অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ৪১ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


ভিনা কলেজ থেকে এসেই ঘুম দিলো,ভীষণ ক্লান্ত ছিলো।ঘুম থেকে উঠলো বিকেলে,দুপুরের খাবার তখনও খায়নি।খাবার টেবিল থেকে ভাত আর অন্যান্য তরকারি ওভেনে গরম করার সময়ে মুনা আসলো।

-পরীক্ষা কেমন হলো ভিনা?

-এইত ভালোই।

-যাক,এতদিন পর একটু রেস্ট পাবে এখন।ঘুমিয়ে ছিলে দেখে আর ডাকিনি।

-ভালো করেছো,আমি অনেক টায়ার্ড ছিলাম।

-তোমার তো আগামী সপ্তাহ দুয়েক তেমন কোনো কাজ নেই,তাই না?

-উমম,এখনি ঠিক বলতে পারছি না,কেন?

-বড় তো হয়ে গেছো।জানোই তো বিয়ের পর তোমার বাবার সাথে এ্যডজাস্ট করতেই অনেকটা সময় চলে গেছে,আমাকে নিয়ে বাইরে আর যাওয়া হয়নি।এখন তোমার বাবা আমাকে সময় দিতে চাচ্ছে, হানিমুনে যাওয়ার প্ল্যান করেছে।

ভিনা ধাক্কা খেলো,কিন্তু বাইরে প্রকাশ করলো না।বেশ হাসিমুখেই ওভেন থেকে খাবার বের করে বললো

-ভালোই তো,ঘুরে আসো তাহলে।

-তোমাকে একা রেখে,কখনো না!তোমার বাবা যদিও রুপিনের কথা বলেছিলো,কিন্তু তোমাকে রেখে আমার একটুও যেতে ইচ্ছে করছে না।আমি চাচ্ছি একটা ফ্যামিলি ট্যুর।পরে অবশ্য তোমার বাবাও রাজি হয়েছে তোমাকে নিতে।

-সমস্যা নেই।তোমরা ঘুরে আসো।আমি একবারে বোর্ড এক্সামের পরেই ঘুরবো।

-তুমি কি রাগ করলে?

-রাগ করবো কেন?

-এইযে,তোমার বাবার কথায়।

-রাগ করার কী আছে এতে।

-কত ম্যাচিউর তুমি!তোমার ব্যাপারে সোহেলের ধারণা কত ভুল!

-কী ধারণা?

-এইযে তুমি বেশি সেনসিটিভ,তোমার সাথে বেশ রেখে ঢেকে কথা বলতে হয়,বাচ্চাদের মত মন ভুলিয়ে রাখতে হয়,এসবই।

ভিনার গলায় কী যেন ভারী হয়ে আটকে আছে দলার মত।ঠিকমত কথা বলতে পারছে না।

-কী হলো ভিনা?

-কই,কিছু না তো।ঠিকি আছে বাবা,আমি অনেক ইম্যাচিউর ছিলাম।

-কে না থাকে বলো।এখন তুমি কত বুঝদার হয়ে গেছো!

ভিনা কিছু বললো না।ওভেন থেকে খাবার বের করে টেবিলে রেখে দিলো,এরপর নিজের রুমে চলে এলো।বিছানার কোণায় বসে বাইরে তাকিয়ে দেখলো সন্ধ্যা হয়ে আসছে।নিজেকে অনেক একা লাগছে।আপন মানুষ ও তাহলে অভিনয় শুরু করে দিয়েছে।নিজের বাবাকে অবিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।এত সহজে মুনার কথায় মন মানছে না।তবুও,একটা কিন্তু রয়ে যাচ্ছেই।

রাতের খাবারের জন্য সোহেল ভিনাকে ডাকতে আসলো।ভিনা তখন অন্যমনস্ক হয়ে জানালা বাইরে তাকিয়ে আছে।

-কী রে মা,মন খারাপ?

- না তো।

-মনে তো হচ্ছে মন খারাপ,পরীক্ষা খারাপ হয়েছে?

-না,এমনিই,মার কথা মনে পড়ছে।

-মন খারাপ করিস না,তোর মা সবসময় তোর সাথে আছে।

-আসলেও যদি এখন মা থাকত,কত ভালো হত,তাই না?

-মন খারাপ করিস না।আমি চিন্তা করছি তোকে নিয়ে বাইরে যাবো।

- শুধু আমাকে নিয়ে?

-মুনা আমি আর তুই,ফ্যামিলি ট্যুর দিলাম একটা।

-তুমি উনাকে নিয়েই যাও বাবা।

-উনাকে মানে?

-মানে....মা কে নিয়েই যাও ট্যুরে।

-মুনাকে তো নিবোই,বললাম তো ফ্যামিলি ট্যুর।

-বাবা আমি যাবো না।

-কেন?

-আমার পরীক্ষা সামনে।

-এটা বেশি হচ্ছে ভিনা।মাত্রই তো শেষ হলো পরীক্ষা,আবার কী?

-একবারে ইন্টারের পর নিয়ে যেও। এখন না।

-পড়াশোনা নিয়ে সিরিয়াস হয়েছো ভালো, কিন্তু এটাকে অজুহাত বানিয়ে তুমি আনসোশাল হয়ে যাচ্ছো।

-মোটেও না।তুমি যাও মুনাকে...মানে...মাকে নিয়ে।আমি মাঝখানে আসতে চাই না।

-কী বলছো এগুলা?আমার মেজাজ খারাপ হচ্ছে এখন।

-রাগ দেখাও বাবা,আমার সাথে অভিনয় করে লাভ নেই।

-আশ্চর্য ভিনা,কী হয়েছে।এত ঘুরিয়ে পেচিয়ে কথা বলছো কেন,হয়েছেটা কী?

-বললাম তো আমি যাবো না,আমাকে জোর করো না।

-থাকবে কোথায় তুমি?

-রুপিন আন্টির কাছে।

-হ্যাঁ, আছে তো ঐ এক রুপিন।ও তো তোমার জন্য বসে থাকবে না।দেশেই তো থাকে না। 

-না থাকলে না থাকবে।

হটাৎ মুনা এসে রুমে ঢুকলো।যদিও আগে থেকেই রুমের বাইরে আড়ি পেতে ছিলো।ভেতরে ভেতরে দোয়া করছিলো যেন ওর নাম না আসে।ভিনা আগে থেকেই চাপা স্বভাবের,আগে যাই সামান্য রাগারাগি করত,বিগত কয়েকমাস তেমন কিছুই করেনি।
ভিনার একটা বৈশিষ্ট্য হলো কষ্ট পেয়ে,অভিমান করে ভেতরে নিজেকে শেষ করে দিবে,তবু কিছুই খুলে বলবে না। এটা মুনার জন্য অনেক সুবিধা হয়ে গেছে,ভিনার এই স্বভাবের উপর ভিত্তি করেই এত কনফিডেন্টলি ও সোহেল আর ভিনার মাঝে দ্বন্দ্ব লাগাচ্ছে।

-কী হয়েছে বলো তো,ভিনার মুখ এরকম মলিন হয়ে আছে কেন?তুমি ওকে কিছু বলেছো সোহেল?

-এত করে বলছি,তাও যেতে চাচ্ছে না।

-তুমিই না বলো,ও বাচ্চা মেয়ে,বাচ্চাদের আরো নরমভাবে বুঝাতে হয়,এত রেগে বুঝালে হবে?

-ভালোভাবেই তো চেষ্টা করছি।

-নমুনা ভিনার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে।তুমি নিশ্চয়ই এমনভাবে বিষয়টা বলেছো যে আমরা হানিমুনে যাচ্ছি আর ভিনা এক্সট্রা পার্সন।

-আমি এভাবে কেন বলবো?

-তোমরা ছেলেরা ঠিকভাবে কথাই বলতে পারো না,একটা মেয়েকে কনভিন্স করতে পারো না।যাও রুম থেকে,আমি দেখি বিষয়টা। 

সোহেল রুমে চলে গেলো।মুনা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ভিনার পাশে বসলো।মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো-

-তোমার বাবার কথায় রাগ করো না ভিনা।তুমি যাবেই আমাদের সাথে,ঠিকাছে?

-না,আমি যাবো না।প্লিজ আমাকে ফোর্স করো না।

-মন বেশিই খারাপ তোমার। আমি পরে আসবো নে।তুমি কিন্তু খেয়ে নিও।

মুনা খুশিমনে রুম থেকে বের হয়ে গেলো।যেভাবে চেয়েছিলো,ঘটনার শুরু সেভাবেই হয়েছে।দেরী না করেই আবার নিজের রুমে গেলো মুনা।

-কিছু মনে করো না সোহেল,ভিনার সামনে আমি রুড হয়েছি তোমার সাথে। এছাড়া উপায় ছিলো না।এমনিও আমি চাচ্ছি ওর সাথে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে।

-কিছু হবে না।কিন্তু ভিনা এমন করছে কেন,কিছুই বুঝতে পারছি না।

-আসলে তোমাকে বলিনি আমি।আজকে বিকালে ভিনার সাথে কথা হচ্ছিলো ট্যুরের বিষয়ে,যখনি বললাম,তখনি দেখি একটু মুড অফ।

-কী বলেছিলে?

-আমি বলেছি তুমি ওকে ভ্যাকেশনে নিয়ে যেতে চাচ্ছো,পরে জিজ্ঞেস করলো আমিও যাবো কিনা।যখন বললান যে আমিও যাবো,তখনি বললো,তাহলে আর ভ্যাকেশন হলো কীভাবে,বলো যে হানিমুনে যাচ্ছো।এর জন্যই তো রুমে তোমাকে এভাবে কথাটা বলেছিলাম।

-ভিনা এরকম ছোট মনের কবের থেকে হলো?আজকে রেগেছি এর জন্যই।ও কম্পলেক্সে ভুগছে।শিউলি অনেক খোলামনের ছিলো,ওর মনে কোনো কূটিলতা ছিলো না।আমি চেয়েছিলাম আমার মেয়েটাও ওরকম হোক, কিন্তু ভিনা আমাকে নিরাশ করছে। 

-তুমি আপসেট হয়ো না তো।ভিনাকে নিয়ে আমি বাইরে বেরোবো নে।শিউলি যখন নেই,আমাকেই এগিয়ে এসে ওর পাশে দাঁড়াতে হবে।গাইডেন্স না পেলে হবে বলো।

-থ্যাংকিউ মুনা।

-আর ট্রিপটা ক্যান্সেল করে দাও।বিদেশ দেখা কপালে নেই হয়ত।ঘোরাঘুরির চেয়ে সংসার আগে।মা বাবার সাথে বের হয়নি কখনো,দায়িত্ব নিয়েই ছিলাম।এখন তাহলে দায়িত্ব পালনে কী সমস্যা?বুড়ো বয়সেই নাহয় ঘুরলাম।

সোহেল কিছুক্ষণ চুপ থাকলো।এরপর আলমারি খুলে কাপড় বের করতে করতে বললো,

-আমি ট্যুর ক্যান্সেল করবো না।যে যাওয়ার সে যাবে। 

-পরে গেলে কী হবে।

-ভিনার বুঝতে হবে যে, ওর ভাবনা সবসময় ঠিক না।ও এরকম সংকীর্ণ মনের হতে পারে না,আমি দিবো না।
 
মুনার ঠোঁটের এপাশ ওপাশ হাসি ছড়িয়ে গেলো।


জেরিন পাগলের মত এদিক ওদিক হাঁটাহাঁটি করছে।যাবিরকে দেখা মাত্রই ওর সামনে যেয়ে দাঁড়ালো।

-যাবির!আমার কথা শোনো।

-আমি তোমার গায়ে হাত তুলতে চাচ্ছি না জেরিন।

-আম এক্সট্রিম স্যরি!

-নিজের কাছে ক্ষমা চাও জেরিন।উপলব্ধি করো কী করেছো। আমার কথা বাদ দাও।নিজেকে নিজে ক্ষমা করতে পারবে?নিজেকে যে এত ছোট করেছো?

-আমার ভুল হয়ে গেছে।প্লিজ!

-শাটাপ!চড় মেরে দাঁত ফেলে দিবো।সড়ো সামনে থেকে,নাহলে তোমার কাছে আমি রেখেঢেকে কিছুই বলবো না,যা করেছো এক্সাক্টলি তাই বলবো।

-কথা দিচ্ছি,আর তোমাকে বিরক্ত করবো না।না তোমাকে না ভিনাকে।

-ঠিকাছে,যাও এখন।

-আমার মোবাইলে টাকা নেই,বাসায় ফোন দিবো,ফোন টা দেয়া যাবে?

-আবার কোনো কিছুর প্ল্যান করছো?

-এতটা অবিশ্বাস করো না যাবির।ভিনাকে তো আগেই ফোন দিয়েছি,আর কাকে কী বলবো।

যাবির কিছুক্ষণ ভেবে ফোন দিলো জেরিনকে।
জেরিন ভুলভাল নাম্বার ডায়াল করলো,এবং খুব সাবধানে যাবিরের মার নাম্বার মুখস্ত করে নিলো।
.
.
.
চলবে..............................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন