অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ৩৫ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


-ভিনা,দেখা করার দরকার ছিলো।

-আমার এক্সাম সামনে,এক্সামের পরে দেখা করি?

-জাস্ট একটা ঘন্টা,প্লিজ। 

-ফোনে বলো।

-ইটস আর্জেন্ট!

-এক ঘন্টাই।ছাদে?

-আবার কোথায়।

ভিনা চেয়ার থেকে আড়মোড়া দিয়ে উঠে বসলো।দুপুর থেকে টানা পড়েছে,তাছাড়া বাইরের পরিবেশ টাও বেশ ভালো লাগছে।ঘরের মলিন ট্রাউজার,আর ঢোলা হাফ হাতা ফতুয়া আর কোনো মতে একটা স্ফার্ফ গলায় ঝুলালো।ছোট্ট একটা পার্সে গুণে গুণে পঁচিশ টাকা নিলো।যদিও টিউশনি করে ভালো টাকা জমেছে,কিন্তু খরচ এখন আগের চেয়েও কম করা হয়।বাসায় সোহেল নেই,মুনা খুব সম্ভবত ঘুমাচ্ছে।তাই এক্সট্রা চাবি নিয়েই বের হয়ে গেলো ভিনা।ছাদে আসার পর দেখলো যাবির অন্যমনস্ক হয়ে পায়চারি করছে।

-কী হলো বলো তো।

যাবির চমকে পিছে তাকালো।

-তোমাকে না একটু আগেই ফোন দিলাম?

-হ্যাঁ, তো?

-এত জলদি কীভাবে পারো?

-তুমি কোন এমন বান্দা যার জন্য ঘন্টাখানেক প্রিপারেশন নিয়ে আসতে হবে?প্রেম তো করিনা তোমার সাথে।

-প্লিজ ভিনা,এখন এসব কথা বাদ দাও।

-দিলাম বাদ।বলো এখন কী হয়েছে।

-আসলে একটা মেয়ে আমাকে পছন্দ করে।

-কংগ্র‍্যাটস!তারপর?

-ভিনা,প্লিজ বি সিরিয়াস।

-আমি সিরিয়াসই,এরপর বলো কী হয়েছে।

-ঐ মেয়ে একটা সাইকোপ্যাথ।

-'ঐ 'মেয়ের একটা নাম তো আছে?

-হ্যাঁ,জেরিন।

-তো এখন সমস্যা কী?

-জেরিন এখন আমার সাথে একি ইন্সটিউশনে।

-বাপরে বাপ!দেখতে কেমন?

-যেমনই হোক।তাও যদি জানতে চাও বলি,আমার কাছে ওকে এনাবেলের মত লাগে।

-খারাপ না।

-ভিনা তুমি কিন্তু এখনো সিরিয়াস না।

-আজব তো!এখানে সিরিয়াসনেস কী দেখাবো আমি?কাঁদতে কাঁদতে ছাদ থেকে লাফ দিবো?

যাবির রেলিং এ ঢেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।কীভাবে বুঝালে ভিনা এর সিরিয়াসনেস বুঝবে এবং সত্যিই কান্নাকাটি করে ছাদ থেকে লাফ দিতে চাবে সেটাই ভাবছে।কিছুক্ষণ ভেবে হতাশ হলো,কারণ ভিনাকে আসল কারণ টাই বলা হয়নি।বলার পর দেখা যাবে যে এমন রিয়েকশন দিবে যে নিজেরি লাফ দিতে ইচ্ছা করবে।লম্বা শ্বাস নিয়ে যাবির আবার বলা শুরু করলো।

-আমি জেরিন কে বলেছি আমি একটা মেয়ের সাথে দুই বছর ধরে সম্পর্কে আছি।

-দেড় বছর না মাত্র হলো আমাদের?

-আমি তো আমাদের কথা বলিনি,আর বড় কথা আমাদেরটা কোনো সম্পর্ক না,তাই না?

তাচ্ছিল্যের একটা হাসি দিলো যাবির।

-তাইতো,তুমি তো আরেকটা সম্পর্কেও থাকতে পারো,ভেবেই দেখিনি।পারডন মি,প্লিজ কন্টিনিউ।

যাবিরের এবার সত্যিই নিজের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছা করছে।

-দেখো ভিনা।আমরা এই মাইন্ড গেম খেলা বন্ধ করি ওকে?মূল কথা হলো আমি জেরিন কে বলেছি আমি একটা সম্পর্কে আছি,মেয়ের নাম ভিনা,আমি ওকে ভালোবাসি।

-আমার নাম কেন নিলে।নিজের স্বার্থে অন্যকে বলির পাঠা বানানো ইজ ভেরি ব্যাড যাবির।

ভিনা কোনোমতে হাসি চেপে পিছনে ঘুরে দাঁড়ালো।যাবিরের অবস্থা টের পেয়ে আরো মজা লাগছে।যাবির এবার হাত টান দিয়ে ভিনাকে নিজের মুখোমুখি দাঁড় করালো।

-বলেছি না সিরিয়াস হতে?জেরিন বলেছে ও আমাদের সম্পর্ক ভাঙবে।

-পুচকে একটা মেয়ের হুমকিতে যদি এই অবস্থা হয়,তাহলে তো মুশকিল।আর সম্পর্ক না,'হতে পারে' সম্পর্ক এটা।

-এনাফ।নাম দাও বা না দাও ভিনা,সম্পর্ক কিন্তু থেমে থাকে না।তুমি নামহীন করলেই যে সম্পর্ক বদলে যাবে,বা থাকবে না,এটা ভুল।ইভেন তুমি নাম না দিয়ে যে আনসার্টেনিটি ক্রিয়েট করে রেখেছো,সেটা আরো বেশি গভীর করবে সম্পর্ক। 

‌ভিনা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো।এই প্রথম যাবিরের মধ্যে অধিকার ব্যাপারটা লক্ষ্য করছে।ভিতরে তোলপাড় হয়ে গেলেও নিজেকে শান্ত রাখলো।

-আগে থেকে তো জানিয়েই দিয়েছো,সমস্যা আর হবে না।আই উইল হ্যান্ডেল।

-শিওর?

-হুম।নিচে চলো,চা খেয়ে বাসায় চলে যাবো।

দু'কাপ চা আর বাদাম। ভিনা জানত যাবির মানিব্যাগ নিয়ে নামবে না।যাবির জানত, ভিনা গুনে গুনে পঁচিশ টাকাই আনবে।

ঘরে ঢুকেই মুনার সাথে দেখা হলো।ইদানিং শাড়ি পড়া শুরু করেছে সে।শাড়ি ভিনার মা আগে পড়ত।খেয়াল করে ভিনা দেখলো শাড়িটা ওর মারই।বেশ বিরক্ত হলেও চোখে মুখে প্রকাশ পেতে দিলো না।

-কোথায় গিয়েছিলে?

-এইত বাইরে।

-কোনো কাজ ছিলো?

-না,এমনি চা খেতে নেমেছিলাম।

-আমাকে বললেই হত,আমি কিন্তু ভালো চা বানাই।

-ঘুম ছিলে,তাই ডাকিনি।

-একাই গিয়েছিলে চা খেতে?

-হ্যাঁ 

-তোমার ফ্রেন্ড নওমি কে যে দেখিনা?

-ও ব্যস্ত থাকে। তাছাড়া আমাদের কলেজ ও তো আলাদা।

-আচ্ছা যাই হোক,আমি একটু শপিং এ যাচ্ছি।তোমার জন্য কিছু আনবো?

-না।

-পার্সোনাল কোনো কিছু?আন্ডারগার্মেন্টস বা ন্যাপকিন?

-না....

-ঠিক আছে,আমি বের হলাম,দরকার হলে ফোন দিও।

মা মারা যাওয়ার পর এসব জিনিস নিয়ে ভিনাকে বেশ ভুগতে হয়েছিলো।সাধারণত বাবার সাথে মেয়েরা এসব ব্যাপারে শেয়ার করতে পারে না।কিন্তু রুপিন আন্টি আর যাই হোক না কেন,এসব ব্যাপারে শুরু থেকেই খেয়াল রেখেছে।কলেজে ওঠার পর ভিনা নিজেই এসব কেনাকাটা করে।মুনার বিয়ের বছরখানেক পর মনে হলো বাসায় একটা টিনেজার মেয়ে আছে,তাও মনে যে পড়েছে এই বেশি।কিছু ব্যাপার অগ্রাহ্য করতেই হবে,নাহলে জীবনে চলা মুশকিল।

মুনা নওমির কথা তোলার পর থেকেই মন ভারী হয়ে আছে।শেষবার যা ঘটেছিলো,তা কোনোভাবেই ভোলার মত না।কিন্তু তাও,কোথায় যেন নওমির জন্য একটা টান রয়ে গেছে। সেই টান থেকেই ভিনা নওমির নাম্বার ডায়াল করলো।রিং হলেও কেউ রিসিভ করলো না।ফেসবুকে নওমির আইডি ডিএক্টিভ,হয়ত।বেশিক্ষণ এই বিষয়ে আর চিন্তা করলো না ভিনা।পুরোনো বিষয়ে স্মৃতিচারণ চোরাবালির মত,অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাহাকারের মধ্যে টেনে নিয়ে যাবে।


নওমি একবার মোবাইলটা দেখে রেখে দিলো।ভাবতেও অবাক লাগছে এতকিছুর পর ও ভিনা ওকে ফোন দিয়েছে।কিন্তু কোন মুখে কথা বলবে ভিনার সাথে?অনুশোচনা ছাড়াও বিতৃষ্ণা আছে,নিজের প্রতি,জীবনের প্রতি।কিছুদিন আগেই ওর মা বাবার সেপারেশন হয়েছে।দাম্পত্য কলহের জন্যই মূলত নওমির দিকে তেমন একটা খেয়াল করেনি ওর মা।এখন আগের বাসা ছেড়ে দিয়েছে।নওমি এখন ওর মার সাথে দুই রুমের একটা ফ্ল্যাটে থাকে।সাধারণ মধ্যবিত্ত জীবন।তানভিরের সাথে ব্রেক আপ,মা বাবার ডিভোর্স, লাইফস্টাইলে বিশাল চেঞ্জ, সব মিলিয়ে পড়াশোনা আর চালাতে পারেনি। হয়ত কন্টিনিউ করবে,আরো পরে।


মুনা শপিং থেকে আসার পথে নিজের বাসায় সাহস করে একবার গেলো।কত মাস পর!কাঁপা হাতে কলিং বেল বাজাতেই ভেতর থেকে অপরিচিত এক মহিলা গেট খুললো।

-আপনি কে?

-আমি মুনা,আমার মার বাসা এটা।

-সাইফুন খালা তোমার মা হয়?

-হ্যাঁ, কোথায় উনারা?

-দোলার বিয়ে আজকে,সেন্টারে গেছে।

-দোলার বিয়ে!

-হ্যাঁ 

-আপনি কে?

-আমি পাশের ফ্ল্যাটেই থাকি,বিয়ের কাজের হেল্প করার জন্য এসেছি।ঘরে আরো মেহমান এসেছে,বসবে?

-না,আমি আসি আজকে।

মুনা সোজা গাড়িতে উঠলো।রক্তের সম্পর্কও আজকাল অচেনা হতে সময় নেয় না।


জেরিন পুরো ঘর জুড়ে হাঁটাহাঁটি করছে।যাবিরের জন্য মেডিকেলে পর্যন্ত ও গেলো না,সেই যাবির অন্য মেয়েকে পছন্দ করে বসে আছে।ইচ্ছে করছে নিজের সবগুলো চুল ছিড়ে ফেলতে।কোনোমতে মাথা ঠান্ডা রাখছে।মেয়ের পরিচয় জানা গেলেও একটা ঝামেলা লাগানো যাবে।কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা মেসেজ এলো ফোনে,যেটা দেখে মুখে হাসি ফুটলো জেরিনের।
.
.
.
চলবে................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন