— উড়তে দাও । মনে রেখো পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে।
— তোমার ভাই এর যে কৈ মাছের প্রাণ।
— হুম । পুটি মাছের প্রাণ হতে কতক্ষণ? ।
.
.
অভ্র এখন পুরোদস্তুর বিজনেস ম্যান হয়ে গেছে । সারাদিন কাজ কাজ আর কাজ। সেই সকাল সাড়ে আটটায় বেরোয় ফিরতে ফিরতেও রাত সাতটা আটটা।
.
অবন্তিকে সারাদিন একা একাই থাকতে হয় । একদম ভালো লাগে না এভাবে। যদিও বাবা, রেণু খালা বাড়িতেই থাকে। তবুও আসল মানুষটাই তো থাকে না । আগে সারাদিন জ্বালাতন করত, নজরে নজরে রাখত গোয়েন্দার মতো, আজগুবি আজগুবি গল্প করত, দুপুর হলেই লুডো খেলা, অহেতুক ঝগড়া সাথে অভ্র'র অগোছালো পাগলামো...সেসব দিন ই যেন ভালো ছিল।
.
সেদিন অফিস যাবার পর পার্সেল এসেছিল । অভ্র ই পাঠিয়েছিল। পার্সেলে ফোন,ল্যাপটপ আর একটা বক্সে একগাদা কৃষ্ণচূড়া আর অপরাজিতা ফুল ।
.
বুঝতে বাকি ছিল না অভ্র'র ই কাজ এটা। তার মনে অভ্রও তাকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে । আগে নিজে সারাদিন বাড়ি থাকত তবুও ফোন টাচ করলেও কেমন গোয়েন্দার মতো ধরে ফেলত। শুভ্র'র সাথে কথা বলাও পছন্দ করত না । আর সেই মানুষ এখন পাহারা দেবার জন্য বাড়ি থাকতে পারে না তবুও এসব গিফট। অবন্তী বুঝতে পারে ওর এসব বিশ্বাস এর মর্যাদা রাখা উচিত।
.
দিনে দু এক বার অভ্রই ফোন দিয়ে খোজ খবর নেয়। ফাকা সময় পেলে টুকিটাকি গল্প ও করে।
.
অবন্তী ও আবার ক্লাসে যাওয়া শুরু করেছে । অনেক গ্যাপ পড়ে গেছে যদিও পড়াশোনার। সামনে মাসে সেমিস্টার ফাইনাল । সে যে আহামরি কোন ভালো স্টুডেন্ট তাও নয় । বরাবর ই মধ্যম মানের। মধ্যম মানের স্টুডেন্ট দের সমস্যার শেষ নেই। খুব পড়াশোনা করে ভালো রেজাল্ট করার ধৈর্য ও তাদের হয় না । আবার একেবারে না পড়ে ফেল করার মতো অপমান ও তারা নিতে চায় না । খারাপ মানের স্টুডেন্টদের এ বিষয়ে টেনশন নেই। তারা জানেই রেজাল্ট খারাপ হবে । আবার ভালোরাও জানেই তাদের রেজাল্ট ভালো হবেই। যত সমস্যা এই মধ্যবিত্ত মগজের স্টুডেন্ট দের। অবন্তী ও এই সারির ই একজন।
এত এত পড়া কভার করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে মেয়েটার এ ক দিনে।
.
রাতে অভ্র ফাইলের গাদা নিয়ে বসে, অবন্তী পাশে বই এর গাদা নিয়ে বসে । মেয়েটা এত জোরে জোরে আর বাচ্চাদের মতো মাথা ঝুকে ঝুকে পড়ে অভ্র নিজের কাজ বাদ দিয়ে হা করে তাকিয়ে থাকে। মনে হয় ক্লাস টু এর বাচ্চা তার মাকে পড়া দিচ্ছে ,সেই পড়ার শব্দে ঘরের ছাদ বুঝি এখনই ভেঙে অভ্রর মাথার ওপর পড়ে ।
.
"জোরে জোরে পড়লে নাকি সে তার পড়া তাড়াতাড়ি কমপ্লিট করতে পারে। এত শত পড়া গ্যাপ পড়েছে আস্তে পড়লে নাকি কভার হবে না এ কদিনে ।" এসব আজগুবি যুক্তি শুনে অভ্র'র হাসা উচিত নাকি কাদা উচিত সে বুঝতে পারে না । কানের ভেতর তুলো গুজে কোন দিন ঘুমিয়ে পড়ে অথবা কোন দিন ফাইলে মনোযোগ দেয়। অথবা হেডফোন বা ইয়ারফোনে ফুল ভলিউমে গান প্লে করে শুয়ে শুয়ে অবন্তীর দিকে অপলক ভাবে চেয়ে রয় । অবন্তীর এসব বাচ্চাপনা দেখতে।
.
কিন্তু ক'দিন ধরে সন্ধ্যার পর পরই অবন্তী প্রতিদিন পার্সেল পায় একটা করে। পার্সেলে যদিও নাম লেখা থাকে না। তবুও অবন্তী বুঝে নেয় অভ্রই পাঠিয়েছে। প্রতিদিন ওর প্রিয় কিছু না কিছু পাঠাবেই । কিন্তু অভ্র বাড়ি আসার পর এ বিষয়ে কোন কথাই বলে না কেন? ফোনেও এক বার ও জিজ্ঞেস করে না পার্সেল পেয়েছে কি না । প্রথম দিন থ্যাংক ইউ বলার পর উল্টে আরো জানতে চাইল কেন থ্যাংক ইউ দিচ্ছে সে। অবন্তী ও রেগে গিয়ে আর ভেঙে দেয় নি ব্যাপার টা ।ও ভেবেছিল নিশ্চই ভাব নিচ্ছে জবাব। ।
.
.
কিন্তু আজকের পার্সেল টা ...
.
এত্ত এত্ত ঝিনুকের গহনা।
.
তার সাথে ছোট্ট চিরকুটে কবিতা লেখা,
.
.
“আজ বিষাদ ছুঁয়েছে বুক, বিষাদ ছুঁয়েছে বুক
মন ভালো নেই, মন ভালো নেই;
তোমার আসার কথা ছিলো, তোমার যাওয়ার
কথা ছিলো -
আসা-যাওয়ার পথের ধারে
ফুল ফোটানোর কথা ছিলো
সেসব কিছুই হলো না, কিছুই হলো না;
আমার ভেতরে শুধু এক কোটি বছর ধরে অশ্রুপাত
শুধু হাহাকার
শুধু শূন্যতা, শূন্যতা”
.
.
হাতের লেখা চিনতে ভুল হয় না অবন্তীর। এ লেখা সেই হাতের লেখাই। তারমানে এত দিন....
এখন সব কিছু স্পষ্ট হয়ে ওঠে তার কাছে । কেন অভ্র কিছুই বোঝে নি সেদিন এর "থ্যাংক ইউ' এর মানে। আর কেন এ বিষয়ে কিছুই বলে না । এগুলো তো এতদিন ধরে অভ্র পাঠায় ই নি। পাঠিয়েছে শুভ্র।
.
প্রথম দিনই অভ্রকে জানানো উচিত ছিল। বেশি ভাব নিতে গিয়ে ...
.
.
এ কদিনের পাঠানো সব গুলো গিফট অবন্তী বিছানায় ছড়িয়ে মেলাতে থাকে। আর ভাবতে থাকে সত্যি তো এগুলো যে ওর পছন্দ শুভ্র তা ভাল মতো ই জানত। অভ্র দু একটা জানত। ফোন ,ল্যাপটপ, কৃষ্ণচূড়া আর অপরাজিতা এগুলোই শুধু অভ্র দিয়েছিল। কিন্তু সেদিন অভ্র নাম ছাড়া পাঠিয়েছিল ।তাই অবন্তী ভেবে এসেছিল এগুলো ও হয়ত। কিন্তু অভ্র তো ফোন পাঠানোর সথেই ফোন করেছিল।খুব বড় ভুল হয়ে গেছে । এটা ওর ভেবে দেখা উচিত ছিল অভ্র এগুলো পাঠালে অবশ্যই একবার হলেও বলত।কিংবা আবভাবেও বোঝ যেত।
.
.
অবন্তী কবিতার লাইন গুলো আবার পড়ে । বারবার পড়ে ।
.
"সত্যি কি ভুল হচ্ছে?
.
শুভ্র'র প্রতি অন্যায় হচ্ছে? সময়ের নাকি সম্পর্কের কোনটার দাম বেশি দেয়া উচিত? সময়ের দিক দিয়ে শুভ্র এগিয়ে সম্পর্কের দিক দিয়ে অভ্র। এখন অভ্র কে ছেড়ে গেলে ওর প্রতি কি অন্যায় হবে না? অভ্র যে তাকে তার পুরো পৃথিবী ভেবে ফেলেছে। শুভ্র সে ও তো তাই ভাবে । কিন্তু আমার নিজের ও তো ইচ্ছে অনিচ্ছে মন বলে কিছু আছে ।"
.
.
অবন্তী এসবের কোন সমাধান পায় না এত কিছু ভাবার পরেও।। চিঠি হাতে নিয়ে ঠায় বসে থাকে সে। আবার ভাবে,আবার। কি করা উচিত? কোন দিক বেছে নেয়া উচিত? নিজের মনের দাম দেয়া উচিত? নাকি শুভ্র'র, নাকি অভ্র'র?
.
শুভ্র'র সাথে কথা বলে এর শেষ করা উচিত। আর তাছাড়া অনেক কিছু জানার আছে তার কাছে । সেদিন শুভ্র আরো কি কি বলতে চেয়েছিল । " দুজনই " কথাটার মানে? দুজনই ভালোবাসবে? আর তাছাড়া যে কোন পরিস্থিতে নিজেকে স্থির রাখতে বলেছিল। কি হতে পারে সে পরিস্থিতি? হয়ত অভ্র'র সাথে বিয়ের এ পরিস্থিতি কেই ইঙ্গিত করেছিল। অভ্র'র সাথে স্থির থাকতে বলেছিল? নাকি?
.
.
ও যার সাথে স্থির থাকতে বলে বলুক। মন যার সাথে স্থির হতে চাইবে সেই হবে স্থায়ী, স্থির।
.
.
এসব ভাবতে ভাবতে অভ্র'র যে ফেরার সময় হয়ে গেছে তা খেয়াল ই নেই অবন্তীর। এক হাতে চিরকুট অন্য হাতে ফোন নিয়ে শুভ্রকেই ফোন করতে যাচ্ছিল সে।
.
.
এরই মাঝে অভ্র'র গলার আওয়াজ পেয়ে হকচকিয়ে ওঠে অবন্তী।
.
.
অভ্র রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলতে থাকে,
— অবন্তী কাল তুমি সন্ধ্যে ছ'টার মধ্যে তৈরি হয়ে থাকবে। বিজনেস পার্টি আছে। আমাদের দুজনের ই ইনভিটিশন আছে। ডিল ও আছে একটা ইমপরট্যান্ট ।
— হুম????
— কি ব্যাপার আমি রুমে ঢুকতেই এমন হকচকিয়ে উঠলে কেন? কি এমন বলেছি আমি? সামান্য একটা পার্টির কথা বলেছি।
— হ্যা। আসলে ...
— বিছানায় এসব কি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছ? এই সরাও তো এসব। টায়ার্ড লাগছে শোব একটু।আজ সারাদিন খুব চাপে ছিলাম।
— হুমম
— ফেরার পর থেকে কি হ্যা হু হুম করে যাচ্ছ? এই কি হয়েছে বলো তো তোমার? হাতে কি নিয়ে ধ্যান ধরে বসে আছ দেখি?
— না মানে
.
.
অভ্র হাত থেকে চিরকুট নিয়ে মনোযোগ দিয়ে কয়েকবার পড়ে আর অবন্তীর দিকে বারবার তাকায় । অবন্তী ঢোক গেলে কয়েকবার। ঘেমেও গেছে কিছুটা । মেয়েটা বুঝতেই পারছে এখন কি হতে চলেছে ।
.
.
— কি এসব? কে দিয়েছে এটা?
— শু শুভ্র
.
— ফুল ফোটানোর কথা ছিল? আসা যাওয়ার কথা ছিল? আমার ব্যাস্ততার সুযোগ নিয়ে এসব চলছে তাহলে? তাইত বলি কিছু দিন হলো শুভ্র শুভ্র কেন করো না আর। আমি বোকা এতদিন ভেবে এসেছিলাম হয়ত ভুলে গেছো ওকে।এখন তো দেখছি তলে তলে চলছে সব কিছু । দু নৌকায় পা দিতে ভালই লাগছে।
.
— আপনি যেরকম ভাবছেন সেরকম না বিষয় টা ।
— কি রকম তাহলে? আর কাকে ফোন করছিলে দেখি?
— শুভ্রকে।
— বাহ। এত্ত এত্ত গিফট দেয়া নেয়াও চলছে তাহলে? আমার বেড থেকে এক্ষুনি এসব সরাবে তুমি।
— আমি তো ভেবেছিলাম এসব আপনি পাঠিয়েছেন।
— আবার মিথ্যা আবার?
— কোন মিথ্যা বলি নি আমি।
.
— না না । ঠিক ই আছে। আমার বিশ্বাসের এই প্রতিদান পেলাম তো । বাহ। চালিয়ে যাও। এজন্যই আমাকে অফিস পাঠানোর এত তাড়া । ভার্সিটি যাস না অন্য কোথাও যাস? নাগর ফিরে এসেছে তাই না?
.
— বাজে কথা বলবেন না । চুপ করুন। ভাষা ঠিক করুন। রাস্তার ছেলেদের মতো ভাষা হয়ে গেছে দেখি আপনার।
.
— এত দিনের এত চেষ্টার পরও এটাই আমার প্রাপ্য ছিল । এই ওর ভেতর কি আছে যেটা আমার ভেতর নেই? কি দেয় ও তোকে? আমিও দেবো ।
.
এসব শুনে অবন্তীর ভেতর ও জেদ নামের কিছু চেপে বসে । জেদ জিনিস টা সত্যিই বড় ভয়ানক।
.
— এই যে আপনি এতটা অসভ্য আর ও সভ্য। এটাই পার্থক্য। এসব যদি করেও থাকি আপনি এত রিয়াক্ট করছেন কেন? নিজেই ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করেন নি আমার আর শুভ্র'র মাঝে? কথা দেন নি কোন একদিন? কি কথা দিয়েছিলেন মনে আছে??নাকি মনে করিয়ে দেবো?
.
— মনে আছে। আবার মনে করিয়ে দেবার জন্য ধন্যবাদ । তাহলে কি চাইছ তুমি?
.
—আপনি যা দিতে চেয়েছিলেন
.
.
.
চলবে...........................