পরিণয়ে পরিপূরক - পর্ব ২৩ - স্পৃহা নূর - ধারাবাহিক গল্প


— অবন্তী আমাদের মধ্যে সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে গেছে তো?
— কি আশ্চর্য এটা কেমন প্রশ্ন? অবশ্যই ঠিকঠাক হয়ে গেছে সবকিছু ।
— ফেরার পরও সব কিছু ঠিকঠাক থাকবে তো?
— কেন থাকবে না?
— জানিনা ।
.
— মানে?
— কিছু না । অবন্তী আমার খুব ভয় হয়। আমরা এখানেই থাকি বরং সারাজীবন এভাবেই ।
— কিসের ভয় এত আপনার? 
— জানিনা
.
— ধুর। জানিনার নামতা নিয়ে এসেছেন? বাড়ি ফিরতে মন চায় না তাই না? বাড়ি না ফেরার যত ফন্দি। মন চাইবেই বা কেন? বাড়ি ফিরলেই তো আবার কাজ আর কাজ । ফাকিবাজ কোথাকার !
.
— ঠিক ই বলেছ অনেক বড় ফাকিবাজ আমি। কিভাবে কতভাবে ফাকি দিচ্ছি নিজেও জানি না । কি করব বলো আমার ও ভালো থাকতে মন চায় ।
.
— আমরা অনেক ভালো আছি অভ্রনীল। এরপর থেকে আমরা আরো ভালো থাকব। আপনি নিজে শুধু ঠিকঠাক থাকুন। আজেবাজে চিন্তা ঝেড়ে ফেলুন মাথা থেকে । আমি আছি তো । 
.
অবন্তী পাশ ফিরে অভ্রর চুল গুলো ঠিক করে দিতে দিতে কথা গুলো বলে । 
 .
.
বাড়ি ফিরে রেণু খালা আর বাবার জন্য আনা গিফট গুলো দিয়ে দেয়। অর্নির গুলো অর্নি নেয় নি। 
.
— অবন্তী তুমি আমাকে একটুও পছন্দ করো না তাই না?
— না না অর্নি আপু। এমন নয় । আমার তো মনে হয় আপনিই আমাদের পছন্দ করেন না ।
.
— "আমাদের" কথা টা ভুল। আমি ঐ হারামি কে পছন্দ করি না । তুমি অনেক ভালো মেয়ে তা আমি জানি । তুমি ঐ শয়তানের সাথে এত দিন কিভাবে সংসার করছ তাই তো আমি ভেবে পাই না 
.
— আপু আপনি আপনার ভাই কে এভাবে যা ইচ্ছে তাই বলতে পারেন না । 

— এতটা অন্ধ ভালোবাসা ভালো নয় অবন্তী। আর আমি ওকে আমার ভাই বলে কোন দিন মানিও নি মানব ও না । 
— সেটা আপনার ব্যাপার আপু। কিন্তু উনি আপনাকে বোন বলে ঠিক ই মানে। হয়ত একটু রাগ করে আপনার ওপর । উনাকে উস্কে না দিলে তো আর উনি রাগ করেন না । আর তাছাড়া আপু আপনিও তো জানেন ঐ ঘটনার পর ...
.
— থাক বাদ দাও অবন্তী আমি নিজে দেখেছি ওর জন্য আমার মা কিভাবে ছটফট করতে করতে মারা গেছে । ও আমার ভাই হতেই পারে না । ওর জন্য আমার ও ছোট বেলা নষ্ট হয়েছে । অভ্র মায়ের পেটে থাকাকালে আমি খুব বেশি বড় ছিলাম না । ক্লাস ফাইভে পড়তাম মাত্র। আমি ঐ সময় থেকে মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত। মা অসুস্থ হয়ে গেছিল শুধু মাত্র ওর জন্য । মা বছরের পর বছর অসুস্থ ছিল। বাবার সাথেও মায়ের সম্পর্ক কিছুটা হলেও খারাপ হয়ে গেছিল । মা অযথা বাবাকে সন্দেহ করত। তুমি বলো সব কিছুর পেছনে কে দায়ী? অভ্র ই তো? ও আসার জন্যই তো মা অসুস্থ হয়ে গেল। আর সবাই শুধু অভ্রর দিক টা দেখত । অভ্রনীল ছোট ওর আদর যত্ন দেখাশোনার বেশি প্রয়োজন সবার মাথায় শুধু এটাই থাকত। অথচ আমিও তো ওর মতো খুব ছোট না হলেও বেশ ছোট ছিলাম। আমার কথা করো মনেই পড়ত না । অর্পি আপু বাড়ির বড় সন্তান ছিল বলে অনেক বেশি আদর পেত বরাবর ই। অভ্র ছোট বলে আরো বেশি আদর। আর আমি মেঝ বলে ফাকা তাই না? আমি কি ইচ্ছে করে মেঝ হয়েছি বলো,? ঐ জানোয়ার অভ্রনীল এসেছে বলেই তো আমাকে মেজ হয়ে যেতে হলো । ও আসার আগে আমি ছোট ছিলাম এ বাড়ির। সবাই আমাকে ছোট হিসেবে কত আদর করত। যে বাবা বাড়ি ফিরেই আমাকে কোলে নিত সেই বাবা তখন বাড়ি ফিরে অভ্রকে কোলে নিত। আর ঐ হারামি তো জন্ম থেকেই সাত সেয়ানার এক সেয়ানা । সারাদিন আদর নেয়ার জন্য প্যা প্যা করে কেদেই যেত। আর সবাই ওকে নিয়েই আদিখ্যেতা করত।
.
— জন্মের পর মায়ের আদর ,উষ্ণতা না পেলে সব বাচ্চারাই কান্না করে আপু। অন্য কেউ যতই আদর করুক মায়ের উষ্ণতার সমান তো আর হয় না । 
.
— হ্যা সেই জন্যই তো যখন মায়ের ভালোবাসা, আদর ,শাসন পেতে শুরু করল তখন মাকেই মেরে ফেলল। ওকে শুধু আদর ই করতে হবে? শাসন করার অধিকার কি মায়ের ছিল না নাকি? জন্মের পরই নুন খাইয়ে মেরে ফেলা উচিত ছিল ওকে আমাদের। অভ্র ছোট থেকেই প্রচুর মিথ্যে কথা বলে অবন্তী।ও কি পরিমান মিথ্যেবাদী তা যদি তুমি বুঝতে ! ওর বলা সত্য মিথ্যের মধ্যে তুমি কোন তফাত ই খুজে পাবে না । অর্পি আপু , রেণু খালা কে তো ঘোল খাইয়েছেই। সাথে বাবাকেও, বাবা ও এখন ওকেই বিশ্বাস করে । আর তুমি তো বিশ্বাস এর ভান্ডার নিয়ে বসে আছ! তাছাড়া তুমি নিজে খেয়াল করে দেখো ওকে একটু শাসন করতে নিলে কেমন করে ওঠে ,ফোস করে ওঠে সাপের মতো ।
.
.
অবন্তীর কাছে অর্নির সব কথা অর্থহীন মনে হলেও এই শেষের কথাটা ঠিক ই লেগেছে । অভ্র সত্যি সত্যি কেমন যেন শাসন করা পছন্দ করে না । এ বাড়িতে বাবা ই একমাত্র শাসন করে তাকে। আর বাবাকে যে অভ্র খুব একটা পছন্দ করে না সেটা অবন্তী অনেক আগে থেকেই বুঝতে পেরেছে চাল চলনে। হ্যা, বাবার জন্য অনেক কিছু করতে চায়, মুখ উজ্জ্ল করতে চায় কিন্তু তারপর ও ভেতরে ভেতরে কেমন একটা সুপ্ত রাগ যে আছে তা বোঝা যায় । শুধু শাসন করে বলে বাবার ওপর এমন রাগ নাকি অন্য কিছু কে জানে । সেদিন এলবামে ছবি দেখাতে দেখাতেও অবন্তীর ঐ প্রশ্নে অভ্র বাবার ছবির দিকে এক নজর হলেও তাকিয়েছিল অবন্তীর সেটা চোখ এড়ায় নি।
.
.
 রাতে অভ্র শুয়ে শুয়ে অবন্তীর হাতের আঙুল গুলো নিজের আঙুলের সাথে নিয়ে ছোট বাচ্চাদের মতো খেলা করছে আর গুন গুন করছে। 
.
অবন্তী বুঝতে পারল অভ্রর মন মেজাজ এখন বেশ ভাল আছে। যে কোন প্রশ্ন করাই যায় ।  
.
মানুষের খুব বেশি মন ভালো থাকলে সাধারণত বলতে না চাওয়া কথা গুলো বলে ফেলে নিজের অজান্তেই। আবার মন খুব বেশি খারাপ হলেও এমনটা ঘটতে পারে । 
.
 .
— অভ্রনীল
— হুম?
— শুনুন না 
— বলো । শুনছি তো 
— একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
— হুম। একটা কেন হাজারটা করো। 
— বাবাকে আপনি খুব একটা পছন্দ করেন না তাই না?
— কে বলল? করি তো ।
— কই সব সময় তো বাবা বলে ডাকেন না ।
— তো?
— কিছু না । 
.
— তুমি জানো আমার কেন মাঝে মাঝে বাবার ওপর রাগ হয়? সেদিন মা আমার জন্য রান্না করতে নিচে গিয়েছিল। ওদের ঝগড়ার জন্য প্রায় সারারাত জেগে থাকায় সকাল বেলা আমার খুব ঘুম পেয়ে গেছিল। তাই আমি ঘুমিয়ে পড়ি । তারপর হঠাত মায়ের চিতকার পাই। ঘুমের ঘোরে আমি কি করছিলাম নিজেও জানি না । আমার মাথাই কাজ করছিল না । দারোয়ান আঙ্কেল কে ডেকে আনব সে হুশ ও পাই নি। বাড়ি থেকে গেট কত দূর তা তো জানোই। বাড়ির ভেতরের তেমন আওয়াজ অত দূর যায় না । আমি বাবার অফিসের টেলিফোন নম্বর অনেক কষ্ট করে মনে করে বার বার ফোন করেছিলাম বাবাকে। বাবা তো মিটিং নিয়ে ব্যাস্ত তাই না? ফোন রিসিভের সময় ই নেই। বাবা ফোন টা রিসিভ করে জানলে হয়ত ওরকম কিছু হত না । বাড়ি ফিরে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে হয়ত রুম টা খুলতে পারত । তারপর আমি নিজেই চেষ্টা করি কোন ভাবে তালা খুলতে । আর অর্নি এসে সেটাই উল্টো করে বলে দিল সবাই কে। তুমি জানো ওর জন্যই বাবা, অর্পি আপু রেণু খালা সবাই অবিশ্বাস করেছিল আমাকে। রেণু খালা আর অর্পি আপু বিশ্বাস করে এখন আমাকে ধীরে ধীরে । কিন্তু বাবা ...জানি না কি করে। 
.
অবন্তী আর কোন কথা বাড়ায় না । অভ্রর দীর্ঘশ্বাসের শব্দ সে ঠিক ই শুনতে পায়। দীর্ঘশ্বাসের ক্ষত পড়া বুকে নিজের মাথা গুজে দেয় অবন্তী। 
.
.
মাঝ রাতে ঘুমের ঘোরে পাশে কাউকে না পেয়ে জেগে যায় অবন্তী। সেই শুরু থেকে এতদিনে অভ্যেস হয়ে গেছে ঘুমের সময় পাশে অভ্রর উপস্থিতি। 
.
ওয়াসরুম, বেলকনি বা বেলকনি বরাবর নিচে মায়ের কবর কোথাও নেই অভ্রনীল । ফোন ও তো বিছানায় ফেলে গেছে । কি আশ্চর্য কোথায় গেল মানুষ টা । কৌতুল বশত খুজ্তে খুজ্তে রুম থেকে বেরিয়ে নিচের মেইন দরজা খোলা অবস্থায় দেখতে পেল অবন্তী। 
নিজেও চলে গেল বাহিরে অভ্রর খোজ করতে।
.
 এমনিতেই অর্নির কথা বার্তা ভালো লাগে না । তার মধ্যে এই গভীর রাতে একা একা কোথায় বেরিয়ে পড়ল। শত্রুর তো আর অভাব নেই । একা পেয়ে যদি কেউ কিছু করে দেয়। 
.
.
গার্ডেনে বের হতেই দূর থেকে আলোর ছটা দেখতে পেল অবন্তী । দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে কিছুতে। পাশে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। কিছুটা এগিয়ে যেতেই দেখল মানুষ টা আর কেউ নয় অভ্রনীল। এক হাতে দিয়াশলাই বক্স অন্য হাতে কেরোসিন এর বোতল। আগুনের লাল শিখার আলোয় একদম টকটকে লালচে হলদে আভা পড়েছে অভ্রর মুখে। 
.
.
.
চলবে..........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন