পরিণয়ে পরিপূরক - পর্ব ১৫ - স্পৃহা নূর - ধারাবাহিক গল্প


— আসলে অভ্রনীলের জীবনে অতীত একটা নয়। প্রথম অতীত টার পর আরো একটা অতীত আছে।
.
ড.রেহানা পুরোটা শুনে শুধু একটা কথাই বললেন,
"পৃথিবীর সব কমপ্লিকেশন সৃষ্টিকর্তা বুঝি এই ফুটফুটে ছেলেটার ভাগ্যেই লিখে রেখেছেন"
.
.
ডক্টর অভ্রকে উনার চেম্বারে নিয়ে আসার জন্য বললেন। বাড়িতে থাকলে অভ্র ফাকি দেয়ার বেশি সুযোগ পেয়ে যায় । হসপিটাল ডক্টর এর নিজের ক্ষেত্র। এখানে কোন রোগীকে হ্যান্ডেল করা বাড়ির তুলনায় সহজ।
.
আজমির চৌধুরী বুঝতে পারলেন এবিষয়ে একমাত্র অবন্তী ই রাজি করাতে পারে ওকে। উনিই অবন্তীকে অনুরোধ করলেন অভ্র কে যেভাবে পারে রাজি করাতে। 
.
অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে অবশেষে অবন্তী রাজি করাতে পেরেছে অভ্র কে। এর বিনিময়ে অভ্র নিজের কিছু উসুল করে নিয়েছে। সে আজ নিজ কপালে প্রিয়তমার ঠোটের উষ্ণ স্পর্শ নিয়েছে। কারণ সে জানে পৃথিবীর সব চেয়ে শুদ্ধতম ভালোবাসার বহিপ্রকাশ হলো কপালে চুম্বন। তাছাড়াও অবন্তীকে রাজি হতে হয়েছে রাতে ক্যান্ডেল লাইট ডিনারে যেতে ওর সাথে । অভ্রও মনে মনে ঠিক করে নিয়েছে আজ রাতে অফিশিয়ালি প্রপোজ করবে তার অতি প্রিয় পরিপূরক অবন্তী কে। সারপ্রাইজ দেবে তাকে।
হ্যা সে বুঝতে পেরেছে তার এই সত্ত্বার পরিপূরক একমাত্র অবন্তী। পরিণয়ের বাধনে সৃষ্টিকর্তা তাকে তার পরিপূরক হিসেবেই অবন্তীকে পাঠিয়েছে ।
.
.
সন্ধ্যা বেলা দুজনই বের হলো প্রথমে হসপিটাল যাবে। তারপর ক্যান্ডেল লাইট ডিনার । অভ্র আগেই সেসব বুক করে রেখেছে । বিকেলে গিয়ে সেসব ডেকরেশন নিজে চেক করে এসেছে। সব কিছু মনের মতো করে সাজিয়েছে। 
অবন্তী ডার্ক মেরুন রঙের শাড়ি পড়েছে । ডার্ক মেরুন এর ওপর ব্ল্যাক কালার গর্জীয়াস কাজ করা । সাথে ডায়মন্ড এর হালকা নেকলেস,এয়ার রিং, নোজ পিন । অভ্র তার সাথে ম্যাচিং করে ব্ল্যাক শার্ট, স্যুট আর ডার্ক মেরুন টাই পড়েছে। হাতে ব্ল্যাক কালার রলেক্স রিস্ট ওয়াচ। দুজন কে আজ কারো কোন অংশে কম মনে হচ্ছে না । যে কেউ দেখে বলবে এরা একে ওপরের পরিপূরক।
.
.
অভ্র ডক্টর এর চেম্বারে ঢুকেছে, অবন্তী বাইরে ওয়েটিং রুমে বসে বসে অপেক্ষা করছে। 
সে জানে না এই অসুস্থ ছেলেকে সুস্থ করতে তাকে আরো কি কি করতে হবে । আরো কত আবদার মানতে হবে তার। কিন্তু বাবাকেও যে কথা দিয়ে ফেলেছে তার ছেলেকে সুস্থ করতে নিজের সাধ্য মতো চেষ্টা করবে। আর যা হোক, অভ্র'র বাবাকে সে তার নিজের বাবার স্থান দিয়েছে। এদিকে আর এক জন ভুল বুঝে বসে আছে । তার ভুল ভাঙানোর জন্য তেমন কিছুই করতে পারছে না অবন্তী। ছোট বাচ্চারা বায়না ধরলে যেমন অন্যরা তাদের সান্তনা দেয় আকাশের চাদ এনে দেবে বলে, বাচ্চাটাকে শান্ত করে রাখার জন্য । অভ্র কি সেরকম ই একটা কথা দিয়ে রেখেছে তাকে? ও তো নিজেই মানসিক ভাবে অসুস্থ ওর আবার কথা দেয়া !! 
তবুও যে সেদিন সুস্থ মস্তিষ্ক নিয়ে কথা দিয়েছিল তা ও না। সেদিন ও ভয় পেয়েই কথা দিয়ে ফেলেছিল।যদি অবন্তী মারা যায় সে ভয় ই তো পেয়েছিল সেদিন। এসব যে কি হচ্ছে তার সাথে এসবের শেষ পরিণতি যে কি ঘটতে যাচ্ছে । মেঝের দিকে তাকিয়ে সেসব ই ভাবতে থাকে অবন্তী। অভ্র'র কথার ওপর ভরসা করে এভাবে চুপচাপ থাকা ও হয়ত ঠিক হচ্ছে না । অভ্র কিছুটা সুস্থ হোক,তারপর তাকে নিজেকেই নিজের পথ ঠিক করে নিতে হবে । মনে মনে সে সিদ্ধান্ত ই নেয় সে। কিন্তু ততদিন অপেক্ষা করবে তো শুভ্র? এ প্রশ্নের ও উত্তর নেই অবন্তীর কাছে । 
.
.
অভ্র বেশ হাসি খুশি হয়ে ঢুকল চেম্বারে। সে জানে আজ ও ডক্টর তার কিছুই করতে পারবে না । কিন্ত এই কারণ দেখিয়ে অবন্তীকে নিয়ে ঘুরতে বের হতে তো রাজি করাতে পেরেছে। 
.
চেয়ারে বসতেই ডক্টর হাসি মুখে তাকে জিজ্ঞেস করলেন,
— ওয়াইন নেবে?
— এক্সকিউজ মি?
— কেন তুমি তো খুব পছন্দ করো । নাও। 
(বোতল থেকে ঢেলে অভ্রের দিকে এগিয়ে দিল)
— আশ্চর্য কি হচ্ছে টা কি এসব?
— নাও। নাকি বিয়ার নেবে? নাকি আরো হার্ড কিছু?
— আমি ওসব খাই না । ছেড়ে দিয়েছি । 
— অবন্তীর জন্য ছেড়েছ তো?
— হ্যা। 
— আর ড্রাগস?
— ড্রাগস আমি কখনো ই রেগুলার নিতাম না যে সেটা অফিশিয়ালি ছেড়ে দিতে হবে । ক্লাবে মাঝে মাঝে ফ্রেন্ডস দের সাথে মজা করে নিতাম । 
— তাহলে সেদিন কি এমন মজা হয়েছিল যে তুমি এত এত ড্রাগস নিয়ে ফেললে? আর এত এত ড্রীঙ্ক করলে?
— আপনি কি বলছেন এসব? কোন দিন? আ...আমি এসব জানি না ।
— অভ্র তুমি খুব ভালো করেই জানো আমি কোন দিনের কথা বলছি। আমি মোটামুটি সব জানি অভ্রনীল।তোমার বাবা যেটুক জানেন সে টুকু আমাকে বলেছেন। এখন তুমি পুরোটা বলবে। 
.
— দেখুন আপনার সাথে এসব অ... অবান্তর গল্প করার মতো সময় আমার নেই । আমার আজ অন্য কাজ আছে। সো আ..আমি আসছি। 
.
— আজ তো তুমি নিজের ইচ্ছে মতো এখান থেকে যেতে পারবে না অভ্রনীল। পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখো তোমার দু পা অনেক্ষন আগেই লক করে দিয়েছে আমার এসিসট্যান্ট । তুমি কথার ফাঁকে বুঝতেই পারো নি। আমি জানি তুমি অনেক চালাক। কিন্তু এই প্রফেশনে থেকে কিছুটা বুদ্ধি যে আমাদের ও খাটাতে হয় বাবা।
.
— আপনি আসলে কি চান?
— তোমার সুস্থতা। 
— আমি যথেষ্ট ভালো আছি। প্লিজ আমাকে যেতে দিন। 
— তুমি এখনো ড্রাগস নাও তাই না?
— না তো ।
— স্যুট খুলে শার্ট এর হাতা কনুই পর্যন্ত তুলে দেখাও তাহলে। 
(অভ্র বাধ্য হয়ে তাই করল। হাতে ইনজেকশনের দাগ এখনো আছে)
.
— লাস্ট কবে নিয়েছিলে?
— তি..তিন চার দিন আগে । আমি কি করব বলুন আমার ভাল লাগে না বলেই তো নিই।তবুও মাসের শেষে টাকা থাকে না বলে নিতেই পারি না । বাবা টাকা ই দিতে চায় না আর আমায়। আগে তো মজা করে নিতাম। কিন্ত এখন ...
— এখন কি? ডিপ্রেশন ভুলতে?
— হুম।
— তাহলে এমন কাজ বার বার করো কেন? যাতে ডিপ্রেসড হয়ে পড়তে হয়?
— আমি কোন কাজ ই ইচ্ছে করে করিনি । বিশ্বাস করুন। মার ব্যাপার টা তো আমি করি ই নি। আর এটাও ভুল করে ।
— ছিহ। ইচ্ছে মতো ড্রাগস নিয়ে,মদ খেয়ে এত বড় কান্ড ঘটিয়েছ তারপর ও বলবে ইচ্ছে করে করো নি?
.
— আমি অত হাই ডোজের ড্রাগস নিতাম না ।বিশ্বাস করুন। সেদিন ডোজ এত বেশি ছিল আমি জানতাম না ।আর সেদিন অনেক টাকা জিতেছিলাম জুয়ায় তাই একটু সেলিব্রেট করতে.. আপনি এসব অবন্তী কে বলবেন না প্লিজ। পায়ে পড়ি আপনার।
.
— এখন ভয় লাগছে? এতদিন অসহায় সেজে সিমপ্যাথি কুড়িয়েছ তাই না মেয়েটার থেকে? আবার ওকে নিজের বশে আনার জন্যে ভালো সাজার নাটক করছ? অভ্র তোমার ওপর খুনী নামের একটা ট্যাগ ছোট থেকেই লাগিয়েছ এই খামখেয়ালিপনা আর সব কিছুতেই মজা খোজার জন্য । আবার সেই মজা খুজ্তে গিয়ে? ড্রাগস নেয়া, মদ জুয়া কোন কিছুই তো বাদ দাও নি তুমি দেখছি। 
.
— প্লিজ চুপ করুন। পায়ে পড়ি আমি। আমি বুঝতে পারি নি বললাম তো। সব কিছু আমার হাতের বাইরে ছিল। আমি নিজেকে কোন দিন ও ক্ষমা করতে পারব না এ ব্যাপারটায় । বলছি তো । এসব মনে হলে আমি ভেতর থেকে দুমড়ে মুচড়ে যাই । অনেক কস্ট হয় আমার বিশ্বাস করুন। আমার জন্য আ...আমার জন্য । কিন্তু আপনি বলবেন না অবন্তী কে আমার এসব ভুলের ব্যাপারে।বলবেন না আপনি। আমি সবে আমাদের মাঝে সব কিছু গুছিয়ে নিতে শুরু করেছি। আপনি এসব বলে ভঙতে পারেন না আমাদের সম্পর্ক।আর আমি কোন নাটক করছি না আমি সত্যি ওকে ভালোবেসে ফেলেছি।
.
— অভ্র আমার দিকে তাকাও । কত দিন হলো নাও তুমি ড্রাগস?
— অনেক আগে থেকেই কিন্তু রেগুলার না বললাম তো । 
— তোমার অর্পি আপু তোমার ড্রাগস , ড্রীঙ্স করা, ক্লাবে যাওয়া,জুয়া খেলা এসব জানত না? 
— হ্যা। আমি আপুকে বলতাম বাবা কে না বলতে। বাবা জানলে আমাকে দেশে ফিরে নিয়ে যেত হয়ত মারত ও । তাই আপুকে নিষেধ করতাম। আর তাছাড়া ও দেশে এসব ইজি ব্যাপার । আপু ভাইয়া ও ক্লাবে যায় । 
.
— আপু ভাইয়া যায় ঠিক আছে । কিন্তু তোমার মতো কিছু কান্ড বধিয়েছে কি?
.
— না । বললাম তো আমার হাতে ছিল না কিছু । আমার মাথা ঠিক ছিল না । ভুল ছিল ভুল পুরোটাই ভুল । 
.
— তোমার জীবনের সব কিছু শুধু ভুল ই থাকে? কি করে ফেলেছ তুমি কোন আইডিয়া আছে তোমার?
.
— দেখুন আপু আপনার কাজ আমাকে মেন্টালি রিলিফ দেয়া। সেখানে আপনি উল্টে আমাকে আরো প্রেশারাইজড করছেন।।
(অভ্র এক হাতে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে আর অন্য হাতে টাই ঢিলা করতে করতে কথাটা বলল)
.
— অভ্রনীল আমরা কখনোই আমাদের পেশেন্ট কে প্রেশারাইজড করতে চাই না । কিন্তু এর জন্য দায়ী তুমি নিজে। কেন সুস্থ হতে চাইছ না বাবা? 
.
— আমি সুস্থ ই আছি এখন আর অনেক হ্যাপি আছি আমার অবন্তী কে নিয়ে ।
— আমি ওকে তোমার ব্যাপারে এসব কিছু বলে দিলে থাকতে পারবে তুমি হ্যাপি?
— কেন বলবেন আপনি? কেন?
— কেন বলব না? তুমি তো আমার কোন কথা শুনছ না ।আমি কেন শুনব?
— আপনার কথা শুনলে বলবেন না তো?
— হুম।
— কি কথা শুনতে হবে বলুন?
.
— তুমি নিজেকে নিজেই হেল্প করবে সুস্থ হতে । আমার সব কথা মানবে? ভুলে যাবে পুরনো সব কিছু । আর কষ্ট পাবে না ওসব নিয়ে । ড্রাগস ও ছাড়বে। অন্য সব কিছুর মতো । নিয়মিত মেডিসিন নেবে। কাউন্সিলিং এও হেল্প করবে নিজেকে আর আমাকে। মোট কথা সুস্থ থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করবে? তুমি নিজে নিজেকে সুস্থ করতে হেল্প না করলে আমরা কিভাবে পারব বলো? আর পুরনো ওসব নিয়ে পড়ে থাকলে তুমি বধ্য উন্মাদ হয়ে যাবে ধীরে ধীরে ।আর অবন্তী কি তোমার মতো পাগলের সাথে থাকবে? ছেড়ে চলে যাবে তো ।।কথা দাও এখন থেকে নিজেকে সুস্থ করার সব রকম স্টেপ নেবে?
.
— আচ্ছা ঠিক আছে সব মানবো। এবার আমাকে খুলে দিন প্লিজ।  
(মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে বলে)
.
.
অভ্রকে এ অবস্থায় রুম থেকে বের হতে দেখে বেশ হতবাক হয়ে যায় অবন্তী।
— কি ব্যাপার চুল এলোমেলো, স্যুট খুলে ফেলেছেন, টাই টার এ অবস্থা, ঘেমে নেয়ে কি অবস্থা। ভেতরে কি তৃতীয় 
 বিশ্বযুদ্ধ করলেন নাকি?
— হুম ঐ রকম ই কিছু একটা । বাড়ি চলো । 
— বাড়ি? ডিনারে যাবেন না?
— ভালো লাগছে না । বাড়ি যাব।
.
.
সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতেই অভ্র আবার গড়গড়িয়ে বমি করতে শুরু করে দেয়। 
ডক্টর হসপিটালে এডমিট করে নেয় সেদিন ই। অভ্রকে কিছু দিন মেন্টাল এসাইলেমে রাখার জন্য বললেন বাড়ির সবাইকে । এতে ওর জন্য ই ভাল । কাউন্সিলিং হবে ঠিকঠাক মতো বাড়ির পরিবেশ থেকে কিছু দিন দূরে থাকবে।
.
হসপিটালে এডমিট হয়েও অভ্র'র বায়নার কোন শেষ নেই । তিন বেলা খাবার অবন্তী কেই নিয়ে যেতে হবে হসপিটালের খাবার সে খাবে না । অবন্তী আর রেণু খালা মিলে অভ্র'র স্পেশাল ডায়েট এর রান্না গুলো করে । অবন্তীকে সেগুলো তিন বেলা নিয়ে গিয়ে নিজ হাতে তুলে খাইয়ে দিতে হয় ।
অভ্র সত্যিই দিন দিন বেশ রিকভার করছে। এত তাড়াতাড়ি ও নিজের এতটা ডেভলপ করে ফেলবে তা ড.রেহানা ও বুঝতে পারে নি। উনি ভেবেছিলেন হয়ত কয়েক মাস সময় লাগবে এত কিছু ভুলে সব কিছু কাটিয়ে উঠতে। কিন্তু মাত্র ক'দিনেই ও নিজেকে একদম নতুন করে তুলেছে। 
.
.
আজ সাইত্রিশ দিন পর অভ্র বাড়ি ফিরবে। এ কদিনে যে অবন্তী তাকে একদম ই মিস করে নি তা ও নয়। 
.
সাইত্রিশ দিন পর জ্বালাতন করার মানুষ টা আবার ফিরে আসছে ভাবতেই অবন্তীর মনের কোনে আর ঠোটের কোণে এক টুকরো হাসি ফুটে ওঠে নিজের অজান্তেই।
.
.
.
চলবে............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন