প্রিয়,
কুরিয়ার করেই ভালোবাসা পাঠলাম,
ফেরার দিনে উঠিয়ে নিও।
.
অবন্তী জানে ফোন এখন সুইচড অফ। মিশন শেষে ফোন অন হবে। টেক্সট টাও তখন পৌছুবে ।
.
.
ঠিক তের দিন পর ,
অবন্তী সেদিন ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরছিল। কি আশ্চর্য এত এত রিক্সা ডাকছে , কেউ যেতে রাজি হচ্ছে না। ষোল সতেরটা রিক্সা ডেকে একই অবস্থা । এই ভর দুপুরে কাঠফাটা রোদে মেয়েটা ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা।
— মামা সমস্যা কি? আমাকে কেন রিক্সায় নিচ্ছেন না ?
— ঐ যে আপনের পেছনে পাঞ্জাবিওয়ালা মামা ইশারা করে নিষেধ করতেছে।
.
অবন্তী রেগে কটমট করে পেছনে তাকাতেই তার সব রাগ বিস্ময়ে রুপ নিল। হাতে করে শঙ্খ টা নিয়ে ওর দিকে এগিয়ে আসল শুভ্র।
— এই পিচ্চি পেছনে তাকাতে বুঝি একটু ও ইচ্ছে করে না? সেই কখন থেকে পিছু পিছু হাটছি।
— শুভ্র তুমি!!!!!!! সময় হলো তবে আসার?? কেন এসেছ তুমি?? যাও আবার চলে যাও।
— উফ্ফ এত্ত রাগ??
— না অভিমান।
— একটু হাসো ।
— হাসবো না ।
— এত্ত দূর থেকে কষ্ট করে এজন্য এলাম? হাসিটা দেখার জন্য ই তো এসেছিলাম।
— কবিতা বলো ।
.
— প্রিয়,
তোমার খানিক হাসি
দেখার জন্য যে বার বার ফিরে আসি
অভিমানী,
তোমার অভিমানেই আমি স্বপ্ন কিনি
.
আর মেলাতে পারছি না এই মুহুর্তে।
— এটা যেন কার কবিতা?
— মহাকবি শুভ্রনীল সাখাওয়াত এর।
— সব সময় ফাজলামো?
—প্রিয়'র হাসি দেখতে এটুকু ফাজলামো করা জায়েজ আছে।
— চট করে কিভাবে বানিয়ে ফেল কবিতা?
— জানিনা। নাও অনেক খুজে খুজে এনেছি এত্ত শঙ্খটা । এত বড় শঙ্খ সচরাচর পাওয়া যায় না। অনেক খুজতে হয়েছে।
— সত্যিই এটা অনেক সুন্দর। থ্যাংক ইউ । আর হ্যা আমার দেয়া পাঞ্জাবি টা পড়ার জন্য আরো আরো থ্যাংক ইউ ।
— বাট আমি থ্যাংক ইউ দিতে পারছি না। পাঞ্জাবি টা খুব সুন্দর হয়েছে । এত্ত সুন্দর সেলাই কবে শিখলে বলো তো?কিন্ত কি ক্যাটকেটে লাল রঙ নিয়েছ? আমি কালো মানুষ এটা পরে পুরো সঙ এর মতো লাগছে ।
— চুপ ।কিসের কালো হ্যা? তুমি শ্যাম না না বাদামি বর্ন। আমার ব্রাউন প্রিন্স।
— হ্যা কোন একদিন কোন হোয়াইট প্রিন্স চলে আসলে ব্রাউন কে আর ভালো লাগবে না আমি জানি ।
— বাজে বকো না তো । কবিতা বলো ।
.
.
সারাদিন শুভ্র'র সাথে ঘুরে বেড়ানোর পর যাবার সময় শুভ্র অবন্তী কে জানালো ,ওর সেদিন কোন মিশন ই ছিল না । এটা শুধু মাত্র ধৈর্যের পরীক্ষা নেয়ার একটা খেলা ছিল। শুভ্র এটাই দেখতে চেয়েছিল ভবিষ্যতে তার বৌ কতটা ধৈর্যশীল হতে পারবে। এরকম প্রফেশনের কারো হাত সারাজীবনের জন্য ধরতে অবশ্যই তাকে ধৈর্যশীল হতে হবে।এসব শুনে অবন্তী শুধু মুচকি হেসেছিল আর বলেছিল,
— তুমি পারোও বটে । আমার এই নিসঙ্গতা, আমার এই একাকিত্বতার সাথে খেলতে বুঝি তোমার ভালো লাগে?
শুভ্র শুধু অবন্তীর হাত টা শক্ত করে ধরে দু হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে নিয়েছিল।
.
.
— এত নিসঙ্গতা এত একাকিত্বতা এখন আর আমার ভালো লাগে না ।আমার ধৈর্যের ও একটা সীমা আছে ।
.
কথাটা বলতে বলতে নিজের অতীত স্মৃতি থেকে নিজেই নিজেকে ফিরিয়ে আনে অবন্তী।
.
শুভ্রর সাথে এ ক'বছরের সম্পর্কে পাওনার খাতায় নিসঙ্গতা, আর একাকিত্বতার পরিমান বড্ড বেশি । কিন্তু অভ্র তাকে এ ক'দিনেই এত বেশি সঙ্গ দিয়েছে,যা শুভ্র এ ক'বছরেও দিতে পারে নি। অভ্র সারাদিন অবন্তীর সাথে সাথেই থাকে, সারাদিন গোছালো বা অগোছালো গল্প, অহেতুক পাগলামো।।
অবন্তীর অবচেতন মন এখন সেই সঙ্গ সান্নিধ্য বেশ উপভোগ করতে শুরু করে দিয়েছে। যদিও মস্তিষ্ক সায় দিতে চায় না ।
.
.
স্টোর রুমের দরজার আড়ালে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে অনেক্ষন ধরে লক্ষ্য করছে অবন্তী, অভ্র কিছু একটা পাগলের মতো খুজছে বেশ খানিক্ষন ধরে । খুজতে খুজতে অভ্রর এক পর্যায়ে চোখ পড়ে দরজার এক পাশে সামান্য বেরিয়ে থাকা অবন্তীর খয়েরি রঙের শাড়ির আঁচলের দিকে। তা দেখা মাত্র অভ্র আবার কিছু খুজতে শুরু করল কিন্তু এবার অহেতুক খোজা। কিছুক্ষণ মিছেমিছি খোজার ভান করে পাশে পড়ে থাকা বাবা মায়ের বিয়ের এলবাম টা নিয়ে নিল। অভ্র মুচকি হেসে নিজেই বিড় বিড় করে বলতে লাগল , তুমি চল ডালে ডালে আমি চলি পাতার জাইলেম ফ্লোয়েমে ।।
.
রুম থেকে বেরনোর সময় বেরিয়ে থাকা আচলের এক কোন ধরে টান দিয়ে অবন্তীকে নিজের বাহুর মধ্যে নিয়ে নিল। মাথা ঝুকিয়ে অবন্তির চোখ বরাবর চোখ নিয়ে
বলল,
— আমার ব্যাপারেও যে কারো কৌতূহল জাগে জেনে খুশি হলাম।
— কৌতূহল জাগার মতো কাজ করেন কেন?
— কি করেছি আমি? এভাবে বেড়ালের মতো লুকিয়ে লুকিয়ে না দেখে নিজে এসে জিনিসটা আমাকে খুজতে সাহায্য করলেই তো পারতে । এত দেরি হতো না তাহলে তাড়াতাড়িই পেয়ে যেতাম।
— একটা এলবাম এতো হন্যে হয়ে খোজার কি আছে?
— কেন কি ভেবেছিলে অন্য কিছু খুজছি??
— না আসলে
—চলো তোমাকে মার ছবি দেখাই। তুমি কোন দিন যেন দেখতে চেয়েছিলে। তাই হঠাত আজ মনে পড়ে এলবাম খুজতে এসে ছিলাম।
— বাহ আমার ছোট্ট ছোট্ট চাওয়া ও আপনি মনে রাখতে শুরু করেছেন?
— হুম।
.
.
রুমে এসে অভ্র খুটিয়ে খুটিয়ে প্রত্যেকটা ছবি অবন্তী কে দেখাচ্ছে। নিজের ও ছোট বেলার এলবাম দেখাচ্ছে। প্রত্যেকটা ছবির পেছনের গল্প বলছে।
— ইশ কি কীউট ছিলেন আপনি। আমার এরকম একটা কীউট বেবি থাকলে আমি সারাদিন ওর গাল ধরে টানতাম।
— What nonsense? আমাকে নিজের বেবি মনে হয় তোমার? আমি তোমার বাচ্চা? আল্লাহ্ এই লিখে রেখেছিল আমার কপালে। আমি এখনো কীউট ই আছি। ইচ্ছে হলে এখনো গাল ধরে টানতে পারো আমি কিছু মনে করব না ।
— কি আশ্চর্য আপনাকে মনে হবে কেন? বলেছি এরকম কীউট বেবি যদি আমার থাকত।
— বেবির এত শখ তো হাবি কে এত দূরে রাখো কেন হুম?
— বাজে কথা বাদ দিন। মায়ের ছবিই আবার দেখবো আপনার গুলো আর দেখব না । রেণু খালা ঠিক ই বলেন মা সত্যি সত্যি অনেক সুন্দর ছিলেন। কি কাচা হলদে বরন।
.
.
অবন্তী লক্ষ্য করছে অভ্র খুব মনযোগ দিয়ে মায়ের ছবিগুলো দেখছে।
— আচ্ছা একটা কথা বলি ?
— হুম ( অভ্র ছবির দিক থেকে মাথা না তুলেই বলল)
— আপনার কি কাউকে সন্দেহ হয়?
— কি ব্যপারে?
— মা'র ব্যাপার টা নিয়ে
.
অভ্র কথাটা শুনে মায়ের ছবির দিক থেকে চোখ সরিয়ে কয়েক সেকেন্ড বাবার ছবির দিকে তাকিয়ে রইল। আবার নিজেই নিজেকে সামলে নিল।
.
— তোমার শুভ্র যেন কবে ফিরবে?
— কথা ঘোরালেন কেন?
— কারণ আমি কাউকে সন্দেহ করি না তাই
— তাহলে বাবার ছবির দিকে চট করে তাকালেন কেন?
— সেটাও তোমার চোখে পড়েছে?
— বাবা এরকম?
— আমি ই এরকম।
— কি রকম?
— যেমন দেখছ।
— বুঝতে পেরেছি বলবেন না ।
— সতীন সাখাওয়াত কবে আসবে বললে না তো?
— আপনি কি করে জানলেন শুভ্র'র পুরো নাম সাখাওয়াত?
— শুভ্রনীল সাখাওয়াত তো??? এ আর এমন কি কঠিন কাজ কারো পুরো নাম জানা?আমি কিন্ত আরো অনেক কিছু জানি।
— কি??? কি জানেন আপনি???
— এই যে তুমি একটা চুন্নি বিলাই সেটাও জানি।
— যত্তসব আজব কথাবার্তা।
.
— আমি শাওয়ারে গেলে যে
তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে চোরের মতো আমার ফোন ইউজ করো সেইটাও আমি জানি। আর তোমার এসব করতে যেন কোন অসুবিধা না হয় তাই আমি ফোনে পাসওয়ার্ড, ফিঙ্গারপ্রিন্ট কোন প্রটেকশন ই দিয়ে রাখি না। শাওয়ার ও অনেক টাইম নিয়ে করি । কত্ত উপকার করি আমি তোমার তাই না?
— হ্যা ঐ আর কি নিয়েছিলাম একদিন ।
— একদিন বুঝি???
— না মানে কয়েকদিন।আমি কি করব বলুন জানেন ই তো আপনার সাথে বিয়েতে রাজি ছিলাম না বলে চাচারা আমার ফোন নিয়ে ভেঙে ফেলছে । আমার তো শুভ্র কে অন্তত পুরো ব্যাপার টা জানানো উচিত না কি?? তা...ই....
— শুভ্র নাকি নেটওয়ার্ক রেঞ্জ এর বাহিরে???
—:হ্যা সেটাই তো চেক করার জন্য কয়েক দিন ফোন নিয়েছিলাম। বিয়ের পর আজই প্রথম আমি ওকে টেক্সট দিয়েছি বিশ্বাস করুন।কজ যাবার আগে আমাকে দেয়া হিসেব মতো ওর এখন রেঞ্জেই থাকার কথা । আর কাল চেক করে দেখি কয়েক আওয়ার আগে এক্টিভ দেখাচ্ছে মানে রেঞ্জে ই আছে। তাই আমি টেক্সট টা ...
— কত্ত বড় টেক্সট পাঠিয়েছ সোশ্যাল সাইটে তুমি ওকে। বাব্বাহ পড়তে পড়তে তো আমি হাপিয়েই উঠেছিলাম। কি ভাবে ভিলেন বানিয়ে দিলে তুমি আমাকে ওর কাছে তাই না? আমি জোর করে বিয়ে করেছি, আমি চাহিদা মেটাতে কিনে নিয়েছি, তুমি জাস্ট আমার দাসী, আমি পাগল, চাচারা টাকার বিনিময়ে তোমাকে আমার মতো একটা পাগলের সাথে বিয়ে দিয়েছে আরো কত্ত কত্ত সিমপ্যাথি কুরানো মুলক টেক্সট।বাবাহ আমি তো আবেগে টেক্সট টা শুভ্র সিন করার আগেই রিমুভ করে দিয়েছি।।
.
— মানেটা কি?? আপনি আমার সাইটে ঢুকলেন কি করে? আমি তো লগ আউট করে আপনার ফোন থেকে আইডি রিমুভ করে দিয়েছিলাম।
— উহু তুমি ভুলে গিয়েছিলে রিমুভ করতে ।
— মোটেও না । এমন ভুল আমি কখনো ই করি না ।
— মোটেও হ্যা।
— আমি নিশ্চিত আমি এমন কিছু করি নি।করলেও পাসওয়ার্ড,মেইল আইডি আপনি কোথায় পেলেন কে জানে। জানি জিজ্ঞেস করলেও বলবেন না ।তাই আমি জিজ্ঞেস ও করব না ।
— হুম।সতীন সাখাওয়াত মেসেজ গুলো সিন ই করতে পারলো না । কি কষ্ট,কি দুঃখ।।। আমি শুধু আমাদের বিয়ের রিসেপশনের কয়েকটা পিক সেন্ড করে দিয়েছি যেগুলো তে তুমি বেশ হাসিখুশি ছিলে বিশ্বাস করো আর কোন টেক্সট পাঠাই নি।
— খুব ভালো কাজ করেছেন ।বিশ্বাস করুন আমার অনেক উপকার করেছেন আপনি। এত্ত উপকার এই ত্রীভুবনে আমাকে কেউ করে নি।আপনার পা ধরে সালাম করতে মন চাচ্ছে।
— এই নাও
(অভ্র অবন্তীর কোলের ওপর পা তুলে দিল)
— আপনি আসলেই....
— কি?
— কিছু না
— অভদ্র?
— যাই হোক কথায় কথায় এমন সতীন সতীন বলবেন না । আপনি কি মেয়ে মানুষ নাকি যে আপনার সতীন থাকবে?
— তাহলে শুভ্র'র সাথে আমার কি সম্পর্ক?
— ভাইয়া বলবেন। হিসেব করে দেখেছি ও আপনার চেয়ে বছর তিনেক এর বড় ই হবে।
— Enough is enough..ভাইয়া এসে গেছে আমার । আমার বৌ কে নিয়ে টানাটানি করবে আর আমি তাকে ভাইয়া বলে ডাকব? শুভ্র তো তোমার ও বছর পাচেক এর বড় তো তুমি নানা-দাদা বলে ডাকলেই পারো ।
— এখন রাগেন কেন? সতীন সতীন বলে খুব মজা নেয়া হচ্ছিল তাই না???
.
— যাই হোক আমি ল'য়ারের সাথে কথা বলে রেখেছি। শীঘ্রই পেয়ে যাবে তুমি তোমার মুক্তি, তথা ডিভোর্স।আমি চলে যাব তোমাদের চেয়ে বহু দূরে ।
— বাহ গেইম ভালোই খেলতে পারেন। আমাদের মধ্যে ঝামেলা পাকিয়ে দিয়ে ডিভোর্স দিয়ে নিজে আগে ভাগেই সরে যেতে চাইছেন?আমিও একটা কথা বলে রাখি আমার আর শুভ্র'র মাঝে সব কিছু ঠিক করে না দেওয়া পর্যন্ত আমিও আপনাকে ছাড়ছি না । মনে রাখবেন এ ভাঙার খেলা উড়ে এসে জুড়ে বসে আপনি শুরু করেছিলেন। এখন সব কিছু ওলট পালট করে দিয়ে আমাকে অতল সাগরে ফেলে দূর থেকে মজা দেখবেন তা আমি হতে দেব না । যা'র শুরু আপনাকে দিয়ে তা'র শেষ ও আপনাকেই করতে হবে ।হুট করে চলে যেতে চাইলে তো আমি যেতে দেব না ।
.
— প্রত্যক্ষ ভাবে না হলেও এখন পরোক্ষ ভাবে তোমার দ্বিধা কাজ করে আমায় দূরে ঠেলতে?তাই দূরে যাবার কথা শুনে অযথা এই শাসনের সুর, অযথা কিছু অকারণ ছুতো? মায়ায় জড়িয়েছ নাকি ভালোবাসায়?
.
.
.
চলবে.........................