মুনার হাতের সেলাই খুলে ফেলা হয়েছে।কিন্তু চামড়ায় ইনফেকশন হয়ে গেছে।ডাক্তার ডান হাত দিয়ে দুই মাস কোনো কাজ করতে মানা করেছে।যাদের এক হাত থাকে না,তাদের জীবন কতটা কঠিন,এখন সেটা ভালো মতই টের পাচ্ছে।সোহেল মুনার এই ঘটনায় প্রচন্ড রাগ করেছে,সেভাবে আন্তরিকভাবে কথা বলছে না।দুপুরে খাওয়ার সময় সোহেল খেয়াল করলো,মুনা বাম হাতে চামচ দিয়ে খাচ্ছে।অভ্যাস না থাকায় খেতে সমস্যা হচ্ছে।কিছুক্ষণ পর মুনা অল্প খেয়েই উঠে যেতে নিলো।
-এত অল্প খেলে হবে?ডাক্তার না ওষুধ দিয়েছে হাই পাওয়ারের?
-পেট ভরে গেছে।
-চুপচাপ বসো।
সোহেল নিজের প্লেটে আরো ভাত নিয়ে মুনার দিকে লোকমা তুলে দিলো।মুনা জান পরাণেই চেষ্টা করছে নিজের চোখের পানি আটকানোর,কিন্তু পারলো না।সোহেলকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে দিলো। সোহেলের হাতে ভাত লেগে থাকায় সে জড়িয়ে ধরতে পারলো না,কিন্তু মাথায় আলতো করে চুমো দিলো।সে ভাবতেও পারছে না সামান্য এই কেয়ারের জন্য মুনা আকুল হয়ে থাকে।এই জায়গাটাতেও সে কার্পণ্য করে ভিনার দিকে তাকিয়ে।কিন্তু এভাবে একটা মানুষকে কষ্ট দিয়ে নিজে ভালো থাকা যায় না।আজকে মুনার কান্না দেখে সে বুঝতে পারছে কতটা শূণ্যতা কাজ করে মুনার মধ্যে।মুনার নিজের বলতে কেউ নেই,সত্যিই কেউ নেই।গতকাল এই ব্যাপারটা সোহেল ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে।মুনার খবর শুনে হস্পিটালে তার বাসা থেকে কেউ আসেনি,এর চেয়েও ঘৃণ্য কাজ তারা করেছে।গতকাল তারেক ফোন করে বলেছে,তাকে ব্যবসার জন্য পাঁচ লাখ টাকা না দিলে সে সোহেলের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন মামলা করবে।সোহেল চাইলেই তারেককে জেলে দিয়ে দিতে পারত,এমন ক্ষমতা তার আছে,কিন্তু সে পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছে।শেষে একটা কথাই বলেছে,কখনো সে যেন মুনাকে নিজের চেহারা না দেখায়।মুনার সাথে এরপরে যোগাযোগের চেষ্টা করলে,সে তারেককে জেলে ভরতে দুই মিনিট ও সময় নিবে না।কারো আপনজন এমন হতে পারে,সোহেলের সাথে এই ঘটনা না ঘটলে সে জানতোই না।মুনার অসহায়ত্ব আর একাকিত্ব উপলব্ধি করে,ভেতর থেকেই এক ধরনের মায়া কাজ করে।এই মায়া থেকে বের হয়ে দুর্ব্যবহার করা কঠিন।
ভিনার সকাল থেকেই শরীর ভালো না।সর্দি আর জ্বরে পুরো শরীর ম্যাজম্যাজ করছে।সকালে নাস্তায় একটা টোস্ট বিস্কিট আর রঙ চা খেয়েছে।বারোটার দিকে আবার আদা চা।দুপুরে খাওয়ার জন্য নিচে নামার সময় দেখে তার বাবা মুনাকে খাইয়ে দিচ্ছে,এরপরের দৃশ্য গুলো দেখে আর নিচে নামেনি।ভেতর টা আবার দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।নিজের ঘর আটকিয়ে মায়ের ছবি নিয়ে ভিনা বুকে জড়িয়ে রেখেছিলো।ভালোবাসার মানুষের ও রঙ পালটায়।চোখ মুছে সে ফোন বন্ধ করে দিলো।যাবির প্রতিদিন নিয়ম করে চার বেলা ফোন দেয়।একটু পরই ফোন দেয়ার কথা ছিলো।কিন্তু ভিনার কারো সাথে পিছুটান রাখতে ইচ্ছে করছে না।
•
শরীর ভালো না থাকলেও ভিনা পরেরদিন কলেজে গেলো।প্রতিদিন তার বাবা টিফিনের টাকা ডাইনিং টেবিলের কোণায় রেখে দেয়।আজকে টিফিনের টাকা না নিয়েই বেড়িয়ে গেলো।দুইদিন পরেই কলেজের পরীক্ষা শুরু হবে।সেদিনই মাত্র কলেজ শুরু হলো,এখনি পরীক্ষা এসে পড়েছে। কলেজের সময়টা আসলেই চোখের পলকে চলে যায়।এই সময়টায় খেই হারিয়ে ফেললে,জীবনে বড় ধাক্কা খেতে হবে,তাই হাজার চাপা কষ্ট বুকে বয়ে বেড়ালেও পড়াশোনার ব্যাপারটা আর ছাড় দিবে না।কলেজে আজকে হেঁটে আসতে বেশ সময় লেগেছে ভিনার।এসে দেখে আরশি তখনো আসেনি,তার মানে আজকে আর আসবেই না সে।বেঞ্চে ব্যাগ রেখে ওয়াসিম কে খুঁজলো,কথা, আবির,ওয়াসিম সাদ সব এক জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে।ভিনাকে দেখেই কথা দৌড় দিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো। মেয়েটা অনেক মিশুক।কলেজের এই কয়দিনেই খুব ভালো সম্পর্ক হয়ে গেছে কথার সাথে।সামনে থাকলেই মন ভালো হয়ে যায়।
-কী অবস্থা তোর?গা টা গরম লাগছে,জ্বর নাকি? (কথা)
-হালকা ঠান্ডা লেগেছে।
-যাই হোক,হবু ডাক্তার ওয়াসিমের সাথে যোগাযোগ করুন।(আবির)
-বায়োলজি বই হাতে নিয়া ঘুরলেই যদি ডাক্তার হওয়া যাইত....(সাদ)
-ইতরামি থামা তোরা (ওয়াসিম)
-চুপ কর সবাই।আজকেও আরশি আসে নাই।
-নতুন কী?টেনের লাস্ট দিন গুলো থেকেই এই অবস্থা ওর (সাদ)
-কেন?
-ওকে কখনো ভালোমত কথা বলতে শুনেছিস?(আবির)
-যদ্দুর জানি,ওর বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই এই অবস্থা।(কথা)
-ক্লাসে যা,রিতু মিসের ক্লাস না এখন?(ওয়াসিম)
রিতু মিসের নাম শুনতেই সবাই দৌড় দিয়ে ক্লাসে ঢুকে গেলো।উনি বাংলা ক্লাস নেন।এই মানুষটার জন্য কলেজের সবাই বাংলার মত সাব্জেক্ট ও ভয় পায়, পাশ করার জন্য হাহাকার করে।
টিফিন টাইমে ভিনা বসে গল্পের বই পড়ছিলো।ওয়াসিম এসে ওর পাশে বসলো।
-টিফিন খাবি না?
-না রে, ক্ষিদা নাই।তুই এখানে?বাকীরা কই?
-বাকীরা সব নিচে।তোর সাথে কিছু কথা ছিলো,আরশির ব্যাপারে।
-আমারো ছিলো।
-আমি জানি।তখন সবার সামনে বলতে পারিনি।এখন বলতে আসলাম।যেহেতু আগামী দুই বছর ওর সাথেই থাকতে হচ্ছে তোর।
-বল
-আরশি আগে এমন ছিলো না।আমাদের ক্লাসে প্লেস করা স্টুডেন্ট ছিলো ও।ইচ্ছা ছিলো ইঞ্জিনিয়ার হবে।ম্যাথ আর ফিজিক্সে সবসময় হাইয়েস্ট নাম্বার থাকতো।
-আরশি সাইন্সে ছিলো?আমার বিশ্বাস হচ্ছে না যে এত সিরিয়াস ছাত্রী ছিলো ও।দুইদিন পর পরীক্ষা,ও বই ই কিনে নি জানিস।
-জানি।এখন সময় কম,তুই শুধু শোন আমার কথা।
-আচ্ছা,বলতে থাক।
-ওর ফ্যামিলিতে মা বাবা,আরেকটা বড় ভাই ছিলো।বেশ সলভেন্টই ছিলো বলতে পারিস,কিন্তু একটু ব্যাকডেটেড।আরশির ফ্যামিলিতে আগে ভাগেই মেয়েদের বিয়ে দেয়ার একটা ট্রেডিশন ছিলো।ক্লাস টেনের শুরুতে ওর বাবার বন্ধুর ছেলের সাথে এনগেজমেন্ট ও করানো ছিলো ওর।ছেলে ভালোই,ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছিলো,দেখতেও বেশ ভালো।আরশি ক্লাস নাইন থেকেই পছন্দ করত, তাই টেনে যখন আংটি পড়ানোর কথা আসে,আর মানা করেনি।টেনের প্রিটেস্টের পর আরশির বাবা হুট করে মারা গেলো।এরপর সবকিছু চোখের পলকে পালটে গেলো।আরশির চাচারা সম্পত্তি নিয়ে গেলো জোর করে,ভাইটাকে মিথ্যা মামলায় জেলে ঢুকিয়ে দিলো।আরশির মা কোনোমতে বাড়িটা নিজেদের নামে রাখতে পেরেছিলো।প্রতিদিন মেয়েটা এসে কান্না করে সব বলত আমাকে।ওর ভাইটা রিমান্ডে টর্চারের কারণে প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে গেলো শারীরিক আর মানসিকভাবে।এরি মধ্যে এসএসসির দুই মাস আগে,বিয়েও ভেঙে দিয়েছিলো ছেলেরা।তখন থেকেই আরশি পুরো চেঞ্জ হয়ে গেলো।চোখের সামনে একটা মেয়েকে আমি শেষ হয়ে যেতে দেখলাম।শোন ভিনা,একটা রিকোয়েস্ট রাখিস আমার।আমি জানি আরশি ঠিকমত পড়াশোনা করেনা,পরীক্ষাগুলোতে মেয়েটাকে হেল্প করে অন্তত পাশ করায়ে দিস।একবার যদি কলেজে ও আটকে যায়,ওর পড়াশোনা আর হবে না।
-কবে থেকে ভালোবাসিস আরশিকে?
ওয়াসিম কোনো কথা না বলে উঠে গেলো,যাওয়ার আগে বললো
'যখন ভালোবাসা মানে চকলেট আদান প্রদান আর হোমওয়ার্ক করে দেয়া ছিলো'
•
ছুটির সময় ভিনা আনমনে নিচের দিকে তাকিয়ে হেঁটে বাসা যাচ্ছিলো।আরশির কথা শুনে খারাপ লাগা কাজ করছে।তখনি দেখলো ওর পাশে তাল মিলিয়ে কে যেন হাঁটছে,তাকিয়ে দেখে যাবির।
-তুমি এখানে?
-ফোন বন্ধ ছিলো।চিন্তা হচ্ছিলো।বাসায় কিছু হয়েছে?
-না
-আচ্ছা,বলা লাগবে না।কিছু খাবে?
-না
- কলোনিতে চলো চা খাই।তোমার নাক লাল হয়ে আছে,ঠান্ডা লেগেছে,তাই না?
ভিনা মাথা নাড়ালো।যাবির আস্তে করে ভিনার হাত ধরে বললো,আমাকে সব কথা বলবে।তুমি জানো না,তোমার কথা শোনার জন্য সারাদিন আমি পাগলের মত অপেক্ষা করি....
.
.
.
চলবে.................................................