পরিণয়ে পরিপূরক - পর্ব ১৪ - স্পৃহা নূর - ধারাবাহিক গল্প


 অভ্র একদম ঘেমে উঠেছে ঠোট নাড়িয়ে নাড়িয়ে নিজে নিজে কি কি সব বিড় বিড় করে যাচ্ছে কিন্ত এত আস্তে আর অস্পষ্ট অবন্তী কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না । ঘুমের ভেতর ই চোখের কোন বেয়ে পানি পড়ছে অভ্র'র।
.
অবন্তী ঠোটের কাছে কান পেতে শোনার চেষ্টা করে । শুধু অসপষ্ট কিছু শব্দ ছাড়া কিছুই শুনতে পায় না । এদিকে ঘাম বেড়েই যাচ্ছে ।  
অবন্তী কয়েকবার ডাকার পর ঘুম থেকে ধরফরিয়ে ওঠে অভ্র। উঠেই আশেপাশে এমন ভাবে তাকাতে থাকে যেন সে এতক্ষণ অন্য কোথাও ছিল আর এখানে কিভাবে এসেছে বুঝতেই পারছেন না । 
.
— অভ্র..এই অভ্রনীল । কি হয়েছে আপনার? দুঃস্বপ্ন দেখেছেন? ভয় পেয়েছেন? এইত আমি আছি তো। দেখুন রাত শেষ ভোর হয়ে এসেছে প্রায়। এরকম কেন করছেন?
.
অভ্র কোন কথাই বলে না।আশেপাশে তাকানো শেষ হলে অবন্তীর শাড়ির আঁচল টেনে নিয়ে ঘাম মুছতে থাকে। তারপর বলে,
— পানি কই?
— পা...নি...। আনা হয় নি আজ মে বি। দারান আমি নীচ থেকে এক্ষুনি আনছি। 
.
— বাহ এই হলো অবস্থা । একদিন একটু ঘুমিয়ে পড়েছি আর তুমি সামান্য পানি টাও রুমে এনে রাখতে পারো নি? কি কাজ করতে আছ এ বাড়িতে তুমি? সারাদিন শুধু অকাজ কাজের বেলায় কিচ্ছু নেই। (অভ্র ধমক দিয়ে ওঠে)
.
অবন্তী কথাটা শুনে চোখ মুছতে মুছতে চলে গেল নিচে পানি আনতে। রাতে যদি কোন অসুবিধা হয় সেই ভেবে সারারাত জেগে তার পাশে বসে থাকার পর এরকম আচরণ সে কল্পনা ও করেনি।
.
এদিকে অভ্র সেই ফাকে উঠে গিয়ে আলমারিটা ঠিক মতো লক করা আছে কি না আর একবার চেক করে নিল। অবন্তীকে সে এটা টাচ ও করতে দেয় না । বলেছে ওর জামা কাপড় আলমারিতে থাকবে আর অবন্তীর গুলো অয্যার ড্রোবে রাখতে। তারপর মেডিসিন বক্স থেকে ডিপ্রেশন এর ওষুধ খুজে নিয়ে দুতিনটে তাড়াহুড়া করে ছিড়ে মুখে পুরে নিল। ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানির ঝাপটাও দিয়ে নিল।
অবন্তী আসতেই হাত থেকে বোতল টেনে নিয়ে পুরো এক বোতল পানি এক নিশ্বাসে খেয়ে নিল।
.
— বলুন আর কি কি কাজ করতে হবে?? আমি এক্ষুনি করে দিচ্ছি। 
— কিহ?
.
— আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম এ বাড়িতে আমাকে আপনার কাজের জন্য ই আনা হয়েছে । ভুলে গিয়েছিলাম কি না,তাই সারাদিন শুধু অকাজ করেছি। 
.
— এই তুমি কি বলছ এসব?
.
— ঠিক ই তো বলছি। রাতে কত টেনশনে ছিলাম আপনি জানেন?? সামান্য একটা কাজ ভুলে গেছি বলে আপনি আমাকে এভাবে বলবেন? " কি কাজ করতে আছ তুমি এ বাড়িতে?" এ কথা টা বলে আপনি আমাকে কত টা ছোট করলেন বুঝতে পারছেন আপনি? স্পষ্ট ভাবে বলেই দিলেন তাই না যে আমাকে কাজের জন্য আনা হয়েছে? আর রুমে পানি, শুকনো খাবার, চকলেট এসব রোজ রোজ কে এনে রাখে শুনি? আপনি তো? আমার অভ্যেস থাকলে আমি অবশ্যই আজ ভুলে যেতাম না । আপনার জামা কাপড় গুছিয়ে আলমারি তে রাখার সামান্য অধিকার টুকু ও তো আপনি আমাকে দেন না ।
.
— ওহ আচ্ছা এই ব্যাপার, বৌ এর আমার অধিকার নেয়ার শখ হয়েছে। ( অভ্র মুচকি হেসে ওর দিকে এগোতে এগোতে বলে)
 .
— দেখুন কথা একদম ঘুরাবেন আপনি। তার চেয়ে বলুন আর কি কি সার্ভিস দিতে হবে? এমনি এমনি নিশ্চই কিনে আনেন নি। এরকম মুচকি হাসি থামান বলছি । 
.
অভ্র ওকে পাজাকোল করে তুলে নিয়ে রুমের লাইটস অফ করে দিয়ে কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলে,
— সার্ভিস দেয়ার খুব শখ তাই না? চলো আজ সকাল না হওয়া পর্যন্ত সার্ভিস দেবে তুমি আমাকে। 
— মা...মা মানে? এই কি পাগলামো করতে চাইছেন আপনি?
.
অবন্তী কে বিছানায় ফেলে দিয়ে অভ্র নিজের কোমরে দু হাত দিয়ে অট্টহাসিতে হাসতে থাকে। 
— উফ্ফ। তুমি পারো ও বাবা। এত ভয় কেন পাও আমাকে? এইত একটু আগে খুব গালি দিচ্ছিলে ভালোই লাগছিল শুনতে । 
— না । মানে..মানে
.
— হয়েছে আর মানে মানে করতে হবে না । সার্ভিস যখন চেয়েছি তা তো নেবই আমি। আমি এখন তোমাকে গান শোনাব, গল্প করব। আর তোমার কাজ হচ্ছে চুপচাপ সেসব শোনা আর আমার সাথে গল্প করা। 
.
অভ্র বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে অবন্তীর কোলে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে ফেলে । ঘুমের ইনজেকশন পুশ করা থাকায় ঘুম ঘুম ভাব আবার চলে এসেছে। তন্দ্রা তন্দ্রা ভাব নিয়েই গাইতে শুরু করে,
.
.
তোমার গানের সুর
আমার পকেট ভরা সত্যি মিথ্যে 
রেখে দিলাম তোমার ব্যাগের নীলে 
জানি তর্কে বহুদুর
তবু আমায় তুমি আকড়ে ধর
আমার ভেতর বাড়ছ তিলে তিলে ...
.
.
— এসব আজগুবি গান বাদ দিয়ে ঘুমান তো আপনি । এসব শুনে মনে হচ্ছে ঘুমের ঘোরে মাতলামো করছেন।
— হুম
— আর একটা কথা,কিসের পকেট ভরা সত্যি মিথ্যে আপনার?
— হুম??? বাদ দাও তো । সেসব অনেক কথা। তোমাকে একটা গল্প শুনাই আগে ।
— জানি বলবেন না । কথা ঘোরালেন তো? ডক্টর কেই বলেন না আর তো আমাকে!
.
— ধুর। ডক্টর কে যে তাকে সব বলতে হবে? তুমি তো আমার সব কিছু তোমাকে বলব না তো কাকে বলব? শোন না, আমি কি বলছি, আমরা একদিন অনেক দূর হাটব ঠিক আছে?
.
— কোন দিন?
— যেদিন কৃষ্ণচূড়া ফুল ফুটবে। 
— কৃষ্ণচূড়া আপনার প্রিয় ফুল বুঝি?
— হুম খুব। 
— আর আমার প্রিয় ফুল কি জানেন? আমার প্রিয় ফুল..
— নীল অপরাজিতা। তাই না?
— কি করে জানলেন আপনি?
.
— আমি সব জানি। শোন না, আমরা যেদিন হাটব সেদিন সারা পথ কৃষ্ণচূড়া ফুল পড়ে থাকবে। পুরো পথে লাল গালিচা বিছানো যেন আমাদের জন্য । আমি সেখান থেকে কয়েকটা পাপড়ি কুড়িয়ে নেব। আর একটা ফুল গাছ থেকে ছিড়ব তোমার খোপায় গুজে দেব। আমি সাদা পাঞ্জাবি পড়ব পকেটে কয়েকটা লাল পাপড়ি তুমি লাল পাড় সাদা শাড়ি পড়বে খোপায় থাকবে লাল ফুল। 
.
— আচ্ছা ঠিক আছে সে দেখা যাবে। কৃষ্ণচূড়া ফুল ফুটতে এখনো অনেক দেরি। আচ্ছা আপনার এত ফুল থাকতে হঠাত এ ফুল পছন্দ কেন শুনি? এর চেয়ে নীল অপারিজিতা ঢের ভালো । 
.
— উহু । কৃষ্ণচূড়া ফুলে আলাদা মায়া আছে। অন্য ফুল তো মরে গেলে নিজের রঙ নষ্ট হয়ে গেলে তারপর ঝরে যায় । আবার শিউলি,বকুল কে দেখো ওরা ফোটার সাথেই ঝরে যায় । কিন্তু কৃষ্ণচূড়া সবার থেকে আলাদা। ও নিজের জন্য কিছু রাখে । কিছু অংশ গাছ কে রঙিন করে আবার কিছু অংশ ঝরে গিয়ে পথকে রঙিন করে । সে কিন্তু নিজের রঙ নষ্ট হবার আগেই ঝরে যায় যেন ঝরে গিয়েও অন্যকে রঙিন করতে পারে। আবার নিজের অস্তিত্ব কেও ভোলে না নিজের আপন অংশ গাছ কেও রঙিন রাখে। 
.
— অভ্র আমি মাঝে মাঝে সত্যিই অবাক হই। আপনি এত সুন্দর কথা কিভাবে বলেন? সদ্য বিয়ের পর দেখা অভ্র আর এখনকার অভ্র কতটা আলাদা। আপনি বুঝতে পারেন আপনি কতটা বদলাচ্ছেন দিন দিন?
— আমার বুঝতে হবে না । তুমি বুঝ্লেই হবে।

.
.
 পরের দিন ড.রেহানা জামান এলে অভ্র তাকে সরাসরি বলে দেয়, তার এসবের দরকার নেই। সে নিজেই নিজেকে সামলানো শিখে গেছে । মেন্টালি ফিট থাকার জন্য তার কোন হেল্প এর প্রয়োজন নেই।
সে ডক্টর কে বাড়ির গেট থেকেই অপমান করে বের করে দেয়। তবুও ডক্টর গেটে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে । গেট থেকেই কিছুটা বোঝানোর চেষ্টা করে তাকে ঢুকতে দেয়ার জন্য ।
কিন্ত অভ্র গার্ডের সাথে জোর করেই ব্যাডমিন্টন খেলতে শুরু করে ডক্টর কে দাড় করিয়ে রেখেই। গার্ড দেয়া বাদে তাকে বাধ্য হয়ে খেলতেই হবে অভ্রর সাথে । তাছাড়া অভ্র মেরে যা ইচ্ছা তাই করবে। যতক্ষণ ডক্টর চলে না যায় ততক্ষণ খেলতেই থাকে।
ডক্টর নিজেও অবাক হয় আগের রাতে এত ভেঙে পড়া অভ্র আজ এত স্বাভাবিক আচরণ কি করে করছে।গার্ড এর সাথে হাসছে আর খেলছে। মনে হচ্ছে তার সাথে যেন কোন দিন কিছু হয় ই নি। 
.
.
অভ্র ডক্টর এভাবে কে ফিরিয়ে দিয়েছে শুনে আজমির চৌধুরী মিসেস রেহানার চেম্বারে নিজে গেলেন ছেলের হয়ে মাফ চাইতে। 
"এই ছেলের জন্য আমাকে জীবনে আরো কত বার কত ভাবে অপমানিত হতে হবে কে জানে।" একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেই নিজেকে বলেন উনি। 
.
.
অনেক্ষন কথা বলার পর অভ্র'র বাবা চলে যাবার সময় কি যেন মনে হয়ে আবার ফিরে আসে, 
.
— আমার মনে হয় অভ্র'র ডক্টর হিসেবে আপনার আর একটা কথা জানা জরুরি ।
— জ্বি বলুন না । অভ্র তো আমাকে কিছুই বলে না ।
— হুম । আসলে ও বলতেই চাইত সবাই কে সব কিছু । আগের ব্যাপার টা সবাই কে বার বার বলেও কেউ বিশ্বাস করে নি তখন থেকেই ও কাউকে তেমন কিছু বলতে চায় না । কিন্তু পরের ব্যাপারটা যদিও আমরাই প্রথম প্র‌থম ফোর্স করেছি বাড়ির বাহিরে কাউকে না বলতে। কিন্তু ও যে এখন ব্যাপারটা আপনাকেও বলতে চাইছে না কেন, আর নিজের ব্যাপারে এত বেশি চাপা হয়ে গেল কি করে কে জানে । কারণ কারো ফোর্সে চলার মতো ছেলে যে ও না সেটা নিশ্চই আপনি বুঝতে পেরেছেন। 
.
— হ্যা মি. চৌধুরী আমি নিজেও বুঝেছি ও কিছু লুকোতে চায় । আর পরের ব্যাপার মানে? 
.
— আসলে অভ্রনীলের জীবনে অতীত একটা নয়। প্রথম অতীত টার পর আরো একটা অতীত আছে।
.
.
.
চলবে..........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন