পরিণয়ে পরিপূরক - পর্ব ২২ - স্পৃহা নূর - ধারাবাহিক গল্প


" আমি আর অন্য করো আমানত নই। আমি শুধু আপনার সম্পদ, আমি আপনার ই আমানত । আমি আপনারই পরিপূরক"
.
অভ্র নিজেও অবন্তী কে বাহুডোরে নিয়ে নেয়। অবন্তীর কপালে এই প্রথম শুদ্ধ্তম স্পর্শ আকে সে। শুনশান ফাকা রাস্তার সোডিয়াম হলুদ ফ্যাকাশে আলোর বাতির নিচেও আজ তারা রঙিন।
.
অভ্র অবন্তীকে কোলে তুলে নিয়ে সোজা হাটতে শুরু করল। 
.
—আরেহ নামিয়ে দিন আমাকে। এটা বাড়ি না রাস্তা।
— উহু। আমি এভাবেই হাটব।
— কোথায় যাচ্ছি আমরা?
— হানিমুন। 
— হেটে হেটে? 
— হুম। 
হেটে হেটে বহুদূর
বহুদূর হেটে হেটে
পথ নেই জানা
কিন্তু ক্ষতি কি?
সাথে যে চিরচেনা। 
— ও রে বাবা । আপনি নিজে নিজে কবিতা বানানো ও শিখে গেছেন? মনে তো হয় না এটা কোন কবির লেখা ।
—হা হা ট্রাই করলাম একটু। 
.
.
রাত প্রায় অনেক হয়ে গেছে । ফ্লাইট তো অলরেডি মিস। ট্রেন ও পাওয়া যাবে না এই রাতে। পার্সনাল গাড়ি ও বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে অনেক আগে। এখন আবার ডেকে পাঠালে বাড়িতে নানান জিজ্ঞাসা হবে এসব বিষয়ে। কি দরকার এত কিছু জানানোর।
 এখন একমাত্র উপায় বাস। তবুও খুব ভাল বাস এই মুহুর্তে পাওয়া সম্ভব নয় হয়ত। 
অভ্র আর অবন্তী লাগেজ গুলো টেনে নিয়ে হেটে হেটেই এগোচ্ছে। ট্যাক্সি বা সিএনজির অশায় । 
.
এত রাতে বাস স্ট্যান্ডেও আর বাস নেই। টিকেট কাটতে হলে পরের দিনের জন্য কাটতে হবে ।  
অবশেষে একটা পিকনিকের জন্য বুক করে রাখা বাস ম্যানেজ হলো সেখানে। কোন এক ভার্সিটির জাস্ট একটা ডিপার্টমেন্টের ফাইনাল ইয়ারের কিছু স্টুডেন্টস বুক করেছে । সিট তিনটে খালি ই ছিল। অভ্র তিনটে সিটের ডাবল করে ভাড়া দিতে চাওয়ায় ওরা রাজি হলো ।
.
.
বাসের মধ্যমণি যেন ওরাই দুজন। হানিমুন কাপল শুনে সবাই ঘিরে ধরেছে । বিয়ের গল্প , এভাবে হানিমুনে যাবার গল্প ইত্যাদি ইত্যাদি শোনার জন্য । অবন্তী ব্যাপার গুলো বেশ ইনজয় করছে। কেমন একটা মুভি মুভি মনে হচ্ছে। অভ্র তো ওদের সাথে গল্প করেই যাচ্ছে। যে কারো সাথে হুট করে তালে তাল মেলাতে অভ্রর খুব বেশি সময় লাগে না ।তাছাড়া এরা তো অভ্রর প্রায় সমবয়সী সবাই। আর এমন হৈ হুল্লুড় অভ্রর বরাবর ই পছন্দ। মাঝখানে কিছু দিন এত সিরিয়াসনেস গেছে । অভ্র নিজেই ভাবে মাঝে মাঝে সে এত সিরিয়াস কি ভাবে হয়ে গেলো । 
.

— এই ছেলে বৌ নিয়ে হানিমুনে যাচ্ছেন নাকি বন্ধুদের নিয়ে পিকনিকে? পাশে একটা বৌ বসে আছে সে খেয়াল আছে আপনার?
.
( অবন্তী চোখ রাঙিয়ে ফিস ফিস করে কথা গুলো বলে 
অন্যরা কেউ যেন শুনতে বা বুঝতে না পারে সে আন্দাজেই অন্যদের চোখ এড়িয়ে বলে)
.
— এই সুদিন ও আমার আসল তাহলে। বৌ নিজেই মনে করিয়ে দিচ্ছে পাশে সে আছে?
.
( অভ্র হাসতে হাসতে ফেটে পড়ে কথা গুলো বলতে বলতে)
.
.
— ভাইয়া ভাবি শুধু নিজেরা নিজেরা ফিস ফিস করে গল্প করলে আর হাসলে তো চলবে না । আমাদের ও গল্প শোনাতে হবে ।
— হুম হুম। আমাদের অনেক গল্প ক'টা শুনবে বলো?( অভ্র)
— ভাইয়া তোমাদের লাভ ম্যারেজ তাই না?
— না তো 
— এরেঞ্জড?
— উহু।
— তাহলে?
— ফোর্সড ম্যারেজ। 
— মানে?
— দুই জনই পিটানি খেয়ে বিয়েতে কবুল বলেছি। আমি আমার বাপের পিটানি আর ও মে বি ওর চাচার। কবুল বলতে না চাওয়ায় বাবা আমাকে এত জোরে থাপ্পড় দিয়েছিল যে আমি মনে হয় এখনো বাম কানে কম শুনি।দুজনকেই ফোর্স করা হয়েছিল বিয়েটা করতে । 
— কেন? এরকম কেন হয়েছিল?
— না,, না ওসব বলা যাবে না । তোমাদের ভাবি রাগ করবে।
.
অভ্রর এ কথা শুনে অবন্তী গেল চটে এবার।
.
— আরেহ রাগের কি আছে? শোন আমারদের দুজনের ই অন্য দুজনের সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে ছিল তাই। এই যে উনার তো যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিল সে তো এখন উনার শালি । উনি নিজেই মে বি আফসোস করেন এখনো। মে বি আমার মতো পচা চেহারার মেয়েকে দেখেই বিয়ে না করার জন্য বেকে বসেছিলেন।হবু বৌ বেশি সুন্দরী ছিল কি না!
.
অভ্র আর অবন্তীর কথার সঠিক ব্যাখা দিল না । 
অবন্তী নিজের মতো করে যা বুঝে নেয়ার নিয়েছে ভালোই হয়েছে।অনেক কষ্টের পর কিছু সুখের সময় হাতছানি দিচ্ছে হয়ত। হ্যা এতে করে হয়ত মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়েছে হয়ত কিছু লুকোতে হয়েছে। হোক না, নিজেদের ভালো থাকার জন্যই তো । ভাল থাকার অধিকার সবার ই আছে এ পৃথিবীতে। তাছাড়া বলতে তো চেয়েইছিলাম বার বার সব টা। বার বার ই যখন বাধা পড়েছে থাক না বাধাই থাক কথাগুলো। মনে মনে তাই ভাবে অভ্র।
.
.
বাস থেকে নামার সময় ওরা কোন টাকাই নিল না । অভ্র এত জোর করার পরও। এই জার্নি টা ওদের পক্ষ থেকে গিফট এই নব দম্পতির জন্য ।
অভ্র ওদের পরের দুদিনের পার্টি তেই স্পেশাল গেস্ট হিসেবে ইনভাইট করে । 
.
.
চিটাগাং এ দুদিনের অফিসিয়াল পার্টি শেষ করে গতকাল কক্সবাজার পৌছেছে। সন্ধ্যা পর্যন্ত সাগর দেখে রাত্রি বেলা অবন্তী বাংল'র পেছনের দিকের পুকুরের পাড়ে পানিতে পা ডুবিয়ে বসে আছে । অভ্র ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে । এ পুকুরে অবন্তীর পছ্ন্দের লাল শাপলার যেন মেলা বসেছে। তাই ওর জেদে এত রাতে এভাবে এখানে বসে থাকা আর লাল শাপলা দেখা। আকাশে বেশ ভাল রকমের তড়িত খেলে যাচ্ছে । যে কোন সময় বৃষ্টি হয়ে নামবে মেঘরাজ। অবন্তী অভ্রর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আনমনে গান ধরে,
.

সাগরের তীর থেকে মিষ্টি কিছু হাওয়া এনে
তোমার কপালে ছোঁয়াবো গো
ভাবি মনে মনে

আকাশের নীল থেকে তাঁরার কান্তি এনে
তোমার নয়নে ছড়াবো গো
ভাবি মনে মনে।।

এ মনে লুকানো লাজ তারা হয়ে জ্বলে আজ
কাজল কালো আখী পাখি হয়ে যায় ডাকি
তাই বলি ভালবাসা প্রানে দোলা দিয়ে যায়।
আকাশের নীল থেকে....

.
.
— অবন্তী তুমি জানো তুমি কত সুন্দর? সব সময় এমন কেন বলো যে তুমি ভালো না ? হুম? 
— আমি তো ভালো না ই। অন্যরা কত সুন্দর। অবনী কত সুন্দর, অর্নি আপু কত সুন্দর, অর্পি আপু আরো কত সুন্দর।
— ধুর সব সময় নিজেকে অন্যদের সাথে তুলনা করবে না তো । ওরা ওদের মতো সুন্দর তুমি তোমার মতো । আমার কাছে তুমিই সেরা। পরীর মতো বৌ আমার তুমি। পরি বৌ আমার । 
— আর আপনি আমার কি জানেন?
— কি? জ্বিন বর?
— উহু। পুরক সাহেব।
— মানে?
— হা হা। বুঝবেন না । 
— বুঝিয়ে বলো 
— আমি আর আপনি একে ওপরের পরিপূরক তো? ঐ জন্য মজা করে বললাম আর কি! আমি আপনার পরি বৌ আর আপনি আমার পুরক সাহেব।
— কতদূর ভাবো তুমি ! 
— হা হা ঐ আর কি।
.
.
দু এক ফোটা করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। অবন্তী আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির ফোঁটা গুলো হাতের তালুতে কুড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করে ।
.
— অবন্তী তুমি জানো বৃষ্টি কেন হয়?
.
— কেন আবার হবে? পানি চক্রের মাধ্যমে পানি জলীয় বাষ্প হয়ে মেঘ আকারে জমে। তারপর সেই মেঘে মেঘে ধাক্কা খেলে পানির কণা গুলো বৃষ্টি আকারে ঝরে পড়ে আর মেঘের মধ্যকার অন্যান্য আয়ন গুলোর পজেটিভ নেগেটিভ চার্জের আদান প্রদানের ফলে বিদ্যুত সৃষ্টি হয় । আর মেঘের ধাক্কার ফলে অনুগুলোর মাঝে কম্পন সৃষ্টি হয় । আর এই কম্পনের ফলে শব্দ উতপত্তি হয়। যাকে আমরা বাজ পড়ার শব্দ বলি। এই শব্দ কত ডেসিবেল হয় তা সঠিক মনে পড়ছে না এই মুহুর্তে। 
.
— ও ম্যাম আমি খ্যামা চাই ।
.
— যা জিজ্ঞেস করলাম তার ই তো এন্সার দিলাম। 
.
— হুম। না ঠিক ই আছে । 
.
— জানেন অভ্রনীল লাল শাপলা আমার এত পছন্দের । আগে নানা বাড়ি থেকে আসার সময় বিল থেকে শাপলা আনিয়ে নিতাম। বাড়ি এসে সেগুলো ফুলদানি তে পানিতে চুবিয়ে ঘরে রেখে দিতাম । অনেক দিন পর্যন্ত থাকে এভাবে রাখলে। মা বলত মানুষ কত দামি ফুল ফুলদানি তে রাখে আর তুই এসব কি ছাতালাতা রাখিস। 
.
— নেবে ?
— কি?লাল শাপলা?
— হুম । দাড়াও এক্ষুনি এনে দিচ্ছি।
— আরেহ না । এই রাতের বেলায় পানিতে নামা ঠিক না । শাপলার লতায় সাপ পেচে থাকে। তাছাড়াও অন্য কিছুও থাকতে পারে । পা টেনে ধরে পানির নিচে নিয়ে যাবে। ঘাড়ের রক্ত চুষে খাবে তখন বুঝবেন মজা। 
— তাহলে তো বুঝতেই হয় ব্যাপারটা। 
.
অভ্র পুকুরের পানিতে নেমে সাতড়ে গিয়ে এক গোছা লাল শাপলা নিয়ে এগিয়ে এলো । শাপলা গুলো নেয়ার জন্য অবন্তী কেও নেমে আসার জন্য চোখ দিয়ে ইশারা করল।
.
— অসম্ভব আমি নামব না । আপনি উঠে আসুন তো ।
— আমিও উঠব না । 
—ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি নামছে তো দেখুন । জ্বর হবে কিন্তু। উঠুন আমার লাগবে না ও ফুল । আর সত্যি কিন্তু পানিতে অন্য কিছু থাকে। 
— থাকুক। 
.
এই বলে অভ্র উঠে গিয়ে অবন্তীর হাতে শাপলা গুলো দিল । 
অভ্র হাতে করে এক গুচ্ছ শাপলা নিয়ে এগিয়ে আসছে অবন্তীর দিকে। অবন্তীর যেন মনে হয় জল থেকে তার জন্য কোন এক রুপ কথার রাজকুমার উঠে আসছে তার জন্য হাতে একগাদা লালচে গোলাপি রঙের ফুল নিয়ে । অভ্রর চোখের পাপড়ি , আর চুল বেয়ে পড়া পানি যেন মাদকতাময় এক একটা ফোটা অবন্তীর কাছে । 
অবন্তীর হাতে ফুল গুলো দিয়ে অভ্র ওকে কোলে তুলে নিয়ে পুকুরের সিঁড়ি বেয়ে আবার নিচে নামল। এদিকে বৃষ্টি এতক্ষণে বেড়ে দ্বিগুণ।
.

— শোন আমি এখন তোমাকে বলছি বৃষ্টি কেন হয়। ওসব সায়েন্টিফিক ব্যাখা আমার ভালো লাগে না । আসল ব্যাখা শোন,আগের দিনে যখন কাগজ আবিষ্কার হয় নি তখন কবিরা ভালোবেসে ভালবাসার কবিতাগুলো আকাশে লিখে রাখত । আর সে কবিতা গুলোই মাঝে মাঝে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে মানুষকে আবার ভালবাসার জানান দিতে। 
.
— তাই বুঝি?
— হুম। 
— তাহলে কি এই বৃষ্টি আজ আমাদের ভালোবাসার জানান দিতে চাইছে পুরো শহরে?
— মনের শহরে। 
.
 তাদের ঠোটের তীর্থে এক চুমুক ভালবাসার সাক্ষী হয় পুকুরের পানিতে পড়তে থাকা অবিরাম ধারার বৃষ্টি, মেঘ্মালা , আর লাল শাপলা গুলো।
.
.
বাংল তে ফেরার পর আজ তাদের ভালবাসার এক নতুন অধ্যায় শুরুর পালা। নিজেদের জানবে আজ নতুন করে । খুনসুটির পরিণয় আজ পূর্ণতা পাবে ভালোবাসায়।
.
.
দেখতে দেখতে পনের দিন কেটে যায় । পনের দিন যেন পনের সেকেন্ড এর চেয়েও কম। দুঃখের সময় গুলো বিষের কাটার মতো বেধে রয়, সহজে কাটতে চায় না সে সময়। কিন্তু সুখের সময় গুলো আমাদের জীবনে খুব দ্রুত কেটে যায় ।
বাড়ি ফিরতে হবে আজ। অবন্তী সকাল থেকে গোছগাছ এ ব্যাস্ত। 
অভ্র হঠাত এসে পেছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে নেয়, কোন কথা বলে না , চুপচাপ চোখ বন্ধ করে রয়। 
.
— অভ্রনীল কি ব্যাপার ? ছাড়ুন.. এগুলো গোছাতে হবে তো । এবার ও ফ্লাইট মিস করতে চান? চিটাগাং যেতে হবে এয়ারপোর্ট পৌছুতে হবে আমাদের।  
.
— অবন্তী আমাদের মধ্যে সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে গেছে তো?
— কি আশ্চর্য এটা কেমন প্রশ্ন? অবশ্যই ঠিকঠাক হয়ে গেছে সবকিছু ।
— ফেরার পরও সব কিছু ঠিকঠাক থাকবে তো?
— কেন থাকবে না?
— জানিনা ।
.
.
.
চলবে.........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন