আরশি শুয়ে আছে,পেটে প্রচন্ড ব্যথা।টেস্ট পরীক্ষা চলছে,ভিনা না থাকলে পড়াশোনা আর করা হত না।প্রায় দুই ঘন্টা হয়ে গেছে,ইলেক্ট্রিসিটি নেই।জেনেরেটরের আগে যে লাইন ছিলো,সেটা আর নেই।দুই মাসের বিল জমা হয়ে গিয়েছিলো,পরে বাদ দিতে হয়েছে।পাশের রুম থেকে ওর বড় ভাই ক্রমাগত চিৎকার করে যাচ্ছে,তার পাশে বসে মা কান্না করছে।ব্যথা নিয়েই উঠলো আরশি,চিন্তায় ঘুম আসছে না।নামে মাত্র বাড়ি,বাড়ি ভাড়ার বেশিরভাগ টাকাই তার চাচা নিয়ে যায়।খাবার খরচ ছাড়া আর কোনো খরচ করা যায় না এই টাকায়,অথচ বছর দুই আগেও এক কাপড় দুইবার না পড়ার অভ্যাস ছিলো।কলেজে এটেনডেন্সের অবস্থা খুবই খারাপ।সেটার জরিমানাও জমে গেছে অনেক,মাথা আর কাজ করছে না।কলেজ শেষ করেই বেশিরভাগ দিন সে চলে যায় চাচার এক বন্ধুর বাসায়।সেই লোকের বৃদ্ধ মায়ের দেখাশোনা করে আরশি।দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত।যেদিন বেশি অসুস্থ থাকে,সেদিন আর কলেজে আসা হয় না।এই ধরনের কাজের জন্য দশ হাজার টাকা বেতন অন্য জায়গায় হলেও সে পায় সাড়ে ছয় হাজার টাকা।কারণ সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সে কলেজে থাকে।সেই বৃদ্ধ মহিলার নাম খাইরুন বিবি।স্ট্রোক করার পর থেকে প্রায় তিন বছর ধরে বিছানায় পড়ে আছেন,যাবতীয় কাজ বিছানাতেই করেন।প্রতিদিন আরশি এসে তাকে গা মুছিয়ে খাওয়াইয়ে দিবে,পেশাব পায়খানা পরিষ্কার করবে।কোনোদিন সকালে বিছানা নষ্ট করে রাখলেও খাইরুন বিবিকে দুপুর পর্যন্ত এভাবেই পড়ে থাকতে হয়।তার ছেলের বউ কিংবা অন্য কাজের মানুষ পরিষ্কার করে না।প্রথম দিকে আরশির প্রচন্ড ঘৃণা লাগলেও এখন সয়ে গেছে,বরং মায়া কাজ করে। আরশির চাচার নাম নাসের,তার বন্ধুর নাম মাসুদ।ভদ্রলোক এখনো জানেন না আরশি যে তার বন্ধুর আপন ভাতিজি।জানলে হয়ত এই ধরনের কাজের জন্য রাখতেন না।দুপুর থেকে প্রায় রাত এগারোটা পর্যন্ত তাকে সেখানে থাকতে হয়।ভাগ্য ভালো যে বাসা সামনে,নাহলে কাজ করা হত না আর।আরশির মা জানে না এই কাজের ব্যাপারে।তিনি জানেন আরশি কোথাও কাজ করে,কোথায় করে সেটা জানার প্রয়োজন মনে করেননি, মেয়ের প্রতি অগাধ বিশ্বাস আছে তার।সারাদিন নিজের অসুস্থ ছেলের দেখাশোনা করতেই দিন চলে যায়।এই ছেলেকে নিয়ে কত স্বপ্ন ছিলো তার,কিন্তু এক দূর্ঘটনায় সব এলোমেলো হয়ে গেলো।যে ছেলের সংসারের হাল ধরার কথা,সেই ছেলেকে এখন বাচ্চাদের মত দেখে দেখে রাখতে হয়।মাঝে মাঝে চিন্তা হয়,তিনি না থাকলে তার ছেলের কী হবে।
আরশি এই ব্যাপারে কাউকে কখনো কিছু বলেনি।এসব ব্যাপারে সহজে বলা যায় না।ভিনা অনেক বার জানতে চেয়েছে,কিন্তু জানায়নি সে।দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরশি উঠে দাঁড়ালো।দুপুরের প্রায় বারোটা বাজে।আলমারি থেকে বোরকা বের করার সময় ডান পাশের নিজের গোপন ড্রয়ারটায় চোখ পড়লো।আজকে কী মনে করে যেন অনেক দিন পর সেটা খুললো আরশি।ড্রয়ারে কিছু চুড়ি,টিপ আরেকটা ছবি।ছবিটা হাতে নিতেই বুক ভারী হয়ে এলো।বিশ্বাসই হয় না এই মানুষটার সাথে আড়াই বছর ধরে কোনো যোগাযোগ নেই,হবেও না।যার সাথে এত স্মৃতি জড়িয়ে আছে যে,চাইলেও ভোলা সম্ভব না।মাঝপথে হাত ছেড়ে দিলেও বিন্দুমাত্র ঘৃণা হয় না,কী অদ্ভুত একটা ব্যাপার। বরং ঘৃণা হয় নিজের প্রতি।মাহতাব,নামটা এখনো শুনলে সময়টা থমকে যায়।আজ সব ঠিক থাকলে এই মানুষটার সাথে একি বাসায়,একি ঘরে থাকা হত।চোখের পানি মুছে আরশি ছবিটা রেখে দিয়ে বেরিয়ে গেলো।রাস্তায় বেরোলেও চোখ গুলো সেই চেনা মুখ খোঁজে,আজও সেটার ব্যতিক্রম না।মাহতাবের বাসা বেশি দূরে না।
•
রাত প্রায় একটা,মুনা এক মাগ কফি নিয়ে ভিনার রুমে আসলো।কফির মাগটা টেবিলের পাশে রেখে ভিনার কাঁধে হাত রাখলো।
-আরো রাত জাগবে তাই না?
-উপায় নেই এছাড়া।
-এভাবেই পড়ো,দেখবে অনেক বড় হবে।
-বাবা কোথায়?
-রুমে টিভি দেখছে।
ভিনা একটু খারাপ লাগলো।তার আর মুনার সম্পর্ক ঠিক করতে গিয়ে সোহেল অনেক দূরে সড়ে যাচ্ছে।ছোট থেকে ছোট ব্যাপারে মুনাকে ইনভলভ করছে।এখন মুনা না এসে সোহেল আসলে ভিনার মন আরো ভালো হয়ে যেত।
-তোমার বাবাকে ডেকে আনবো?
-না থাক,এমনি জিজ্ঞেস করেছিলাম।
ভিনার হটাৎ কান্না আসছে।তার বাবার কথা ভেবেই মুনার সাথে স্বাভাবিক একটা সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছে।বিষয়টা এতও সোজা না।প্রতিদিন বিকালে বা রাতে মুনা আর সোহেলকে একসাথে দেখলেই বুক খালি লাগতে থাকে।তবুও মেনে নিতে হবে,কারণ চাইলেও কিছু জিনিস বদলানো যাবে না।তার মা নেই।নানাবাড়ির দিক থেকে কোনো সম্পর্ক নেই।দাদী পুরোনো দিনের মানুষ, এছাড়াও ভিনাকে পছন্দ করে না।বন্ধ্যা মেয়ে বিয়ে করার কারণে ভিনার বাবার সাথে রাগ করে বিয়ের পর আর এ বাসায় ও আসেনি।আত্মীয় স্বজন নেই বললেই চলে।আছে শুধু তার বাবা আর রুপিন।রুপিন দূরে দূরে থাকেই।এখন তার বাবার কিছু হলে এটা সহ্য করা কোনোভাবেই ভিনার পক্ষে সম্ভব হবে না।আবার তার বাবার কাছে আরেকটা মানুষ ইম্পর্ট্যান্স বেশি পাবে,এটা মেনে নেয়াও কষ্টকর।বেশিও না,ভিনার সমান ইম্পরট্যান্স কেউ পাবে,এটাও সে মানতে পারবে না।কিন্তু মুনার প্রতি যাই আছে,এটাকে ভিনার বাবা দায়িত্ব বললেও ভিনার প্রায়ই মনে হয়,এটা শুধু দায়িত্ব না,সামান্য হলেও সেখানে ভালোবাসা আছে।ভয় লাগে,ইন্সিকিউরিটি কাজ করে,যদি কখনো এই ভালোবাসা ভিনার চেয়েও বড় হয়ে দাঁড়ায়?এটা কি তার বাবা হতে দিবে?কে জানে।নিজের সাথে কথা বলতে গেলে শেষ পর্যন্ত অনিশ্চিত কিছু প্রশ্ন সৃষ্টি হয়,যে প্রশ্নগুলো আত্মার শান্তিকে গিলে খায়।ভিনার আবার খারাপ লাগা শুরু হয়েছে,কিন্তু এবার আর যাবির কে ফোন দিলো না।বিগত তিন চার দিন ধরে যাবিরকে এড়িয়ে চলছে।ফোনে যাবিরের শত শত মেসেজ আর মিসকল জমা পড়েছে।অনিচ্ছা সত্ত্বেও জেরিনের কথাগুলো প্রভাব ভিনার উপর পড়েছে।নিজের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে, যাবিরকে অবিশ্বাস ও করতে পারছে না,আবার জেরিনের কথাগুলো ফেলে দিতেও পারছে না।কফি খেয়ে মুখে পানি ঝাপটা দিয়ে পছন্দের দুইটা গান শুনে আবার টেবিলে বসলো ভিনা।নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে।
পরেরদিন পরীক্ষা দিয়ে বের হয়েই সবার সাথে কথায় ব্যস্ত হলো ভিনা।টেস্টের পর কোন স্যারের কাছে ভর্তি হবে,কীভাবে পড়বে সব নিয়ে আলোচনা করছিলো।সাদ পরীক্ষা শেষে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার কথা তুললে ওয়াসিম বেশ রাগ করে মানা করে দিলো,পরে অবশ্য রাজি হয়ে গেলো।কিন্তু ভিনা খেয়াল করলো ওয়াসিম আরশির সাথে কোনো কথা বলছে না।আরশিও বিষয়টা খেয়াল করলো, কষ্ট ও পেলো খানিকটা,কিন্তু কিছু বললো না।ভিনা আইসক্রিম কিনে বাসার দিকে হাঁটতে শুরু করলো।ঠিক তখনি যাবির হাত টান দিয়ে ভিনাকে কফি শপে নিয়ে এলো।
.
.
.
চলবে................................................