অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ৪২ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


ভিনা জামা কাপড় বের করে রেডি হচ্ছে।প্রচন্ড রাগ লাগছে,তবুও নিজেকে কোনোমতে নিয়ন্ত্রণ করে রেখেছে।সকালে মুনা এসে জানিয়েছে ভিনাকে নিয়ে শপিং এ যাবে।এর স্পষ্ট অর্থ হচ্ছে সোহেল ট্যুর ক্যান্সেল করেনি, এবং তারা ভিনাকে রেখেই যাচ্ছে।খুব কষ্টে ক্ষোভ আর কান্না চেপে রেখে ভিনা সব কাজ করছে।যেই ভয়টা মনে চেপে বসে ছিলো,সেই ভয়টা ধীরে ধীরে বাস্তবে রূপ নিচ্ছে।চোখের সামনে এসব দেখে,আগের দিনগুলোর কথা মনে পড়লো ভিনার।একদম শুরুর দিনগুলো,যখন মুনা এবাসায় নতুন এসেছিলো।তখন বাবার সাথে অভিমান থাকলেও,সেটা ছিলো তার মাকে নিয়ে,যে শিউলির জায়গা কেউ নিয়ে নিচ্ছে।এখন ব্যপারটা আরো বেশি কষ্টকর হয়ে উঠেছে,কারণ ভিনা টের পাচ্ছে,ওর জায়গাটা কেউ খুব যত্নের সাথে মুছে দিচ্ছে।সারারাত কান্না করার জন্য চোখ ফুলে আছে,মাথাও প্রচন্ড ব্যথা।এ অবস্থায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাইরে যাচ্ছে একটাই কারণে,সেটা হলো যেন নতুন কোনো ইস্যু না হয়।নিজের ভয়টাকে চোখের সামনে বাস্তব হতে দিতে পারে না ভিনা। আজকে মুনা সোহেলের সামনেই শপিং এ যাওয়ার কথা তুলেছে,বলা বাহুল্য,খুব নম্রতার সাথেই কথাটা বলেছে। যদিও ভিনার সেটা নিতান্তই অপ্রোয়জনীয় আহ্লাদ মনে হয়েছে,কিন্তু কিছু বলেনি। যদি বলত,তাহলে হয়ত সোহেলের মনে হত ভিনা মুনার জন্যই এসব করছে,যেখানে ওর অভিমান অন্য জায়গায়।

-ভিনা,রেডি তুমি?

-এইত,চুল বেঁধে নামছি আমি।

-আমি ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলি তাহলে।

-ঠিক আছে।

ভিনা ক্লাস ফাইভে থাকতে প্রথম গাড়ি কেনা হয়েছিলো।স্কুলে একটু দূরে হওয়ায় গাড়িতে যেত।এছাড়া গাড়ি খুব একটা ব্যবহার করত না।ভিনার মা শিউলি,গাড়িতে চড়া একটুও পছন্দ করতেন না।রিকশায় খোলা হুডে তার ভালো লাগত।ক্লাস সেভেনে থাকতে দ্বিতীয় গাড়ি কেনা হয়েছিলো।বাড়িতে দুইটা গাড়ি থাকলেও,ভিনা কখনো সেটা নিয়ে আলাদা শো অফ করেনি।কিন্তু মুনা যেখানেই যাবে,গাড়ি নিয়েই যাবে।বিয়ের পর খুব সম্ভবত একবারই গাড়ি ছাড়া বাইরে গিয়েছিলো সে,যেদিন তার বাবা মারা গেছে।
এখন গাড়ি ছাড়া চলতেই পারে না।ভিনা এসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললো।এসব চিন্তা মানুষের মনকে ক্রমেই সংকীর্ণ করে ফেলে,যার ফলে সুস্থভাবে চিন্তা করার ক্ষমতাই থাকে না।কিছুই হয়নি,এভাবেই নিচে নেমে গাড়িতে উঠে বসলো।গাড়ির সামনের সিট বরাবরই পছন্দের,গাড়ি যেহেতু কম ব্যবহার করে,তাই সামনের সিটের সুযোগ হাতছাড়া করে না।মুনা বিষয়টা লক্ষ্য করলো এবং পরের ঘটনাপ্রবাহ নিজের মত করে সাজিয়ে নিলো।পুরো রাস্তায় মুনা টুকটাক কথা যাই বলেছে,ভিনা হ্যাঁ না এ উত্তর দিয়ে গেছে।মার্কেটে পৌঁছানোর পর মুনা ভিনাকে সব দামী কাপড়ের দোকানে ঘুরতে লাগলো।ভিনাকে এটা সেটা কিনে দিতে চাইলেও,ভিনা হাসিমুখে মানা করে গেলো।শেষে একটা আন্ডারগার্মেন্টস এর দোকানে ঢুকে মুনা ভিনাকে ডাক দিলো-

-প্রয়োজনীয় যা লাগবে,কিনে নিতে পারো। 

-আপাতত লাগবে না।

-ঠিক তো?

-হ্যাঁ, আমি কিনেছি কয়েকদিন আগে।

-তাহলে এক কাজ করো,তুমি বাইরে অন্য দোকান অথবা ফুড কোর্টে বসো।আমি একটু পরই আসছি।

ভিনার খটকা লাগলো,কিছু না বলেই বাইরে এসে দাঁড়ালো,একটু আড়ালে। দেখলো মুনা লাল আর কালো কালারের লেসের নাইটি কিনছে আর সস্তা মশকরা করছে সেলস ওমেনের সাথে।পুরো ব্যাপারটা নোংরামি ছাড়া আর কিছুই মনে হলো না ভিনার।রাগ আর ঘৃণায় মুখ শক্ত হয়ে আসছে।

-তুমি এখানে?

-অন্য দোকানে ঘুরে এরপর এসেছি।

-কোনো কিছু পছন্দ হয়েছে?

-না।

-দুপুর হয়ে গেছে,চলো লাঞ্চ করে নেই।

-পার্সেল নিয়ে নাও,বাসায় যেয়ে খাবো।

মুনার বুঝতে বাকী নেই যে ভিনা কেন এমন করছে।এটাই চাচ্ছিলো সে।এইযে ভিনার যন্ত্রণা, এটা যে কী পরিমাণ তৃপ্তি দিচ্ছে,সেটা বলে বোঝাতে পারবে না।আজকে স্বার্থপর হওয়ার কারণেই,যা চাচ্ছে,তাই পাচ্ছে সে।গাড়িতে উঠার পরই মুনা ভিনার সাথে কথা বলা শুরু করলো-

-তুমি তো কিছুই নিলে না ভিনা,ট্যুরে কী পড়বে?

-আমি যাচ্ছি না ট্যুরে।

-এত অভিমান ভালো না,তোমার বাবা তোমাকে অনেক ভালোবাসে। 

-আমার যেতে ইচ্ছে করছে না।প্লিজ এসবে আমাকে আর জোর করো না।

-আহা!তুমি কেন এমন করছো?

-আমার ইচ্ছা নেই ব্যাস!

মুনা আর কিছু বলার প্রয়োজন মনে করলো না। আগামী পরশু ভুটানের টিকিট কাটা হয়েছে।এই একদিন ট্যুরের জন্য গোছ গাছ করতেই চলে যাবে।মুনার নতুন বিয়ে হয়ে আসার পর কী ভেবে যেন সোহেল মুনার পাসপোর্ট করে রেখেছিলো,সেটাই এখন কাজে দিচ্ছে।তখন সোহেলের কী উদ্দেশ্য ছিলো জানা নেই,এখন জানার অবশ্য প্রয়োজন ও নেই।

বাসায় এসেই ভিনা উপরে রুমে চলে গেলো,সশব্দে দরজা বন্ধ করে কান্না শুরু করলো।বিষয়টা এতটাই সেনসিটিভ যে কারো সাথে শেয়ার ও করা যাবে না।ভিনার মনে হচ্ছে এখনি দম বন্ধ হয়ে ও মারা যাবে।সেদিন আর দরজা খুলেনি ভিনা,সোহেল ও আর আসেনি ভিনার রুমে।পরেরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে সোহেল ভিনার সাথে কথা বললো।

-তারপর,আমাদের সাথে কি যাচ্ছো না?

-যাবো,পরের বার।

-পরের বার যে যাওয়া হবে,এটার গ্যারান্টি কে দিয়েছে।

-না যাওয়া হলে তো কিছুই করার নেই।

-থাকবে কার কাছে?

-রুপিন আন্টির কাছে।

-ও দেশে নাও তো থাকতে পারে?

-আছে দেশে,তোহা আপুর সাথে আমার কথা হয়েছে।

-ও,তার মানে তুমি ডিটারমাইন্ড যে যাবেই না।

-হ্যাঁ 

-ঠিক আছে। আমি আর কিছু বলবো না।

ভিনা জলদি করে নাস্তা শেষ করে উঠে চলে গেলো।সোহেল ও পুরো নাস্তা শেষ না করেই নিজের রুমে চলে আসলো।মুনাও পিছে পিছে রুমে ঢুকলো।

-খাবারের সাথে কী জিদ বলো তো,নাস্তা শেষ তো করবে।

-রুচি নেই।

-আমি এনে খাইয়ে দেই?

-লাগবে না।

-ভিনা বড় হচ্ছে,ওর হয়ত যেতে ইচ্ছা নাও করতে পারে,তাই না?

-কথা হয়েছিলো আর?কিছু বলেছে ও?

-গাড়িতে বলার চেষ্টা করেছিলাম,কিন্তু ও আমার সাথেই বসেনি,সামনের সিটে বসেছে।কেনাকাটাও করেনি কিছু।পরে যখন আবার জিজ্ঞেস করলাম আসার সময়,তখন বেশ রুড হয়ে কথা বললো।ড্রাইভার সামনে ছিলো দেখে আর কথা বাড়াইনি।ড্রাইভারের সামনে অপমানিত হওয়ার ইচ্ছে ছিলো না।

-অনেক আদর দিয়ে মেয়েকে বড় করেছি।তাই মানুষের ইমোশনের দাম দেয়া ভুলে গেছে ও।এত আত্মকেন্দ্রিক হলে,জীবনে কখনো সুখী হতে পারবে না।

-তুমি বেশি চিন্তা করছো।দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে।

-হওয়া দরকার।নাহলে অনেক সমস্যা।

মুনা সোহেলের কাঁধে হাত রেখে বসলো।আর কয়টাদিন,এরপর নিজের একটা সংসার হবে,যেখানে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি থাকবে না,মুনা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।

পরেরদিন সকালে সোহেল আর মুনা বেরিয়ে পড়লো।ভিনা আর দেখা করলো না।দুপুরের দিকে রুপিন এসে পড়বে বাসায়,তিনদিন থাকবে ওর সাথে,তাই ঘর গোছানো শুরু করলো।কিন্তু বারবারই চোখে পানি এসে পড়ছে।কোনোকিছুতে মনোযোগ দিতে পারছে না।ভেতরের কথাগুলো কাউকে না বলা পর্যন্ত কিছু করা সম্ভব না।

কিছুক্ষন ভাবনা চিন্তা শেষে যাবিরকে ফোন দিলো। 

-ব্যস্ত?আমি একটু কথা বলতাম।

-এখন ক্লাসে আছি,আধা ঘন্টা পরে কথা বলছি।

-ঠিক আছে।

ঠিক আধা ঘন্টা পর যাবির ফোন দিলো।

-হ্যালো?

-ক্লাস শেষ? 

-হ্যাঁ,কী হয়েছে?গলা বেশ ভারী হয়ে আছে,কান্না করছো তুমি?

-আমার চারপাশে সব হারিয়ে যাচ্ছে।আমি এসব সহ্য করতে পারছি না।

-আমাকে খুলে বলো,আমি শুনছি।

-আমার বাবা,আমাকে আর ভালোবাসে না।

-কেন এমন মনে হচ্ছে তোমার?

কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভিনা পুরো ব্যাপারটা যাবিরকে খুলে বললো।

-বুঝলাম।আমার মনে হয় তোমার উচিৎ তোমার বাবার সাথে সব শেয়ার করা।তাহলে যা মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং আছে,সব ঠিক হয়ে যাবে।কথা বললে,অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।

-কী বলবো আমি?কীভাবে বলবো।

-আমাকে যেভাবে বললে,সেভাবেই।

-এভাবে বলা যায় নাকি?

-বয়ফ্রেন্ডকে বলা গেলে বাবাকে কেন না?

-আবার!এবার আমার ভীষণ মেজাজ খারাপ হচ্ছে।

-ঠান্ডা হও।বাইরের মানুষকে বলা গেলে,বাবাকেও বলা যাবে।আমি এটাই বলতে চাচ্ছিলাম।

-তুমি বাইরের মানুষ না...

এই একটা কথায় যাবিরের মনে হলো,জীবনে আর কোনো অপূর্ণতা নেই।যাকে সে খুব কাছের মানুষ ভেবে জীবনে আনতে চাচ্ছে,সেও যে এর ব্যতিক্রম না,এটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া।

-যা বললাম,তাই করো।সামনা সামনি বসে সব কথা বলে সব ঠিক করো।

-ঠিক আছে।আসুক তারা,আমি কথা বলবো।

ফোন রাখার পর ভিনার মনে হলো,আসলেই তো,সবকিছু খুলে বললে ওর বাবা ঠিকি বুঝবে যে এটা রাগ বা জিদ না।ভালোবাসা থেকে আসা অভিমান।এটা যদি বুঝানো যায়,নিশ্চয়ই পুরো বিষয়টা মিটমাট হয়ে যাবে।লম্বা একটা দম ফেলে ভিনা কাজ শুরু করলো।ভেতরটা অনেক হালকা লাগছে।আসলেই যদি যাবির ওর জীবনে না থাকত কী হত?যাই হত,ভালো হত না।

বিকেলে রুপিন আসলো।ভিনা স্বভাবতই বাচ্চাদের মত জড়িয়ে ধরলো।

-আই মিসড ইউ!

-আমার বাচ্চাটা,বল তো কী হয়েছে তোর?ট্যুরে গেলি না কেন?

-ইচ্ছে করেনি।

-কেন?

-তুমি ফ্রেশ হও,তিনদিন তো আছোই,সব বলবো।

-আমার বাসায় থাকতে পারতি।

-থাকবো।যখন ভার্সিটিতে উঠবো।এরপর পার্মানেন্টলি উঠে যাবো তোমার বাসায়।থাকতে দিবে তো?

-এটা কেমন প্রশ্ন,কেন থাকতে দিবো না?কিন্তু নিজের বাসায় কেন থাকবি না?

-বাসাটা আর নিজের নেই।

-কিছু হয়েছে।

-জানি না।আসলেই কিছু হয়েছে,নাকি আমি বানিয়ে নিচ্ছি।

-ধাঁধায় রাখিস না আমাকে।

-খেয়ে নাও আসো।এরপর ঘুম দাও।তুমি যে বিদেশে ছিলে না,এই বেশি। 

-কিছু লুকাচ্ছিস?সব পরে করা যাবে,আমাকে বল,কী হয়েছে?মুনা কি সমস্যা করছে?

-করলেও তেমন কিছু হত না,যদি আমার বাবাও আমাকে পর করে না দিত।

-সোহেল!ও আবার কী করলো। 

-আমিই মনে হয় থার্ড পার্সন হয়ে যাচ্ছি তাদের সংসারে।

-এসব সোহেল তোকে বলেছে?

-না

-তাহলে?কীসব আবোল তাবোল ভাবছিস তুই?

-আমার মনে হচ্ছে।

-তুইই নাকি ট্যুরে যেতে চাস নাই।সোহেলের অনেক খারাপ লেগেছে।

-ইচ্ছে করেনি।একদমই ইচ্ছে করেনি।

-নিজের বানানো গোলক ধাঁধায় নিজেই পরে যাস না ভিনা।এসব ফ্যামিলিয়াল বিষয়কে যত বেশি নিজের লাইফে বড় করে দেখবি,তত বেশি চোরাবালিতে পড়বি।

-জানি না আমি। আমি বুঝতেই পারছি না যে আমি যা দেখছি সেটা সত্যি,নাকি আমাকে এসব দেখানো হচ্ছে।

-অহহো,কীসব বলছিস তুই?আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

-আমার মনে হয় বাবা মুনাকে বেশি প্রায়োরিটি দিচ্ছে।

-মানে?সেদিন না তুই বললি,সংসারে সব ঠিক হয়ে গেছে।

-হ্যাঁ, বলেছিলাম।কিন্তু তবুও,আমার মনে হচ্ছে।

যাবিরকে বললেও কেন যেন ভিনা রুপিন কে সবটা খুলে বলতে পারলো না।জেনারেশন গ্যাপ একটা ব্যপার এখানে।

-কী রে?চুপ করে গেলি কেন?

-এমনি।সব এলোমেলো লাগছে।

-তোর মাথা গেছে রে ভিনা।কালকে তোকে নিয়ে বের হবো নে ঘুরতে। 

-ঠিক আছে।

রুপিনের ব্যাগ গুলো তুলে রেখে ভিনা মোমেনা খালাকে ডাক দিয়ে খাবার দিতে বললো।রাতে আবার আগের মত মুভি দেখতে বসলো রুপিন আর ভিনা।

-এবার ভালো দেখে একটা বাংলা ছবি দেখি,কী বলিস?

-তোমার ইচ্ছা।

মুভি দেখা শেষে রুপিন ঘুমিয়ে পড়লো।রুপিনকে জড়িয়ে ভিনা পাশে শুয়ে পড়লো।মনে মনে ভাবলো,এই মানুষটাই যদি মুনার জায়গায় আসতো?জীবন এতটাও জটিল হত না তাহলে।
.
.
.
চলবে..................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন