'আকাশ এত মেঘলা, যেয়ো নাকো একলা,এখনি নামবে,অন্ধকার'
যাবিরের মেসেজ পেয়ে মন ভালো হয়ে গেলো।সকাল থেকেই মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে।আজকে অনেকদিন পর সকাল দশটা পর্যন্ত ঘুমিয়েছে ভিনা।আড়মোড়া দিয়ে উঠতেই বেডের পাশে চা পেলো।চা পেয়ে খুবই অবাক হয়ে গেছে ।কিছুক্ষণের জন্য চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে চা হাতে জানালার পাশে দাঁড়ালো।মনে হচ্ছে যেন সন্ধ্যা হয়ে গেছে।এই সময়টা অনেক ভালো লাগে,মনে হয় যে একটা দিন পুরো চলে গেলো,কিন্তু তখনো অনেক সময় বাকী থাকে দিন শেষের।আজকে সারাদিন গল্পের বই আর গান নিয়েই ব্যস্ত থাকার পরিকল্পনা করছে ভিনা।অর্ধেক চা খেয়ে ফ্রেশ হয়ে নিচে আসলো নাস্তা করতে।অবাক হয়ে দেখলো মুনা আর তার বাবা বসে আছে।ভিনাকে নামতে দেখেই মুনা বললো-
-ঘুম কেমন হলো ভিনা?দেখেছো বাইরের ওয়েদার টা কী সুন্দর!
-ঘুম ভালো হয়েছে।
-চা টা খেয়েছিলে?
-হ্যাঁ
-আমি সকালেই রেখে এসেছিলাম।ডাক দিতাম তোমাকে, কিন্তু অনেক আরামে ঘুমোচ্ছিলে দেখে আর ডাক দিতে ইচ্ছে হয়নি।
-ভালো করেছেন,কারণ কলেজের জন্য এমনিই প্রতিদিন সকালে উঠতে হয়।
-আমি আর তোমার বাবা অপেক্ষা করছিলাম তোমার জন্য,আসো,নাস্তা করে নাও।
-এখনো নাস্তা করেননি আপনারা?
-না,কতদিন একসাথে নাস্তা করা হয় না!মোমেনা গরম গরম রুটি সেকে দিয়ে গেছে।এখনি খেয়ে নাও।
ভিনা কিছুই বুঝতে পারছে না।সোহেলের দিকে তাকাতেই সে অমায়িক একটা হাসি দিলো।
-বস না মামনি।ক্ষিদা লেগে গেছে আমার।
মুনা উঠে এসে ভিনাকে নিজের পাশে বসালো।বেশ অস্বস্তি নিয়ে কোনোমতে নাস্তা করে উঠে যেতে চাইলো ভিনা।
-কী হয়েছে?নাস্তা ভালো হয়নি?
-না,মজা ছিলো তো।
-তাহলে ঠিকভাবে খেলে না যে।ফ্রিজে কাকলেট আছে,ভেজে দিবো?
ভিনা গলা দিয়ে খাবার নামছে না। মনে হচ্ছে প্যারালাল ইউনিভার্সে এসে পড়েছে,সব এলোমেলো। পানি খাওয়ার সময় মুনা বললো
-আজকে তোমাকে নিয়ে শপিং এ বেরোবো।তোমার জামাগুলো কেমন যেন পুরোনো হয়ে গেছে।
ভিনা বিষম খেলো।নাক মুখে পানি উঠে একাকার। মুনা পিঠে বেশ জোরেই কয়েক দফা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো।সেটা থাপ্পড় না বলে থাবড়া বলাই ভালো।মনে হচ্ছে শত জনমের শত্রুতা একবারে বের করছে।ভিনা নরমাল হয়ে যাওয়ার পর মুনা বলা শুরু করলো-
-দুপুরে খেয়েই রেডি থেকো কিন্তু।
-আজকে তো বাইরে বৃষ্টি,কীভাবে যাবো?
-আরে এর জন্যই তো ভালো,ভীড় কম থাকবে।সোহেল,তুমি কিন্তু ড্রাইভারকে বলে রেখো।
সোহেল খুশি হয়ে বললো অবশ্যই। সৌজন্যের হাসি দিয়ে ভিনা উপরে চলে এলো।দুপুরের খাওয়ার পর সত্যিই মুনা বের হলো শপিং এর জন্য।ড্রাইভার রফিক চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে,এ দৃশ্য তার কাছেও অবাস্তব মনে হচ্ছে।সোহেল সাথে আসেনি,মেয়ে আর তার তথাকথিত 'মা' কে একসাথে পাঠিয়েছে।আগে তার মাকে নিয়ে যে শপিং মলে আসত,সেখানেই তাকে নিয়ে এসেছে মুনা।পরে নিজেই পছন্দ করে ফতুয়া আর স্ফার্ক কিনে দিলো ভিনাকে।ভিনা কিছুই বললো না।শপিং শেষে একটা ভালো জায়গায় খাওয়া দাওয়া করে, সোহেলের জন্য খাবার পার্সেল নিয়ে বাসায় আসলো বেশ রাতে।বাসায় উঠার আগেই সোহেলে এসে দরজা খুলে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে ছিলো।
-কেমন হলো মা মেয়ের শপিং?
-খুবই ভালো,কিন্তু তোমার মেয়ে তো কিছু কিনতেই চায় না,এত চাপা স্বভাবের! তোমার তো লাভ।
মুনার হাত থেকে শপিং ব্যাগ গুলো নিয়ে সোহেল ভেতরে চলে গেলো।ভিনার এসব মেকি দরদ অসহ্য লাগছে। গত তিন চার মাস তো ভালোই ছিলো।প্ল্যান ছিলো কোনোভাবে একটা পাব্লিক ভার্সিটিতে চান্স পেয়েই হোস্টেলে উঠে যাবে।কিন্তু মুনা আর সোহেলের হটাৎ এই পরিবর্তিত আচরণ চলতে থাকলে বেশ সমস্যা হয়ে যাবে,তখন হোস্টেলে উঠা যাবে না।হাজার হোক,তার মায়ের জায়গা সে আর কাউকে দিতে পারবে না।মুনা যে ভালো ব্যবহার করছে,এটা মোটেও স্নেহ থেকে না।যদি শুরু থেকেই মুনা মায়ের দায়িত্ব পালনের জন্য এগিয়ে আসত,তাহলেও ভিনা হয়ত তাকে মায়ের জায়গা দিতে পারত।কিন্তু যখন তার বাবা তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে,মুনাকে প্রায়োরিটি দিলো,তখনই মুনার মাতৃত্ব জেগে উঠেছে,সোজা অর্থে নিজের স্বার্থ পূরণের পরই তার এই আচরণে পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু কোনো মা সন্তানের ক্ষেত্রে স্বার্থপর হতে পারে না,সন্তানের সাথে প্রতিযোগিতা করতে পারে না।মা মাত্রই স্বার্থহীন,সন্তানের আশ্রয়।তাই মুনাকে মায়ের জায়গা দেয়া অর্থহীন।মাত্র কয়টা মাস,এরপরই সে এখান থেকে দূরে চলে যাবে।
•
পরেরদিন কলেজের জন্য একটু জলদিই বের হলো ভিনা।আগেরদিন গ্রুপ ম্যাসেজে ওয়াসিম সবাইকে আগে আসতে বলছে। কলেজ গেটে যেয়ে দেখলো ওয়াসিম,সাদ,আবির,কথা আর আরশি একসাথে দাঁড়িয়ে আছে। ভিনা যাওয়া মাত্রই আরশি প্রায় উড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো।ভিনা তাল হারিয়ে প্রায় পড়ে যেতে নিলো।
-আরে আরে!কী হয়েছে রে বাবা!? (ভিনা)
-চল ঘুরতে যাই।(আরশি)
-মানে! (ভিনা)
-মানে আজকে আমরা কলেজ বাঙ্ক দিবো।(কথা)
-বাঙ্ক!(ভিনা)
-হ্যাঁ, কলেজ তো প্রায় শেষের দিকেই।দুই সপ্তাহ পড়েই টেস্ট এক্সাম।এরপরে তো আর ক্লাস হবে না।তাই কলেজ লাইফটাকে মেমোরেবল করতে আজকে আমরা বাঙ্ক দিবো। (ওয়াসিম)
-পাগল হয়ে গেছিস তোরা।সব টিচাররা সাজেশন দিবে লাস্টের এই ক্লাস গুলোতে।(ভিনা)
-এই সাজেশন না পাইলে যে টেস্টে ডাব্বা মারবি এমন তো না,ঠিকি তো প্লেস করবি।(আরশি)
-কেউ টের পেলে আমাদের টিসিও হতে পারে,বুঝতেসিস?(ভিনা)
-তুই নিশ্চয়ই স্কুল লাইফে একেবারে ভালো বাচ্চা ছিলি তাই না?(কথা)
-না,মোটেও না।(ভিনা)
-মিথ্যা কথা,ডাহা মিথ্যা কথা।সেদিন সুমনা এসে বলসে তুই কী ফাটানো রেজাল্ট করসিস।মাইয়ার পিত্তি জ্বলে গেসে একেবারে।(ওয়াসিম)
-সুমনা!মনে পড়লো।ঐ মেয়ে আমাদের যদি দেখে ফেলে,রিতু ম্যাডামকে বলে দেয়,তাহলে একদম শেষ হয়ে যাবো আমরা।(ভিনা)
-সুমনা কে মনে হয় আমি দুই পয়সা দাম দেই?(আরশি)
-দেখ তুই আমাদের সাথে যাচ্ছিস,ব্যাস।(সাদ)
-তুইই আমাদের ধরা খাওয়াবি ভিনা,এতক্ষণে আমরা কতদূর যেতে পারতাম। (আবির)
-থাম থাম।আর কোনো কথা না।চল সবাই।(আরশি)
ভিনাকে টান দিয়ে নিয়ে গেলো আরশি,কিন্তু ভিনা ঠিকি খেয়াল করলো,সুমনা তখন কলেজে ঢুকছিলো,এবং তাদের দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো।কিন্তু এ্যডভেঞ্চারের নেশায় তখন সবাই বুদ। দুইটা রিকশা করে বাস স্ট্যান্ডে চলে আসলো।সেখান থেকে পূর্বাচলের দিকে যাবে,কাশবন দেখতে।কথা ব্যাগ থেকে চিপ্স আর বিস্কিট বের করলো সবার জন্য।সব দুশ্চিন্তা ভুলে গিয়ে ভিনাও আড্ডা দেয়া শুরু করলো।সাদ লুকিয়ে নিজের বাবার উঠিয়ে রাখা দামী মোবাইল ফোন নিয়ে এসেছে ছবি তোলার জন্য।পুরো সময় হুরাহুরি করেই চলে গেলো সবার।দুপুরের দিকে রওনা দিলো কলেজের দিকে। ছুটির পাঁচ মিনিট আগেই পৌছে গেলো তারা।
•
জেরিন ল্যাপটপের সামনে বসে আছে।আজকে আইবিএর রেজাল্ট পাব্লিশ করবে।রিটেনে আগেই সিলেক্ট গিয়েছিলো,এখন ভাইবার রেজাল্টের অপেক্ষা করছে। একটাবার চান্স হয়ে গেলেই হলো,যাবির কীভাবে ইগ্নোর করবে,সেটা দেখে নিবে ভালোমত।সাত পাঁচ ভেবে যখন রেজাল্ট চেক করলো,তখন সারা বাড়ি কাঁপিয়ে চিৎকার দিলো। আইবিএ তে চান্স পেয়েই গেছে।মেয়ের চিৎকার শুনে খুরশিদের হার্ট এটাকের অবস্থা হলো।মনে প্রাণে চেয়েছিলো যেন জেরিনের চান্স না হয়।এবার চান্স না পেলে মেয়েকে সেকেন্ড টাইম মেডিকেলে পরীক্ষা দেয়ানো যেত। সব আশা চোখের সামনে ভাঙ্গতে দেখে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না সে।বাথরুমের স্যান্ডেল হাতে নিয়ে নিজের কলিজার মেয়েকে বেধড়ক পেটানো শুরু করলেন।এত মাস মুখ বন্ধ করে রেখেছিলেন,এই আশায় যে বললেই তো আর চান্স পাওয়া যায় না।কিন্তু এবার চান্স হওয়ার পর নিজের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে হচ্ছে।জীবনে এই প্রথমবার তার মনে হলো,এই মেধাই মেয়েটার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়াবে।আজকে হাবাগোবা একটা বাচ্চা থাকলে কখনোই এসব দেখতে হত না তার,না থাকত আশা,না থাকত আশাভঙ্গ।প্রায় ঘন্টাখানেক পেটানোর পর ক্লান্ত হয়ে রুমে চলে গেলো খুরশিদ।জেরিন মাটি থেকে কোনো মতে উঠে দাঁড়ালো।মার খেয়ে বিন্দুমাত্র বিচলিত না সে।প্রায় এক বছর পর সে যাবিরের কাছে যাবে,এর চেয়ে বেশি খুশির আর কীই বা হতে পারে।
.
.
.
চলবে................................................