— এভাবে ভুত দেখার মতো চমকে উঠলে কেন? আমি কি ভুত?
— আপনি ভুত না হলেও অদ্ভুত।
.
অভ্র অবন্তী কে পাজাকোল করেই রুমে নিয়ে গেল । বিছানায় বসিয়ে দিয়ে ওর বরাবর হাটু গেড়ে মেঝেতে বসল।
.
—আমাকে একটু শান্তি মতো ঘুমোতেও দেবে না তুমি তাই না?
— আপনি কি করে বুঝলেন আমি কারো সাথে কথা বলছিলাম? আপনি তো ঘুমোচ্ছিলেন।
— কারো সাথে নাকি শুভ্র'র সাথে?
— হ্যা শুভ্র'র সাথে ।
— ভালো লাগে এভাবে রোজ রোজ লুকিয়ে লুকিয়ে পরকিয়া করতে? শুদ্ধ বাংলা ভাষায় তো এটা কে পরকিয়া ই বলে তাই না?
.
— চুপ আর একটা বাজে কথা বলবেন না । আমাদের মধ্যকার বিশ্বাস টুকু আপনি এভাবে না ভাঙলেও পারতেন। আপনি চাইলে সহজ ভাবেও বিষয় টা সমাধান করা যেত। অর্নি আপু ঠিক ই বলে আপনার মন আর মস্তিস্কের ভেতর জটিলতা আর কুটিলতা ছাড়া আর কিচ্ছু নেই ।
.
— খুব তো অহংকার করতে আমাদের মাঝে বিশ্বাস আছে। আমাদের সম্পর্ক টা বিশ্বাসের। এখন কই গেল সে বিশ্বাস? তোমার নানার বাড়ি? নাকি শুভ্রর ফুফুর বাড়ি? এই পৃথিবীতে বিশ্বাস এর মতো ঠুনকো জিনিস আর নেই অবন্তী।
.
— হ্যা আপনার কাছে তো তাই মনে হবে। সারাজীবন নিজের আপনজন দের থেকে অবিশ্বাস পেয়ে এসেছেন কি না। এখন অন্যদের বিশ্বাস অবিশ্বাস নিয়ে খেলতে শুরু করেছেন? এসবে মজা খোজেন আপনি তাই না???? আপনার মতো জঘন্য লোক আর দুটো দেখিনি আমি।আর আপনার এই ভ্রূ নাচিয়ে ঠোট বাকানো হাসি আমার একদম পছন্দ হয় না । থামুন।
.
— কেন হাসির ফাদে পড়ো বুঝি? নাকি এটা বলতে চাইছ এই হাসি বাদে আমার অন্য সব কিছু তোমার ভালো লাগে?
.
— সব কিছুর একটা লিমিট আছে অভ্র। আমার জীবন টা একদম অতিষ্ট করে তুলেছেন আপনি। খুব মজা তাই না? অন্যের লাইফে ইন্টারফেয়ার করে তার লাইফ নিজের আঙুলের ডগায় নিয়ে ঘোরানো? আর সব সময় ছায়ার মতো কেন ঘুর ঘুর করেন আমার পেছনে?
.
অবন্তী আবার সজোরে ধমক দিয়ে বলতে থাকে,
—আবার মুচকি মুচকি হাসছেন? কি সমস্যা টা কি আপনার? বলেছি না হাসবেন না । খুব খুশি লাগছে তাই না শুভ্র আমাকে বিশ্বাস করছে না বলে?
.
— হুম। খুউউ...ব
.
কথা শেষ করার সাথে সাথেই অভ্র বুঝতে পারল তার ডান গালে বেশ জোরে একটা থাপ্পড় পড়েছে। কানেও পো পো আওয়াজ করছে। কান তালি লেগে গেছে । কান বা গালে হাত দেয়ার সুযোগ ও অবন্তী তাকে দিচ্ছে না । আরো বেশ ক'টা থাপ্পড়, কিল,ঘুষি,খামচি, এমন কি মাথার ক'টা চুল ও ছিড়ে নিয়েছে অবন্তী। অভ্র হাটু গেড়ে ঠায় বসে আছে ।
.
— শাড়ির আঁচল ঠিক করো ।
.
হঠাত অভ্র'র ধমক শুনে অবন্তী বেশ বিব্রত অবস্থায় পড়ল। সত্যিই তো অভ্রকে এভাবে এলোপাথারি মারতে মারতে সামনে আচলের এক পাশ কখন যে বেশ নিচে নেমে গেছে খেয়াল ই করে নি। আচল উঠিয়ে ঠিক করতে করতে বিছানায় আবার বসে পড়ল। লজ্জায় আর কোন কথাও বেরচ্ছে না মেয়েটার মুখ দিয়ে ।
.
অভ্র উঠে গিয়ে ফার্স্ট এইডের বক্স থেকে স্যাভলন আর তুলো বের করে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আয়না দেখে নিজেই ছিলে যাওয়া জায়গা গুলো তে স্যাভলন লাগিয়ে নিল। মেয়েটার নখে ধার আছে বলতে হবে । ডান চোখে ভ্রূ'র নিচে সামান্য কেটে গেছে আর তাছাড়া গলা ,ঘাড় আর কলার বোনের নিচে খামচে যা ইচ্ছে তাই করে দিয়েছে । সাদা চামড়ার নিচে যে রক্ত জমাট বেঁধে আছে বেশ খানিক দূর থেকেও তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
.
.
রাতে খাবার খেতে অভ্র অফ শোল্ডার টিশার্ট পড়ে নিচে নামল। অভ্রকে অবন্তী বেশিরভাগ সময় কলারওয়ালা টিশার্ট ই পড়তে দেখেছে। আজ আবার কি হলো কে জানে,এদিকে খামচির দাগ গুলো এতক্ষণে আরো স্পষ্ট কালচে হয়ে উঠেছে । খেতে খেতে অভ্র বার বার ঘাড়ে গলায় হাত দিচ্ছে। বুয়াদের দিকে তাকিয়ে অবন্তীর আর ব্যাপার টা বুঝতে বাকি রইল না। দুটো বুয়া বার বার খাবার দিতে আসছে আর অভ্র'র ঘাড়ের দিকে আর অবন্তীর নখের দিকে তাকিয়ে মিট মিট করে হাসছে।
.
আশ্চর্য এই ছেলেটা এত বেহায়া কেন। অভ্র এসবের অন্য কিছু মিন করতে চাইছে আর ইচ্ছে করে বার বার ঘাড়ে হাত দিয়ে সবাই কে তা দেখাতে চাইছে। এসব ভেবে অবন্তী রাগে কটমট করছে। এই ছেলের সাথে কোন দিক দিয়ে কোন কিছুতেই পেরে উঠছে না সে।
.
এদিকে ব্যাপারটা যে পাশে বসা রেণু খালার যে চোখ এড়িয়েছে তা নয়। বাবা খাবার খেয়ে চলে যাবার পর রেণু খালা মুচকি হেসে অবন্তীর কানে ফিসফিসিয়ে বলল,
.
—অবন্তী নখ গুলো একটু ছোট রাখলেই তো পারো।
.
— হ্যা খালা ওকে একটা নেইল কাটার দিও তো । আমার এত্ত সুন্দর স্কিন টা শেষ করে দিয়েছে আজ। যদিও লাভ সাইন কিন্তু...তবুও আমার ও তো লোক জনের মধ্যে চলতে হয় ।
অভ্র অবন্তীর দিকে তাকিয়ে বাকা হাসি হেসে চোখ টিপ দিয়ে চলে গেল ।
.
এ তো দেখি কানে কানে কথাও শুনতে পায়। অবন্তী অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।পুরো ঘোল খাইয়ে দিচ্ছে সবাইকে এ ছেলে।
.
এদিকে রেণু খালা বলতেই থাকে,
— অনেক দিন ই তো হলো মা। এবার নাতিপুতির মুখ না দেখালে কিন্তু ছাড়ছি না । আমার ছোট্ট অভ্রনীলের কোলে আর একটা জুনিয়র অভ্রনীল দেখতে চাই এবার। অভ্রনীলা হলেও চলবে। কতদিন আর অর্থিকে চুরি করে আদর করবে আমার ছেলেটা?
.
—এই খালা থামুন তো । ছোট্ট অভ্রনীল তাই না?? উনি ছোট্ট??? এত্ত জুনিয়র অভ্রনীল কে দেখার শখ হলে উনাকে ডায়পার আর মুখে ফিডার দিয়ে বসিয়ে রাখুন।।
.
অবন্তী কথা গুলো বলে গজ গজ করে যেতে যেতে আবার কি যেন মনে হয়ে ফিরে এলো,
.
—খালা আমার মাথার ঠিক নেই। সরি কিছু মনে করবেন না আমার কথা গুলোর জন্য । আমার কিছু ভালো লাগছে না খালা। একমাত্র আপনার কথা তো উনি শোনে উনাকে একটু বোঝাবেন???
— কি বোঝাব? আর তুমি এমন কাদছ কেন মা? কি হয়েছে? সব কিছু তো ঠিকঠাক ই চলছিল।
— কিচ্ছু ঠিকঠাক চলছে না । আর কোন দিন চলেও নি। আপনি উনাকে অন্তত এটুকু বোঝান সব কিছুতে মজা খুজে নেয়া আর সব কিছু কে খেলা মনে করা উচিত না । উনি নিজে যেগুলো পান নি সেগুলো অন্যদের মাঝে দেখতে পছন্দ করেন না । এটাই উনার সব চেয়ে বড় রোগ।
.
— মা তুমি ভুল বুঝছ। অভ্রনীল এমন না ।
— তাহলে উনি কেন আমার সাথে এমন করেন?
.
— আমি সত্যিই জানি না ও তোমার সাথে কি করে আর কেনই বা করে। যা ই হোক, নিজেদের মধ্যে নিজেরা ই বোঝাপড়া করে নাও মা। নিজের স্বামী নিজের সংসার এসব কবে আপন করে নেবে? এসবের হাল তো তোমাকেই ধরতে হবে । আর ওকে একটু ভালভাবে বোঝার চেষ্টা করো । সারাজীবন থাকতে হবে তো একসাথে?? নিজেরা নিজেদের না বুঝলে কি করে হবে?
.
.
অবন্তী কোন উত্তর না দিয়েই রুমে চলে যায় ।
.
.
আমি শুনেছি সেদিন তুমি
সাগরের ঢেউ এ চেপে নীল জল দিগন্ত ছুয়ে এসেছ
আমি শুনেছি সেদিন তুমি নোনাবালি তীর ধরে বহুদূর বহুদুর হেটে এসেছ
আমি কখনো জাই নি জলে কখনো ভাসি নি নীলে
কখনো রাখি নি চোখ ডানা মেলা গাঙচিলে
আবার যেদিন তুমি সমুদ্র স্নানে যাবে আমাকেও সাথে নিও
নেবে তো আমায়, বলো নেবে তো আমায়?
.
.
বেলকনি তে দাড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে অবন্তী নিজের অজান্তেই গুন গুন করে যাচ্ছে । এ কটা লাইন তার বড্ড প্রিয়। ।
.
.
এরই মধ্যে অভ্র কফির মগ হাতে করে এনে এক চুমুক দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়েই পরের টুকু গাইতে থাকে,
.
আমি শুনেছি সেদিন তুমি,
তুমি তুমি তুমি মিলে তোমরা সদল বলে সভা করেছিলে
আর সেদিন তোমরা নাকি অনেক জটিল ধাধা
অনেক না বলা কথা, কথা তুলেছিলে?
কেন শুধু শুধু ছুটে চলা, একি একি কথা বলা?
নিজের জন্য বাচা নিজেকে নিয়ে?
যদি ভালোবাসা না ই থাকে শুধু একা একা লাগে
কোথায় শান্তি পাব কোথায় গিয়ে?
বলো কোথায় গিয়ে?
.
.
— বাহ আপনি তো দারুন গান। আর গানটা আপনিও জানেন?
— হুম। আমি দারুন গাই না । গান টা ই দারুন। এর পরের লাইন গুলো আরো দারুন।
— আমার প্রথম টুকুই বেশি ভাল লাগে ।
— আর আমার শেষ টুকু। আসলে গান বলো আর কবিতা ই বলো যে লাইন গুলো যে কথা গুলো আমাদের জীবনের সাথে মিলে যায় সেগুলো ই কিন্তু আমাদের ভালো লাগে । ।
— আপনি দিন দিন এত দারুন দারুন কথা কিভাবে বলতে শিখছেন অভ্র?
— জানি না । তবে একটা কথা বলি ? তুমি এ গানটার প্রথম অংশ গুলো শুভ্র কে নিয়ে ভাবো । আর আমি মাঝের আর শেষ অংশ গুলো তোমাকে নিয়ে ভাবি। এটাই এখন তোমার আর আমার মাঝে পার্থক্য আর দূরত্বের দেয়াল।
কেন বার বার একি কথা বলো একি প্রশ্নের উত্তর খোজ? রেণু খালার সাথে এসব জটিল ধাধার সমাধান খুজতে চাও? আমি তো ওপরে দাড়িয়ে শুনছিলাম তোমাদের কথা সেদিন। শোন এসব ধাধা যে বানিয়েছে তার কাছেই উত্তর আছে।
.
— তো দিন আমাকে উত্তর।
.
— শোন আমাদের ভাগ্যটাই একটা ধাধা । আর এই ভাগ্য তৈরি করেন মহান আল্লাহ । আমার ভাগ্যে তুমি ছিলে এটা আমি ধীরে ধীরে মেনে নিয়েছি অবন্তী আর শুধু যে মেনে নিয়েছি তা ও নয় আমি আ...আমি তোমাকে ভালো ও বেসে ফেলেছি কেন বেসেছি সে না হয় পরে বলব।।বেটার হবে তুমিও যদি আমাকে মেনে নাও।
.
.
কথা গুলো বলে অভ্র চলে যাবার পর অবন্তী নিজের হাতের রেখা গুলোর দিকে তাকালো । শুনেছে হাতের রেখায় ও নাকি মানুষের ভাগ্য লেখা থাকে।
.
.
শুভ্র টুকিটাকি হাত দেখতে পারে। গ্রামে দাদির সাথে থাকার সময় এক দুঃসম্পর্কের এক দাদার কাছে শিখেছিল নাকি।
একদিন শুভ্র অবন্তীর হাত নিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছিল প্রায় অনেক্ষন ধরে ।
এদিকে অবন্তীর বেশ বিরক্ত লাগছে এবার।
.
— এই কি দেখছ এতক্ষণ ধরে????? তুমি জানো এসব হাত দেখা ইসলামে বারণ? ইমান নষ্ট হয়ে যায় এসব বিশ্বাস করলে।
— উফ্ফ চুপ করো তো । বিশ্বাস আমিও করি না । পারি যখন দেখতে ক্ষতি কি???
— ঘোরার ডিম পারো তুমি। এত সময় লাগে বুঝি? আমার হাত ধরে থাকার ইচ্ছে করছে সেটা বললেই তো পারো সরাসরি।
— আরে পিচ্চি আমি সত্যি একটু একটু হাত দেখতে পারি
— তাহলে নিজের হাত দেখো না কেন?
– আমার যে পোড়া কপাল জন্মের আগে থেকেই। তাই ভয় পাই নিজের হাত নিজে দেখতে।
— হয়েছে থাক।বাদ দাও ওসব কথা ।আচ্ছা আমার হাত দেখে বলো তো আমাদের ক'টা বেবি হবে?
.
শুভ্র কোন কথা বলে না । ঠোট টিপে মুচকি হাসি দেয়।
.
কিছুক্ষণ পর শুভ্র আবার বেশ গম্ভীর হয়ে যায় । অবন্তীর হাতের দিকে তাকিয়েই জিজ্ঞেস করে,
.
—অবন্তী আমি কি তোমার জীবনের প্রথম পুরুষ? নাকি দ্বিতীয়?
.
.
.
চলবে............................