পরিণয়ে পরিপূরক - পর্ব ১০ - স্পৃহা নূর - ধারাবাহিক গল্প


— প্রত্যক্ষ ভাবে না হলেও এখন পরোক্ষ ভাবে তোমার দ্বিধা কাজ করে আমায় দূরে ঠেলতে?তাই দূরে যাবার কথা শুনে অযথা এই শাসনের সুর, অযথা কিছু অকারণ ছুতো? মায়ায় জড়িয়েছ নাকি ভালোবাসায়? 
.
যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে,
অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে....
.
অবন্তী কোন উত্তর না দিয়ে শুধু তাকিয়ে রইল কথা গুলো বলতে বলতে অভ্র'র চলে যাবার দিকে।।
.
.
অভ্র সেই তখন থেকে বছর চারেক এর ছোট্ট অর্থি কে বিছানায় নিয়ে খেলা করেই যাচ্ছে। অবন্তী পাশে বসে বসে দেখছে। ছোট বাচ্চাদের সাথে কত সহজেই মিশে যায় লোকটা। নিজেও বাচ্চাদের মতো আচরণ করছে । আর অর্থি অভ্য মামা অভ্য মামা বলে ফিক ফিক করে হেসে দিচ্ছে। কে বলবে এই লোকটার মাঝে এত জটিলতা । 
.
দরজায় নক করায় অবন্তী দরজা খুলে দিতেই অর্নি এসে ভাইয়ের গালে চট করে একটা থাপ্পড় দিয়ে অর্থিকে নিজের কোলে নিয়ে নিল। অবন্তী আহম্মকের মতো তাকিয়ে থাকলেও অভ্র খুব স্বাভাবিক ভাবে পকেট থেকে চকলেট বের করে অর্থির দুহাতে দিয়ে দু গালে দুটো চুমু দিল। 
— এই বেয়াদব, আমি বাবার সাথে কাজের কথা বলতে ব্যাস্ত ছিলাম আর তুই এই ফাকে আমার মেয়েটা কে চুরি করে এনেছিস? কি চাই টা কি তোর? আমার মেয়েটা কে খাবি এবার? 
— আমি তো শুধু অর্থি কে একটু আদর করতে .. তুই তো ওদের টাচ ই করতে দিস না আমাকে। তাই তোকে না বলে নিয়ে এসেছি রুমে। খেয়ে ফেলব এটা আবার কেমন কথা?
 
— খাওয়ার অভ্যেস তো আর কম নয় তোর । আমার বাচ্চাদের থেকে দূরে থাকবি বলে দিলাম। আমার ওপর যে তোর রাগ আছে সেটা আমি ভালো ভাবেই জানি। মায়ের ব্যাপার টা আমি প্রথম দেখেছি আর আমি সবাই কে বলে দিয়েছি এটাই তোর রাগ তো? এখন সেই রাগে আমার মেয়েটা কে .....এই অবন্তী পাগলামো করে আবার অর্থির গলা টলা টিপে ধরে নি তো?
.
— সরি আপু কিছু মনে করবেন না । আমি একটা কথা না বলে পারছি না । আপনার তিল কে তাল বানাতে খুব ভালো লাগে তাই না?উনি আপনার মেয়েকে গলা টিপে ধরবে আর আপনার মেয়ে এমন হ্যা হ্যা করে হাসবে? আপনার এই ছোট্ট মেয়েটার সাথে উনার কি এমন শত্রুতা যে মেরে ফেলবে?সব কিছুতেই উনার ওপর জোর করে দোষ না দিলে হয় না আপনার তাই না? সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে বাড়ি মাথায় তুলছেন দেখছি। মামা হয়ে উনি কেন ভাগ্নী কে আদর করবে না? এতক্ষণ কত্ত আদর করছিল।এ অধিকার উনার আছে। আর মায়ের ব্যাপার টাও যে আপনি তিল কে তাল বানিয়েছেন সে আমি ভালো ভাবেই বুঝতে পেরেছি । 
— বাবাহ অবন্তী এ ক'দিনেই? স্বামীর নামে কিছু বলতেই ফোস্কা পড়ছে গায়ে? তুমি ওর কুকীর্তি সম্পর্কে জানো?
— এ ক'দিনে না আপু এ ক'মাসে। আর হ্যা ফোস্কা তো পড়বেই , আপনি ফোস্কা পড়ার মতো কথা বললে । হ্যা আমি উনার কুকীর্তি সম্পর্কে জানি। আপনাকে আর নতুন করে সেসব শোনাতে হবে না ।
— ঢাল ভালোই হয়েছ দেখছি।
— হুম । স্বামী স্ত্রী একে ওপরের ঢাল স্বরূপ। উনি যেমন আমার ঢাল তেমন প্রয়োজনে আমিও উনার ঢাল ।

.
.
অভ্র অর্নির কথার কি জবাব দেবে সে হা হয়ে তাকিয়ে আছে তার বৌ এর দিকে। এটা কি শুভ্র'র প্রেমিকা অবন্তী নাকি অভ্র'র আদর্শ বৌ। তার প্রতি এত্ত এত্ত দরদ মেয়েটা পাচ্ছে কোথায়? 
অর্নি তার জীবনে শুধু ক্ষতি ই করে এসেছে ,সবার সামনে তাকে ছোট করে এসেছে। আজ এই প্রথম তাকে ছোট করতে গিয়ে উপকার করে ফেলেছে। অর্নি কে এই প্রথম অভ্রের নিজের বোন বলে মনে হচ্ছে । অভ্র খুশিতে বেড সাইডে রাখা চকলেট গুলো থেকে আরো কয়েকটা নিয়ে অর্থির হাতে ধরিয়ে দিল। অর্নি সেগুলো কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়ে রাগে গজ গজ করতে করতে চলে গেল ।
.
.
খাবার টেবিলে রেণু খালা অর অবন্তী সবাইকে খাবার সার্ভ করে নিজেরাও খেতে বসল। পাশে বুয়া ও এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছে।অর্নি রা আজ রাতে এখানেই থাকবে। অভ্র ই বাবাকে দিয়ে বলিয়েছে থাকার কথা । 
" ম্যাডাম,খাবার একবার নিতে হয় না,অল্প করে হলেও আর একবার নেন। এক বার নিলে স্বামী মরে যায় "
অবন্তী জানে এ সব কুসংস্কার ছাড়া আর কিছুই নয় । বুয়া গ্রামের মানুষ তাই এসব মানে,তাই এসব বলছে । কিন্তু কি যেন মনে হল, অভ্র'র দিকে তাকিয়ে সকালে বলা কবিতার দুটো লাইন মনে হয়ে সামান্য একটু আর এক বার নিল।
.
— অবন্তী এত আদর্শ বৌ হতে হবে না বোন তোমার। আমার সোনার টুকরো ভাই এত সহজে মরবে না । তোমার হাজব্যান্ড এর যে কৈ মাছের প্রাণ তা আমার বোঝা হয়ে গেছে । 
.
অভ্র এবার ও কোন উত্তর দিল না । চুপচাপ খাওয়াতে মনোযোগ দিল। সে এটাই চাইছিল তাই বাবাকে দিয়ে অর্নিকে রাতেও থাকতে বলিয়েছিল আর বাবাকে নিজের ব্যাপারে অর্নি কে বলতে নিষেধ করেছিল। কেননা অভ্র থাকতে বলেছে শুনলে অর্নি থাকত না ।বাবা তো ভেবেছিল তার ছেলের বোনের প্রতি ভালোবাসা বাড়ছে ।কিন্ত অভ্র জানত অর্নি থাকলেই ওকে আবার হেয় করবে আর অবন্তীর এসব শুনে তার প্রতি খারাপ লাগা হোক বা মায়া বা দরদ যা ই হোক বেড়ে যাবে। 
.
কিন্তু এ বার কথাটা অবন্তী ধরার আগেই রেণু খালা ধরে বসল।
— অর্নি মা, তুমি কি করে বুঝলে অভ্র'র কৈ মাছের প্রাণ? এতটা নিশ্চিত করে কারো আয়ুর ব্যাপারে কেউ বলতে পারে?
.
ব্যাপার টা যে অভ্র'র খটকা লাগছে না তা ও নয়। হঠাত অর্নি এমন কথা কেন বলল। "কৈ মাছের প্রাণ বোঝা হয়ে গেছে " কথাটার মানে কি? কবে আর কি করে বুঝল ও। সে যাই হোক এসব ব্যাপার পরেও দেখা যাবে। এখন অবন্তী ছাড়া আর কোন দিকে মাথা ঘামাতে চায় না সে। 
.
— সত্যি তো আপু আপনি কি করে বুঝলেন?
— আরে অবন্তী তোমার আপুর এসব কথা বাদ দাও তো । ও কি বলে ও নিজেও জানে না । আজকের রান্নাটা কিন্তু দারুন হয়েছে ।তুমি রেধেছ?
(অর্নির হাজব্যান্ড মাহমুদ কথাটা কাটিয়ে নিল)
— না, ভাইয়া । উনি আমাকে রাধতে দেয় না । 
.
পর দিন সন্ধ্যায় অভ্র স্বভাব মতো ঘুমে । আটটা ন'টার আগে উঠবে না ।অর্নিরা চলে গেছে । অবন্তী তাড়াহুড়ো করে নামাজ শেষ করে রেণু খালার কাছে চলে গেল । যেভাবেই হোক রেণু খালার ফোন টা নিতেই হবে আজ। অভ্র এমনিতেই সব ঘেটে রেখেছে। শুভ্র'র সাথে সরাসরি কথা না বললেই নয়। নামাজ শেষে রেণু খালা কে জানালো অনেক দিন রিলেটিভদের সাথে কথা হয় না তাই সে কথা বলতে চায় ফোনে কিন্ত অভ্র তার হাতে ফোন দেয় না । রেণু খালা অবন্তী কে ফোন দিয়ে নিজের মতো কোরান পড়তে লাগলেন। 
অবন্তী গার্ডেনের এক কোনে খুব সাবধানে বার বার এদিক সেদিক তাকাচ্ছে । 
দু বার ফোন দেয়ার পরও শুভ্র'র রিসিভ করার কোন নাম ই নেই । বিরক্ত হয় তৃতীয় বার ফোন করতেই অবন্তী শুনতে পেল সে বহু দিনের চেনা কন্ঠস্বর। 
.
— জ্বি আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?
— শুভ্র আমি 
— অবন্তী? বিয়ের পর কন্টাক্ট নং ও চেঞ্জ করেছ দেখছি।
— পিচ্চি বলে ডাকবে না?
— সেই অধিকার তো অন্য কাউকে দিয়ে দিয়েছ। বাই দ্যা ওয়ে কনগ্রাচুলেশনস। বলো কি ফেরার সময় কি গিফট নিয়ে যাব? নতুন কাপল দের কি গিফট দিলে তারা বেশি খুশি হয় সে সম্পর্কে আমার কোন আইডিয়া নেই। তাই তুমি ই চেয়ে নাও।
— শুভ্র দোহায় লাগে চুপ করো।তুমি জানো না পুরো ব্যাপার টা । আমি বলছি শোন ।
— কি শোনার আছে আমার? কিচ্ছু শোনার নেই। বিয়ের ছবি গুলোর মতো হানিমুনের ছবি গুলোও একটু কষ্ট করে সেন্ড করে দিও। 
— চুপ আর একটা বাজে কথা ও বলবে না তুমি।
— আমি তো কথা বলতে চাইছি না তোমার সাথে । তুমি নিজেই ফোন করেছ। তুমি সেদিন বেহায়ার মতো এভাবে ছবি গুলো না পাঠিয়ে আমাকে ছোট্ট একটা টেক্সট করে দিলেও পারতে অবন্তী যে তোমার আমাকে আর ভালো লাগে না । আমার চেয়ে বেটার কাউকে পেয়ে গিয়েছ তুমি। গত চার বছরের সম্পর্ক টা পরিণতি পেতে আর মাত্র চার মাস সময় তুমি আমাকে দিলে না । 
— বিশ্বাস করো এসব অভ্র করেছে। আমি তোমাকে পুরো ব্যাপার টা লিখে..
— অভ্র কে? ওহ আচ্ছা শুভ্র'র বিকল্প অভ্র ।। আচ্ছা বিকল্প নাকি প্রতিস্থাপক?
— কিছুই না । শোন তো আমার পুরো কথা।
— একদম ন্যাকা কান্নার নাটক করে ইনোসেন্ট সাজবে না বলে দিলাম। 
.
— বিশ্বাস করো আমি লোকটাকে চিনিও না । কোত্থেকে কি হয়ে গেল আমি নিজেও জানি না । আমি নিরুপায় ছিলাম। না পেরেছি তোমার সাথে যোগযোগ করতে না অন্য কোন ফ্রেন্ডের সাথে। পালাতেও চেয়েছিলাম বিশ্বাস করো পারিনি। 
.
— এখন আমাকে এসব শোনাচ্ছ কেন? বেশ সুখেই তো আছ বলে মনে হয় । ছবি দেখে তেমন ই লাগছিল। আমার দূরে থাকা , যোগাযোগহীনতা তোমার বরাবরই অপছন্দ ছিল। এখন নিশ্চয় এমন কাউকে পেয়েছ যে সব সময় তোমার সাথেই থাকে। বেশ ভালো ফ্যামিলি ও মনে হলো । আমি তো এতিম ।চাল চুলো নেই ।আমি আর তোমাকে কি দিতে পড়তাম বলো? নিজেকেও তো ঠিক মতো দিতে পারতাম না । অন্য কিছু তো অনেক দুরের ব্যাপার। এখন নিশ্চয় বাড়ি,গাড়ি আর টাকার বিছানায় শুয়ে থাকো।
.
— শুভ্র তুমি তো এমন ছিলে না? আমাদের মাঝে একমাত্র সম্বল ছিল বিশ্বাস। অথচ তুমি আজ বিশ্বাস ই করতে চাইছ না আমায়?
.
— বিশ্বাস এর কথা তোমার মুখে মানায় না অবন্তী। আমি নিজেও তোমাকে দিনের পর দিন বিশ্বাস করে এসেছি। এত দুরত্ব থাকা সত্বেও শুধু মাত্র বিশ্বাস এর ওপর টিকিয়ে রেখেছিলাম সম্পর্ক টা । অথচ তুমি আমার বিশ্বাস এর এই মূল্য দিলে? তুমি অত্যন্ত স্বার্থপর এবং লোভী একটা মেয়ে।
.
.
অবন্তী কিছু বলতে চেয়েও পারে না । কথা গুলোর উত্তর ভেতর থেকে কান্না যেন আটকে ধরে।  
শুভ্র বলতেই থাকে,
.
" আমি ছোট বেলা থেকেই নিজের আপন বলতে কাউকে পাই নি। জন্মের আগে বাবা মারা গেল, জন্মের পর মায়ের আবার বিয়ে অতপর আমি দাদির কাছে। সেই দাদিও কয়েক বছর পর চলে গেল। তারপর থেকে ফুফুদের বাড়ি লাথি ঝাটা খেয়ে বড় হয়েছি। আমার এই অপ্রাপ্তির জীবনে প্রাপ্তি হিসেবে শুধু তোমাকে চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম হয়ত পেয়ে গেছি আমার প্রাপ্তি, হয়ত পেয়েছি আমার আপনজন। কিন্তু সেই তুমি?? আমার কথা একটা বার ও ভাবলে না তাই না? ভাববেই বা কি করে? অভ্র তো শুভ্র'র চেয়ে সব দিক দিয়ে ওপরে তাই না?"
.
— শুভ্র উনি আমাকে ডিভোর্স দিতে চেয়েছে। তুমি চলে আসলেই আমরা...
.
— বাহ। দারুন একটা কথা শোনালে তো । আসলে তোমরা মেয়ে মানুষের জাতটাই খারাপ। আমার মা ও এমন ছিল বাবা মারা যাবার পর আমার কথা না ভেবেই বিয়ে করে নিল গ্রামের বড়লোক বুড়ো কে তারপর ..যাই হোক আবার তুমিও তো অনেকটা একই রাস্তায় হাটছ দেখছি। প্রথমে আমাকে কমিট করলে তারপর আর তর সইল না বিয়ে করে নিলে বড়লোক কাউকে অতপর সেই স্বামী ছেড়ে দেবে বলে আবার আমার কাছে আসতে মন চাইছে? 
.
— ব্যাপার টা এমন নয় শুভ্র। আমি বুঝতে পারছি তোমার এসব হঠাত করে শুনে বা দেখে মাথা ঠিক নেই। তাইত নিজেও কান্নাকাটি করতে শুরু করেছ। তুমি মাথা ঠান্ডা করো । আমি বলছি তো পুরোটা বলব আমি তোমাকে । 
.
— আমার এখন এসব কিচ্ছু শুনতে ভালো লাগছে না বিশ্বাস করো । দোয়া করি অনেক অনেক সুখে থাকো । আমাকে মানাতে এত্ত এত্ত মিথ্যা না হয় কষ্ট করে না ই বললে। 
.
.
কথাটা বলেই শুভ্র ফোন কেটে দিল। 
অবন্তী কাদতে কাদতে পেছন ফিরতেই সজোরে ধাক্কা খেল অভ্র'র বুকের সাথে।আশ্চর্য মানুষটা তো ঘুমোচ্ছিল কখন থেকে পেছনে এসে দাড়িয়ে আছে কে জানে। অভ্র ভ্রূ নাচিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে পাজাকোল করে নিল অবন্তীকে। 
.
— এভাবে ভুত দেখার মতো চমকে উঠলে কেন? আমি কি ভুত?
— আপনি ভুত না হলেও অদ্ভুত।
.
.
.
চলবে.........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন