মুনা ঘরে এসেই সোফায় বসে পড়লো, যেন শরীরে কোনো শক্তি নেই।মানসিক আঘাত মানুষের শরীরের প্রতিটা কোষ থেকে যেন শক্তি শুষে নেয়,শ্বাস নেয়াও দায় হয়ে যায়।মুনাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে ভিনা অবাক হলো।নিচে নেমে প্রথমে দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করলো সব,যখন দেখলো মুনা ভাবলেষহীন ভাবে বসেই আছে,তখন একটু ভয় পেলো।ধীর পায়ে এগিয়ে তার পাশে বসলো।
-কিছু হয়েছে?
মুনা উত্তর দিলো না।ভিনা মুনার হাতের উপর হাত রাখলো।
-কিছু হয়েছে?আমাকে খুলে বলো।
মুনা ভিনাকে জড়িয়ে কাঁদা শুরু করলো।মানুষ মারা গেলে যেভাবে দাঁপিয়ে কাঁদে,ঠিক সেভাবেই।
-কেউ নেই.....নেই।আমার...আমার মা ও আমাকে মনে করলো না....কেউ দেখতেও আসেনি।যাদের জন্য পুরো জীবন টা দিয়ে দিলাম....নিজের বোনের বিয়ের দাওয়াত ও....
কান্নার দমকে কথা জড়িয়ে আসছে।কিন্তু কথার সারমর্ম বুঝতে কষ্ট হলো না।এই প্রথম মুনার জন্য ভীষণ খারাপ লাগছে।কেন প্রিয় মানুষগুলোকেই বড় কষ্টগুলো দিতে হয়?এটাই কি পৃথিবীর নিয়ম?
•
ওয়াসিম ভেজা চোখে তাকিয়ে আছে সবগুলো কার্ডের দিকে। কিছুক্ষণ আগেই ওর মা এসে পুরো রুমের আনাচে কানাচে তল্লাশি চালিয়েছে।আরশির জন্য লেখা ডায়রি,কার্ড সবকিছু মুড়িয়ে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।কতগুলা সড়াতে পারলেও বেশিরভাগই পারেনি।গতকাল কোন এক গার্জিয়ান নাকি বলেছে,আরশির সাথে ওয়াসিম মেলামেশা করে,এরপর থেকে ওয়াসিমের মার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।আজকে বিকালে হটাৎ ই রুমে এসে দেখে সব ছড়ানো ছিটানো।ওর মা এসে হ্যাচকা টান দিয়ে ওকে রুমে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো।
-আরশি তোর কে লাগে?হ্যাঁ?
-আমার ভালো ফ্রেন্ড।
-ফ্রেন্ড?এসব পিড়িতির আলাপ কার জন্য লিখেছিস?
-কোনগুলো?
-এইযে কার্ডগুলা?এগুলা কী?
ওয়াসিম কোনো উত্তর দিলো না।
-কী রে?কথা বল?এইটুক বয়সে পাকনামি করিস,প্রেমের জ্বালায় বাঁচিস না,এখন মুখে কথা নাই কেন?
-মা প্লিজ থামো তুমি!
-কী থামবো আমি হারামজাদা!আর কোনো মেয়ে পেলি না তুই?ফ্যামিলি দেখসিস ঐ মেয়ের?বাপ নাই কিছু নাই,ভাই পাগল!
-তাতে কী হয়েছে?
-বেশি কথা ফুটসে মুখ থেকে?কী জানিস ঐ মেয়ের ব্যাপারে?ঐ মেয়ের ক্যারেক্টার জানিস?
-জানি।
-আবার কথা!দেখ ওয়াসিম,আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিবি না।কিছুই জানিস না তুই।এখানেই থেমে যা।আমার কানে যেন আর কোনো কথা না আসে তোর আর ঐ মেয়ের ব্যাপারে। তাহলে ঐ মেয়ের সামান্য যে পড়াশোনা করতেসে, ঐটাও বন্ধ করার ব্যবস্থা করবো আমি।
এরপর ওয়াসিমের সামনেই কার্ড আর ডায়রিতে আগুন লাগিয়ে ওর মা চলে গেলো।বয়স টা এত কষ্টকর কেন?কেউ অনুভূতির সামান্য মূল্য দেয় না।অথচ এই বয়সেই অনুভূতি সবচেয়ে তীব্র থাকে।
•
মুনাকে তার রুমে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে ভিনা নিজের রুমে এসে বসলো।কাল থেকে টেস্ট পরীক্ষা শুরু,আপাতত নিজের খারাপ লাগাকে পাশে সড়িয়ে রেখে টেবিলে বসলো।ঠিক তখনি অচেনা নাম্বার থেকে ফোন আসলো।প্রথমে ফোন ধরতে না চাইলেও কী মনে করে যেন ফোন কেটে যাওয়ার আগেই রিসিভ করলো।
-হ্যালো?
-ভিনা?ভিনা ইনজামাম বলছো?
-জেরিন?
জেরিনের কথা বন্ধ হয়ে গেলো।তাহলে যাবির আগেই বলে দিয়েছে,সেফ প্লে।রাগে মাথা কাজ করছে না।নিজেকে কোনোমতে শান্ত করে আবার কথা বলা শুরু করলো।
-যাবির তাহলে আগেই বলে দিয়েছে।
-যেটা সত্যি সেটাই বলেছে।
-সত্যি হলে নিশ্চয়ই ভয় পেত না?
কিছুটা আন্দাজে ঢিল মারলো জেরিন।লক্ষ্য করেছে যে যতবারই যাবিরের কাছে গিয়েছে,ইরিটেট হওয়ার পাশাপাশি খানিকটা ভয়ও পেয়েছে।
-ভয় পেয়েছে কে বললো?
-আমি যাবির কে খুব ভালোমত চিনি।ওর প্রতিটা বিহেভিয়ার আমার চেনা।এতদিনের সম্পর্ক আমাদের...
-আচ্ছা?কতদিনের?
-তিন বছরের..
-সম্পর্ক ভেঙেছে কীভাবে?
আবার থতমত খেলো জেরিন।ভিনার ভাবলেশহীন কথার ধরণই ওকে কাবু করে ফেলছে।যেই কনফিডেন্সে ফোন দিয়েছিলো,সেই কনফিডেন্সে আর কথা চালাতে পারছে না।
-সম্পর্কের অনেক দিক থাকে।আমি আমার পড়াশোনায় এতটা ব্যস্ত ছিলাম যে ওকে সময়ই দিতে পারিনি।ধীরে ধীরে দূরত্ব এসে পড়েছে।
-একবার যখন ভেঙ্গেই গেছে,তাহলে জোড়া লাগাচ্ছো কেন?ইউ শুড মুভ অন।
-এত সহজে মুভ অন করা যায়?
-চাইলেই যায়।চেষ্টা করে দেখো।
-সব জানা সত্ত্বেও এই সম্পর্ক আগাবে তুমি ভিনা?তোমার বিন্দুমাত্র আত্মসম্মান নেই?
-আত্মসম্মানের লেকচার আমাকে দিতে এসো না।তোমার সম্পর্কে ধারণা আমার আছে,এই বিষয়টা কেন বুঝতে পারছো না?
-তুমি কেন মুভ অন করো না তাহলে?
-আমার তো সম্পর্ক ভাঙ্গে নি,ভাঙ্গলে আমিও মুভ অন করবো।
-যাবির কে চিনো না তুমি।ইউজ করে ছুড়ে ফেলে দিবে।বলতে চাইনি যদিও, তবুও বলি,আমাদের সম্পর্ক অনেকদূর এগিয়েছিলো।
-কতদূর?
-এটাও বুঝতে পারছো না?
ভিনা বুকে হটাৎ ধাক্কা লাগলো।তবুও সামলিয়ে নিলো মুহূর্তেই।সে জানে জেরিন সম্পর্ক ভাঙার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে।
-কেন আগাতে দিলে?
-তুমি বুঝবেও না কখন সম্পর্ক আগাবে,আবেগ এমনই জিনিস।তোমার কী মনে হয়,কিছু না হলে আমি এমনিই ওর পিছনে এভাবে লেগে থাকবো?
-এখানে আমার কী করার আছে?আমি যদি সরে আসি,তাও কি যাবির ব্যাক করবে তোমার কাছে?
জেরিন হার মানলো।কোনোভাবেই ভিনাকে দমানো যাচ্ছে না।নিজেকে অনেক ছোট মনে হচ্ছে।
-নিজের ভালো নিজে না দেখলে আর কীই বা করার আছে।একদিন তুমিও ভুগবে ভিনা,তখন বুঝবে আমি ঠিক ছিলাম।
-সেটা হয়ত আমার প্রাপ্যই হবে,দেখে নিবো নে।আপাতত আমার পরীক্ষা,আর কোনো কল চাচ্ছি না এই বিষয়ে।
-টেক কেয়ার এন্ড বেস্ট অফ লাক ভিনা।
জেরিন ফোন রেখে দিলো।রুমের দরজা বন্ধ করে পাগলের মত কান্না করা শুরু করলো।এত ইগো,এতটা ইগনোরেন্স।নিজের ক্যারিয়ার,স্বপ্ন সব পেছনে ফেলে যাবিরের পেছনে ছুটছিলো।যে ছেলেকে দুই পয়সা দাম দিতো না,সেই ছেলের হাতে পায়ে ধরে সে ভিনার নাম্বার কালেক্ট করেছে।গতরাতে যখন ভিনার নাম্বার পেলো,মনে হয়েছিলো সব ঠিক হয়ে যাবে।যাবিরকে পেয়ে যাবে। এতকিছু যে করলো,বিনিময়ে কি কিছুই পাবে না?
ভিনার মনে অদ্ভুত একটা ভয় কাজ করছে।আসলেই যদি যাবির কিছু না করে থাকে,একটা মেয়ের পক্ষে কি সম্ভব নিজের নামে এতবড় মিথ্যা কথা বলা?নিজের সম্মান কেন একটা মেয়ে এভাবে নষ্ট করবে?দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার ভাবলো।দেড় বছর ধরে সে যাবিরকে চিনে।কখনো আপত্তিকর কোনো ব্যবহার যাবির করেনি।ভিনা যেরকম যেভাবে থাকতে চেয়েছিলো,সেভাবেই থাকতে দিবে।কারো রক্তেই যদি বেইমানি থাকে,সেটা কি সামান্য হলেও এই দীর্ঘ সময়ে প্রকাশ পাবে না?সব আজেবাজে চিন্তা ঝেড়ে ফেললো ভিনা।যা হবে,দেখা যাবে।এখনো কোনো সম্পর্কে সেভাবে জড়ায় নি।পরীক্ষাটা শেষ হোক, সম্পর্কের ব্যাপারে নতুন করে সব ভাবা যাবে।
.
.
.
চলবে................................................