলো,

-সমস্যা হয়েছে কোনো?

-কী সমস্যা?

-সুমনা বলেছে কিছু?

-তুই জানলি কীভাবে সুমনার কথা?

-আরশি দেখেছিলো কালকে ওকে। 

-কী!মেয়েটা আমাকে বলে নাই!ইচ্ছা করে না চড় মেরে ফেলে দিতে?

-তুই প্যানিক হবি দেখেই বলে নাই।

-যাই হোক,বেঁচে গেছি কোনোমতে। মেয়েটা ভালোই কিছু বলে নাই।

চোরের মত আরশি যে কখন এসে পেছনে বসেছে টেরই পায়নি ভিনা।

-ইশ রে আমার ভালো মেয়ে!অনেক দরদ তাই না ভিনা?

-অন্তত আজকের জন্য হলেও তোর গ্রেটফুল হওয়া উচিৎ সুমনার প্রতি।

-তোমার সুমনা ঠিকি বলে দিত,আরো বাড়িয়ে,যদি না ওয়াসিম এসে ওকে মানা করে যেত।

-যাক ভালো,ওয়াসিমের কথা শুনেছে তাহলে।

-ওয়াসিমেরই কথা শুনেছে।

-মানে?

-বলেছি না তুই ছোট,বুঝবি না।

ওয়াসিমের পুরো চেহারা লাল হয়ে গেলো।ভিনা সব বুঝতে পেরে প্রায় চিৎকার দিয়ে উঠলো

-ওয়াসিম!সুমনা ওয়াসিম কে পছন্দ করে!

-মাইক এনে দেই তোকে?এত আস্তে করে কেন বলছিস,পুরা ক্লাসে জানায় দে। (ওয়াসিম)

-দেখ দেখ,ওয়াসিমের কত শখ!(আরশি)

-আমার মাথায় তো আসেই নাই এগুলা।(ভিনা)

-আসে নাই ভালো ছিলো।তিল থেকে তাল বানানো লাগবে না এখন।(ওয়াসিম)

-এখন বুঝছি,সুমনা আরশির পেছনে কেন এত লেগে থাকতো।আই সি...(ভিনা)

-স্টার প্লাস মাইয়া একটা।এইটুক বয়সে হিংসামি করে। দেখিস,এই মেয়ের সতিনের ঘর করতে হবে।(আরশি)

-কী সব আবোল তাবোল বলছিস,বাদ দে। (ভিনা)

-হেহ্,হিন্দি সিরিয়াল আর কোরিয়ান ড্রামা দেইখা এরা লুতলুতামি শিখে।এরও আগে শিখে হিংসা।বয়সটাই খারাপ!(আরশি)

হ্যাঁ, এই বয়সে সবই সম্ভব।এই বয়সে কারো কাছে দুনিয়াটা রঙিন থাকে,আবার কেউ বাস্তবতার ধাক্কায় বয়সের আগেই সব উপলব্ধি করে ফেলে।তাই একি বয়সের হলেও,কেউ হয়ে যায় আম্মা টাইপ মানুষ,যার সবকিছুতে বিরক্তি,বিশেষ করে নিজের বয়সের ছেলেমেয়েদের প্রতি। আর কেউ থেকে নিতান্তই ফ্যান্টাসির জগতে বাস করা টিনেজার।

টিফিন টাইম শেষ হওয়ার পর ওয়াসিম চলে গেলো।

-আরশি,জানিস,তুই যখন বেশি ক্ষেপে যাস না,নেটিভ ল্যাংগুয়েজ এ কথা বলা শুরু করিস।
  
আরশি ভিনাকে ধমক দিলো।

-জানি।কিন্তু তোগো মত বাংলিশ বলি না।সরে বস এখন।


বারান্দায় বসে মুনা আর সোহেল চা খাচ্ছে বিকেলে।এই সময়টার জন্য কত দিন অপেক্ষা করেছিলো মুনা।শাড়ি পড়ে চুল খুলে দিয়ে সোহেলের কাধে মাথা দিয়ে বসেছে সে।সোহেলের মনে পড়লো শিউলিও এভাবে বসতো তার পাশে।সবই এক আছে,শুধু ঘ্রাণ বদলে গেছে পাশে থাকা মানুষটার।

-তোমার মেয়েটা এখনো আমাকে ঐভাবে এক্সেপ্ট করেনি।

-সময় দাও,আমাদের সম্পর্কে যেমন সময় লেগেছে,এখানেও লাগবে।

-কিন্তু ভিনা তো ছোট না।ও যদি আমার সাথে কো অপারেট না করে,আমি কীভাবে সম্পর্ক সহজ করবো।জোড় করে তো আর চাপিয়ে দেয়া যায় না।

-প্রথমেই এটা তোমাকে মেনে নিতে হবে যে ভিনা তোমাকে পুরোপুরি শিউলির জায়গা দিবে না।তুমি এই আশা করো না।কিছু জায়গা নির্দিষ্ট মানুষের জন্য বরাদ্দ করা থাকে,চাইলেও সেই জায়গা দেয়া যায় না।শুধু চেষ্টা করবে সম্পর্কটা সুন্দর করার।একি ছাদের নিচে রেষারেষি করে থাকা যায় না।সেই জন্য।

-আমি....আমি কী কখনো শিউলির জায়গা পাবো না? 

সোহেল চুপ করে থাকলো।কথা বাড়ালো না।

মুনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাইরে তাকালো।যা পেয়েছে তাও কম কী।এর বেশি চাওয়াটা লোভের পর্যায়ে পড়ে যাবে,এই বলে নিজেকে বুঝ দিলো।

কলেজ থেকে এসে মোমেনা কে এক কাপ চা বানাতে বলে নিজের ঘরে এসে চলে আসলো ভিনা।হটাৎ করে জীবন নিয়ে গভীর চিন্তায় ডুব দিলো।যাবিরের সাথে সম্পর্কটা অনেক দিন হয়ে গেছে,এতদিন খুব একটা বেশি ভাবেনি এই ব্যাপারে।জীবন গোছাতেই ব্যস্ত ছিলো।কিন্তু এখন ভাবতে হচ্ছে।আসলেই কি সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ আছে যাবিরের সাথে?যদি কখনো বদলে যায় তখন কী হবে?আর সম্পর্কে আগালেই একটা ভয় কাজ করবে।যতই হোক,ভুল যদি হয়ে যায়....

ফোনের শব্দতে ঘোর ভাঙলো।রুপিনের নামটা দেখা মাত্রই চোখে খুশিতে পানি এসে পড়েছে ভিনার।

-আন্টিইই!কেমন আছো?

-ভালো আছি মামনি।তুমি কেমন আছো?

-ভালো আছি এখন।কবে আসলে কানাডা থেকে?

-আজকেই।সবার জন্য গিফট এনেছি।বলো কবে আসবো।

-আজকে আসো,এখনি আসো!

-পাগল রে।আমি আসবো নে সময় করে জলদিই।

মন ভালো হয়ে গেছে।এই মানুষটা এত ভালো কেন।খুব শান্তি লাগে তার কাছে গেলে।কত ভালো হত যদি সবসময় রুপিনের সাথে তার বাসায় থাকা যেত।

চা খেয়ে বসতেই সোহেল আসলো ভিনার ঘরে।এসে চুপচাপ পাশে বসলো।

-মুনাকে একটু সুযোগ দাও।ও তো চেষ্টা করছে সব ঠিক করার।

-কখন করলো চেষ্টা? যখন সব পেয়ে গেছে তখন।

-এগুলো ওর অধিকার ছিলো।সেতো বাইরের মানুষ না।

-অধিকার তো আমারো ছিলো বাবা।প্রায় এক বছর হয়ে গেছে আমি কীভাবে থেকেছি,তুমি খোঁজ করার প্রয়োজন মনে করোনি,তুমি ব্যস্ত ছিলে নিজের সংসার সাজাতে।

-তোমার জন্যই সব।আমি মুনাকে সময় ও দিয়েছি তোমার জন্যই,যেন তুমি তোমার মায়ের স্নেহ পাও,আশা ভরসা পাও।এই বয়সী মেয়েদের একটা সঙ্গী দরকার হয়।

-আমার জন্য?

-ওয়াদা দিয়ে বলছি,তোমার জন্যই। 

-আমার তাকে দরকার নেই বাবা।সে এর যোগ্য না।যে আগের থেকেই আমার ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট রেডি করে রেখেছে,তার কাছে আর কী আশা রাখবো।

-আমার কথা কখনো ভেবেছো তুমি?তোমার মা যাওয়ার পর কি আমি খুব ভালো ছিলাম?এখনো কি আছি?যাই করছি,শুধু তোমার কথাটা ভেবে করেছি। তারপর ও যদি একটু মানিয়ে না নাও তুমি,মানসিক অশান্তিতেই একদিন আমাকেও চলে যেতে হবে।

ভিনার বুক কেঁপে উঠলো।ঠিকি তো।এই কয় বছর তো এই মানুষটার দিকে খেয়াল হয়নি।সে স্বার্থপরের মত নিজেরটাই ভেবে গেছে।একরাশ অভিমান নিয়ে দূরত্ব সৃষ্টি করেছে।কিন্তু সত্যিই যদি তার বাবাও চলে যায়,তখন কী হবে?কথাটা চিন্তা করেও চোখে পানি এসে পড়েছে বুক ভার হয়ে।

-আমি চেষ্টা করবো বাবা।কিন্তু ফার্দার এসব কথা আর বলো না।

সোহেল মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলো। ভিনা দু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বাচ্চাদের মত কাঁদা শুরু করলো।ভিনার নিজের কারণে যদি সত্যিই তার বাবার ক্ষতি হয়,আর বেঁচে থাকা হয়ত হবে না।স্বার্থপর না হয়ে মুনার সাথে মানিয়ে চলার সিদ্ধান্ত নিলো ভিনা।


যাবির ক্লাস শেষ করে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলো।পেছনে থেকে কে যেন হাত ধরে টান দিলো।চমকে পেছনে ফিরে যা দেখলো,তার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিলো না।

-জেরিন!

-যাক,আমার ফেস তো মনে আছে।

-তুমি এখানে কী করছো।

-অবাক হচ্ছো কেন।অভ্যাস করে নাও আমাকে নিয়মিত দেখার।

-আমার ঠ্যাকা পড়েছে কোনো?

-পড়েছে,কারণ আমি তোমার ইন্সটিউশনেই ভর্তি হয়েছি।

যাবিরের ইচ্ছা করছে নিজের কপাল চাপড়াতে।এইদিনই দেখার বাকী ছিলো তার। 

-তুমি না মেডিকেলে পড়বা বলেছিলে।

-তুমিই তো দিলে না।আমাকে ইগ্নোর না করলে আজকে এমন হতো?

বাস এসে পড়ার যাবির দেরী করলো না। জেরিন কে সড়িয়ে বাসে উঠে পড়লো।সিক্সথ সেন্স বলছে এই মেয়েটা ওর লাইফে খুব বড় রকমের ঝামেলা করবে।
.
.
.
চলবে............................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন