— এই যে আপনি এতটা অসভ্য আর ও সভ্য। এটাই পার্থক্য। এসব যদি করেও থাকি আপনি এত রিয়াক্ট করছেন কেন? নিজেই ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করেন নি আমার আর শুভ্র'র মাঝে? কথা দেন নি কোন একদিন? কি কথা দিয়েছিলেন মনে আছে??নাকি মনে করিয়ে দেবো?
— মনে আছে। আবার মনে করিয়ে দেবার জন্য ধন্যবাদ । তাহলে কি চাইছ তুমি?
.
—আপনি যা দিতে চেয়েছিলেন।
.
অভ্র গজ গজ করে গিয়ে আলমারি খুলে ডিভোর্স পেপার বের করে অবন্তীর দিকে ছুড়ে মারে ।
.
— এটাই চাই তো তোর? নেহ। আগে তুই সিগ্নেচার করবি ? নাকি আমি?
.
অবন্তী এতটাও আশা করে নি। কোত্থেকে কি হচ্ছে এটা? অভ্র ডিভোর্স পেপার ও রেডি করে রেখেছে? অবন্তী ভেবেছিল হয়ত কেদেকেটে আবার সরি বলবে। আবার মানানোর চেষ্টা করবে তাকে। কিন্তু...এসব ভেবে অভ্র'র ওপর আরো বেশি করে রাগ হতে থাকে তার।
.
— বাহ ডিভোর্স পেপার ও রেডি করে রেখেছেন দেখছি।
.
— হুম । সুবিধাটা কার হলো তোর তো? নে নে সাইন কর। আমাকে ডিভোর্স দেয়ার পর তিন মাস তো আবার ওয়েট করতে হবে তাই না? ইদ্দতের তিন মাস । যত তাড়াতাড়ি ডিভোর্স দিবি ততই ভালো । তিনমাস তত তাড়াতাড়ি কাটবে। আচ্ছা তোর সাথে তো আমার ফিজিক্যাল কিছু ছিল না ।তাও তিন মাস ইদ্দত মানবি? নাকি আজ ডিভোর্স কাল ই আবার বিয়ে করবি?
.
— আমার সাথে ভদ্র ভাবে কথা বলবেন অভ্রনীল। আপনি আপনার লিমিট ক্রস করে যাচ্ছেন।
.
— আমি ভদ্র হতেই চেয়েছিলাম।
.
.
রাতে দুজনের এক জনও খাবার খেল না । অভ্র ঝিম মেরে বসে আছে মেঝেতে খাটের এক কোণের সাথে হেলান দিয়ে । অবন্তী রাগে শুধু গজ গজ করছে ওর দিকে তাকিয়ে ।
.
"এতটা অসভ্য বিহেভ করতে পারল। এতটা অসভ্য কথা । ওর কি উচিত ছিল না পুরো ব্যাপার টা জানার চেষ্টা করা । না জেনেই.. এই চেনা চিনল আমাকে এতদিন? আমি কেন যেচে যেচে ভুল ভাঙাবো? ভুল তো ভাঙাতে চেয়েই ছিলাম। বিশ্বাস করল কি? করল না তো । দুটোই এক ধাচের। এক বার এর জন্য ও ভুল বুঝছে আরেক বার ওর জন্য এ ভুল বুঝছে । আমি কি ভুল ভাঙানোর মেশিন নাকি? কি সহজে ডিভর্স পেপার ছুড়ে দিল !"
মনে মনে অবন্তী এসবই আওড়াতে থাকে।
.
.
অভ্র নিজেও ঝিম মেরে বসে থেকে ভাবতে থাকে হুট করে মাথা এতটা গরম করা হয়ত ঠিক হয় নি। কি করার শুভ্র নাম শুনলেই মাথা বিগড়ে যায় যে । এখন এক বার সাইন করে দিলে সব শেষ । নিজের ভাগ্য আল্লাহর হাতে ছেড়ে দেয় সে। সে বিশ্বাস করে, সে তার চেষ্টার দিক থেকে কোন ত্রুটি রাখে নি।
.
.
সকাল বেলা অভ্র অফিস চলে যাবার পর অবন্তী নিজেই শুভ্রকে ফোন করল,
.
— জ্বি, আসসালামু আলাইকুম।
— আমার লাইফে অশান্তি ডেকে এনে সালাম দেয়া হচ্ছে?
— ওহ পিচ্চি তুমি? একেক বার একেক কন্টাক্ট নং দিয়ে ফোন করলে আমি কিভাবে বুঝব? তা তোমার হাজব্যান্ড কোথায়?
— যেখানে থাকার কথা সেখানেই আছে। তুমি কোথায়?
— আমি কোয়ার্টারেই আছি কিছুদিন। তারপর বলো গিফট গুলো পছন্দ হয়েছে?
— না একদম না ।
— মিথ্যে কথা । কবিতা শুনবে?
— না । শুভ্র তুমি কি চাইছ বলো তো?
— তোমাকে।
— আমার বিয়ে হয়ে গেছে শুভ্র।যে কারণেই হোক আর যে ভাবেই হোক। তুমি বড্ড বেশি দেরি করে ফেলেছ শুভ্র।
— আমি আমার দেয়া সময় এ ঠিক ই আছি। তুমি বড্ড বেশি তাড়াহুড়া করে ফেলেছ অবন্তী।
— শুভ্র আমি কিন্তু সেদিন তোমার আশায় ই তোমাকে ফোন করেছিলাম। তুমি আমার কোন কথা শুনলে না । মানছি অভ্র একটা ভুল করে ফেলেছিল । কিন্তু তোমার কি উচিত ছিল না আমার পুরো কথা শোনা?
— কি ভুল করেছিল অভ্র?
— অভ্র করেছিল সেদিনের ভুল বোঝাবুঝি আমাদের মধ্যে । আমি ইচ্ছে করে এ বিয়ে করিনি। আমি এখনো জানি না এ বিয়ে কেন হয়েছে । কিন্তু আন্দাজ করতে পারি।
— কেন হয়েছে? শুনি?
— অভ্র অসুস্থ ছিল। হয়ত ওকে সুস্থ করতে ,কোন একজন প্রয়োজন ছিল সব সময় ওর পাশে থাকতে।
.
এভাবে অবন্তী পুরোটা বুঝিয়ে বলে শুভ্রকে। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত । শুভ্র পুরোটা মনোযোগ দিয়ে শোনে। পুরো ব্যাপার টা বুঝে নেয়। অভ্র'র খুত গুলোও খুজে নিতে ভুল করে না সে।
.
.
— তো? এখন কি চাও? কাকে চাও?
— জানিনা
— তোমার কি একবারের জন্যও মনে হচ্ছে না তুমি আমার প্রতি অন্যায় করছ?
— আর তোমার কাছে ফিরলে অভ্র'র প্রতি অন্যায় হবে না?
— কি অন্যায় হবে শুনি? ও বড়লোকের ছেলে । টাকা দিয়ে কিনেছে তোমাকে জাস্ট ইউজ করার জন্য । তোমার মতো একটা অবন্তী গেলে ও আরো দশটা অবন্তী পাবে এক তুড়িতেই। ও তোমাকে একটুও ভালোবাসে না । একটু ও না । ওর ফ্যামিলি তোমাকে জাস্ট ওর খেলনা হিসেবে কিনে দিয়েছে। দেখোনা, এখন ঠিক মতো চাহিদা মেটাতে পারছ না বলে চট করে ডিভোর্স পেপার বের করে দিয়েছে। ওর এখন তোমাকে ছেড়ে অন্য কাউকে চাই! ওর সাথে সময় কাটানোর একজন হলেই হলো ।
.
— শুভ্র !
.
— হুম ঠিকই বলছি আমি। কত দিন দাসী হয়ে থাকবে তুমি ওর? যেখানে আমি তোমাকে আমার রাজ্যের রাজরানি করার জন্য আশায় আশায় দিন গুনছি সেই কবে থেকে? একটা পাগলের নার্স হবার জন্য তোমার বাবা মা তোমাকে এত বড় করেছে? তাও আবার মার্ডার কেসের আসামি। আমি তো নিশ্চিত ওর মাকে ওই মেরেছে। একটা পাগল খুনির সাথে সংসার করবে? তাও যদি সে তোমাকে ভালবাসত! পুরো ইউজ করছে তোমাকে ওরা সবাই মিলে ।
.
.
অবন্তী কোন উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দেয়।
তার মাথায় এখন আজকের বলা শুভ্র'র কথাগুলো ঘূর্ণিপাকের মতো ঘুরতে থাকে ।
.
.
সন্ধ্যায় পার্টি আছে বলে অভ্র আজ তাড়াতাড়ি ফিরেছে। এসেই অবন্তী কে তৈরি হয়ে নিতে বলল ঠান্ডা গলায়। বাবা সব দায়িত্ব দেয়ার পর এটাই সব চেয়ে বড় ডিল সাইন হবে । প্রজেক্ট টা পেলে জীবনে প্রথম বাবার গর্বের কারণ হয়ে উঠতে পারবে অভ্র। সারাজীবন বাবাকে তার জন্য কোন না কোন কারণে হেনস্তা হতে হয়েছে। আজ আর সে সুযোগ দেবে না সে।
.
অবন্তী উপায় না পেয়ে রাজি হলো যেতে। নিজেদের ভেতরের ব্যাপার নিজেদের ভেতর ই থাকুক ।
.
অভ্র ততক্ষণে তৈরি হয়ে গেছে । অবন্তী আয়নায় দাড়িয়ে অর্নামেন্টস গুলো পড়তে পড়তে অভ্র কে শান্ত ভাবে জিজ্ঞেস করল,
.
— ডিভোর্স পেপার কবে রেডি করে রেখেছিলেন?
.
অভ্র সোফায় বসে মাথা নিচু করে হাতে অনামিকা আঙুলের আংটি ঘোরাতে ঘোরাতে বলতে থাকে,
.
— অনেক আগেই রেখেছি। আমি মে বি তোমাকে তখন বলেও ছিলাম যে আমি ল'য়ারের সাথে কথা বলেছিলাম। তখন উনি পেপার রেডি করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তখন তুমিই ছুতো খুজেছিলে আমায় না ছাড়ার । আমিও ভেবে নিয়েছিলাম তুমি হয়ত আমাকেই চাও এখন। হয়ত ছেড়ে যেতে চাও না আমায়। হয়ত আমাদের সম্পর্কটার দাম তুমি মনে মনে দিতে শুরু করেছ। পেপার টা ছিড়েও ফেলতে চেয়েছিলাম ।কি যেন মনে করে রেখেও দিয়েছিলাম পরে । কিন্তু এটা যে এতদিন পরে কাজে আসবে ভাবতেও পারিনি ।। ...আজ নিজেই যখন চাইছ...আমার তো আর কিছু করার নেই তাই না? কথা দিয়েছি বলে কথা !!!!
.
— কথা দিয়েছেন বলে সে কথা রাখতে চাইছেন নাকি অন্য কোন কারণে? কই আগে তো কথা রাখার এত তাগিদ ছিল না ।
.
— মানে কি?? কি বলতে চাইছ তুমি?
— বোঝেন না কি বলতে চাইছি?
— নাহ।
— নতুন বৌ পেতে সব পুরুষের ই শখ জাগে। আমি গেলেই তো আরেকজন রেডি হয়ে আছে। সে আসবে তাই না?
— এনাফ ইজ এনাফ। কে আসবে? আর আমি তোমার মতো ক্যারেক্টারলেস না।
.
কথাটা বলেই অবনীর ব্যাপারটা মাথায় আসে অভ্র'র
.
— ও হ্যা... যদি আসেও বিয়ে করেই নিয়ে আসব। তোমার মতো পরকীয়া করব না ।
—আপনি এটা বলতে পারলেন?
— তুমি করতে পারলে আমি বলতে কেন পারব না?আর তুমি আমাকে ছেড়ে শুভ্র কে বিয়ে করতে পারলে আমি কেন তোমাকে ছেড়ে অবনী কে বিয়ে করতে পারব না?
— বাহ।। ঠিক ই বলেছেন। অবনীর ব্যাপার তাহলে আপনিও জানেন। আমি তো ভেবেছিলাম আপনি বুঝি জানেন না, রেণু খালা আর বাবা মিলে আপনাকে আবার বিয়ে দিতে চাইছে।
— কেন জানব না? আমার ফ্যামিলি আমার ব্যাপারে ভাবছে আর আমি জানব না?
— ওহ তাহলে তো সুবিধে ই হলো। আমি যত তাড়াতাড়ি চলে যাব ততই ভালো আপনার জন্য । বিয়ে করার জন্য তো আপনার ও তর সইছে না দেখছি।
— আমার মনে হয় আমাদের এখন বেরোনো উচিত । প্লিজ আমার না হোক বাবার মান টা রাখো।
.
.
" আমার চলার পথ গেছে কত দূর
জানা নেই তবু প্রাণে আছে সুর
ভালো বা মন্দ কিছু না জেনে
নিয়তি আমি নিয়েছি মেনে
.
উল্টে পাল্টে দেখি একটাই আকাশ
চুলে মাখি এলোমেলো একি সে বাতাস
একই রকম বুকে একই দীর্ঘশ্বাস
পৃথিবীর কাছে এর কতটুক দাম?
.
এই রৌদ্র ছায়া রাত জোছনা ছুয়ে দিলাম
এই ভালো লাগা ঘুম বাহানায় কি পেলাম?
দুজনে একই পথে হেটে অবিরাম
ঠিকানার ধারে কাছে ঠিকানা হারালাম"
.
.
অভ্র যেতে যেতে পুরো রাস্তা এই একটা গানই প্লে করেছে।
.
সারা রাস্তা কথা না বললেও,পার্টি তে দুজনই বেশ হাসিখুশি ভাব দেখিয়ে চ্ছে
চলছে। সবার সাথে কথাবার্তা বলছে। যে কেউ দেখে বলবে বেস্ট কাপল এরা।
.
নিউ কাপল হিসেবে অন্যান্য নিউ কাপলদের সাথে ডান্স ও করতে হলো হাসিমুখে । অভ্র অবন্তীর চোখে চোখ রেখে গানের সাথে দুটো লাইন ই শুধু মিলিয়েছে,
" যাব কোয়ি বাত বিগাড় যায়ে,
যাব কোয়ি মুস্কিল পাড় যায়ে
তুম দেনা সাথ মেরা ও হামসাফার
না কোয়ি হ্যায় না কোয়ি থা
জিন্দেগি মে তুমহারে সিভা
তুম দেনা সাথ মেরা ও হামনাভা"
.
.
প্রজেক্ট পাবার পর স্পিচ দিতে গিয়ে, অভ্র সৃষ্টিকর্তাকে , তারপর তার প্রতি এতটা আস্থা রেখে সব দায়িত্ব দেবার জন্য বাবা কে ধন্যবাদ দেবার পর , তার সহধর্মীনীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনে ভোলে নি । সে জানায় এমন একজন সাপর্টিভ সহধর্মিণী পেয়েছে বলেই হয়ত এত কম সময়ে এতটা প্রাপ্তি। নিজের অগোছালো জীবন থেকে এতটা গুছিয়ে ওঠা।
.
.
আজমির চৌধুরীর আজ ছেলের জন্য জীবনে প্রথম বারের মতো গর্ব হচ্ছে । উনিও উপস্থিত আছেন পার্টি তে । ছেলে বৌমার গাড়িতে আসেন নি। আলাদা ভাবেই এসেছেন নিজ গাড়িতে । ছেলে বৌ মাকেও স্পেস দেয়া দরকার । এক সময় তিনি ভেবেই নিয়েছিলেন এ ছেলেকে দিয়ে হয়ত আর কিছু সম্ভব না । কিন্তু আজ সত্যি গর্ব হচ্ছে ছেলের জন্য । রিসিপশনের দিন অভ্র'র ওসব পাগলামো দেখে যারা আড়ালে হেসেছিল , অভ্র কে পাগল বলেছিল, যারা বলেছিল এত কম বয়সে ছেলেকে বিয়ে দিয়েছে এখন শুধু বৌ নিয়েই পড়ে থাকবে , ব্যাবসা লাটে তুলবে, কয়েক বছর ব্যাবসায় বসিয়ে তারপর বিয়ে দেয়া উচিত ছিল, তাদের অনেকেই আজ এ পার্টি তে আছে । অভ্র তাদের অনেকেরই আজ ঈর্ষার বস্তু। বাবা হিসেবে এই পাওয়াটা অনেক । ছেলে নিজেই নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছে। অবন্তী না থাকলে যে এসব কিছুই হয়ত সম্ভব হতো না সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত । অভ্র'র জন্য তার বৌ মা অবন্তী ই পারফেক্ট।
.
স্পিচ শুনে সবাই যখন অবন্তীর দিকে বার বার তাকাচ্ছিল আর হাত তালি দিচ্ছিল অবন্তীর মনেও কোথাও একটা নিজের স্বামীর জন্য গর্ববোধ হয় । পাশে দাড়িয়ে সাবলীল ভাবে হাসিমুখে স্পিচ দেয়া মানুষটার দিকে অবাক চোখে বার বার তাকায় সে। নিজেও হাত তালি দিতে থাকে ।
.
.
অভ্র'র দিকে বার বার তাকাতে তাকাতে আর সামনের মানুষগুলোর দিকে তাকাতে দূরে হঠাত চোখ পড়ে অবন্তীর।
মাঠে অন্ধকারের ভেতর একদম কোনায় একটা চেয়ারে বসে আছে কেউ একজন। মুখ অন্ধকারে ক্যাপের আড়ালে ঢেকে থাকলেও পাঞ্জাবি মোটামুটি দেখা ই যাচ্ছে। সেই সাদা সুতোয় কাজ করা লাল পাঞ্জাবি।
.
এখানেও পিছু ছাড়ে নি শুভ্র ! অভ্র যদি বুঝতে পারে ওটা শুভ্র, কি হবে এই পার্টির পরিস্থিতি তা অবন্তী বেশ ভালো ভাবেই বুঝতে পারছে ।
.
.
.
চলবে.....................