—অবন্তী আমি কি তোমার জীবনের প্রথম পুরুষ? নাকি দ্বিতীয়?
.
কথাটা শুনে অবন্তী বেশ চমকে উঠল, শুভ্রর হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল।
.
— মানেটা কি??? কি বলতে চাইছ তুমি???আমি ক্যারেক্টারলেস??
— আশ্চর্য আমি সে কথা বলেছি নাকি? এত রিয়াক্ট এর কি আছে? আমি যা বুঝেছি তাই জিজ্ঞেস করেছি।
— তুমি রিয়েক্ট করার মতো ই কথা বলেছ শুভ্র। এই তোমার হাত দেখা? এতক্ষণ খুটিয়ে খুটিয়ে এই সব বানোয়াট কথা উদ্ধার করলে তুমি তাই না?? সবাই ঠিক ই বলে এসব জ্যোতিষ সাস্ত্র আসলেই ভুয়া ।
— কে বলেছে ভুয়া?
— হ্যা তাই তো । একটা কথা কান খুলে শুনে রাখ শুভ্র আমার জীবনে দ্বিতীয় পুরুষ বলতে কোন অস্তিত্ব নেই । তুমিই প্রথম আর তুমিই শেষ । আমি এবিষয়ে আর কোন ফালতু কথা শুনতে চাই না ।
.
শুভ্র কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলে,
— অবন্তী অনেক ভাঙা গড়ার খেলা আছে তোমার এই হাতের রেখায়। অনেক জটিল তোমার হাতের রেখা।আর জ্যোতিষ সাস্ত্র বিশ্বাস অবিশ্বাস নিজের কাছে । এটাতে সব কিছু স্পষ্ট বোঝা বা বলা যায় না ঠিকই তবে কিছু কিছু আন্দাজ করা যায় ।
— আর কি কি আন্দাজ করলে শুনি?
.
— একটা কথা বলি অবন্তী ,তোমার জীবনে দুজন পুরুষ আসবে।
— ওহ তাই বুঝি?(অবন্তী বিরক্তির সুরে বলে)
— হুম। কিন্তু...দুজন ই...থাক বাদ দাও এসব।আমার ও বোঝার ভুল হতে পারে । আর এসব করে করে নিজের ইমানের তো বারোটা বাজিয়েছি।তোমার ইমান টা নষ্ট করতে চাই না । ভুলে যাও এসব। বিশ্বাস করার দরকার নেই।
.
শুভ্র সেদিন ইচ্ছে করেই কথাটা কাটিয়ে নিয়েছিল। কারণ সে অন্য কিছুর আভাস পেয়ে গেছিল কিছুটা হলেও ।
.
— থেমে গেলে কেন বলো?? এভাবে তাকিয়ে আছ কেন?? শেষ তো তোমার এসব জ্যোতিষী গিরির দৌড়?আমার জীবনে ক'জন আসবে সেটা একমাত্র আমি ঠিক করব বুঝলে? এসব চিন্তা করে তোমার মুখ কালো করে থাকতে হবে না। এসব ভুয়া শুভ্র। আর বাবা মা এখন আমাদের মেনে নিয়েছে। আর কিছুদিন পর আমাদের বিয়ে। এর মধ্যে নতুন কেউ কিভাবে আসবে তুমিই বলো?
.
— জানিনা। বললাম তো বোঝার ভুলও হতে পারে ।
— হ্যা ভুল ই। তুমি এসব হাত টাত আর দেখবে না । ইমান নষ্ট হয়ে যায় এসবে বিশ্বাস করলে শুভ্র।এসবে অনেক পাপ।
.
শুভ্র অবন্তীর চোখে চোখ রেখে শেষে একটা কথাই বলেছিল,
— যা কিছু হয়ে যাবার হোক, জীবনে কখনো হার মানবে না । নিজেকে স্থির রাখবে সব সময় । মনে রাখবে ভাঙা থেকেই নতুন করে গড়ার শুরু হবে ।
.
.
কিন্তু আজ অবন্তী বুঝতে পারছিল শুভ্র সেদিন কোন বানোয়াট কথা বলে নি। ওর ভেতরে ভবিষ্যত বলার আশ্চর্য গুন ছিল।সত্যি তো ব্যাপার টা মিলে গেল। সত্যি তার জীবনে দুজন এলো ।
কিন্তু শুভ্র আরো কিছু বলতে চেয়েছিল আর থেমেও গেছিল। ও বলেছিল "দুজন আসবে। আর দুজন ই.."
কি বোঝাতে চেয়েছিল শুভ্র এটার মানে? "দুজন ই.. " কথাটার অর্থ কি? মানে দুজনের মাঝে কমন কিছু থাকবে? সেটা বোঝাতে চেয়েছে কি শুভ্র? আর কথাটা বলে শুভ্রর মুখ ওমন ফ্যাকাশে ই বা কেন হয়ে গেছিল?
.
.
এদের মধ্যে মিলটা আসলে কোথায়? শুধু নামে? শুভ্রনীল আর অভ্রনীল? অবন্তী নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে । আবার দুজনের মধ্যে মিল খুজতে চেষ্টা করে । চালচলন,চেহারা, গায়ের রং, চুল, চোখ, কন্ঠস্বর,হাসি,রাগ, কথা বলার ধরন , লাইফ স্টাইল...নাহ কোন কিছুতেই কোন মিল নেই দুজনের।
শুভ্র বরাবর ই শান্ত, ধীর, স্থির আর অভ্র অশান্ত, চঞ্চল, অস্থির প্রকৃতির ছেলে।
তবে কিছু না হলেও একটা মিল আছে দুজন ই তার চোখ পছন্দ করে । কেউ কান্না দেখতে কেউ হাসি দেখতে ।
.
"আচ্ছা এ হিসেব যদি ঠিক ধরি তবে শুভ্র তো আগেই বুঝতে পেরেছিল অন্য কেউ আসবে। তাহলে ও এত রিয়েক্ট করল কেন ফোনে সেদিন? নাকি ও এভাবে বোঝাতে চায় আমার অভ্র কেই মেনে নেয়া উচিত "
.
"উফ্ফ্ফ্ফ। অভ্র- শুভ্র। শুভ্র - অভ্র ।অভ্র- শুভ্র।
আমাকে পাগল করে দেবার জন্য এ দুটো নাম ই যথেষ্ট।"
কথাটা বলে অবন্তী আবার নিজের হাতের রেখায় মনযোগ দেয়।
.
.
আজ সকাল থেকেই অবন্তীর মন খারাপ অভ্র অনেক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছে সেটা। সকালে নামাজ পড়ে, কোরান শরীফ পড়ে আবার শুয়ে পড়েছে আজ। আর শুয়ে শুয়ে যে কেদে যাচ্ছে সেটাও অভ্র হালকা গুনুর গুনুর আওয়াজ শুনেই বুঝতে পেরেছে।
অভ্র কিছুতেই বুঝতে পারছে না কি করা উচিত তার । কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। অন্যদিন তো কাদতে কাদতে গালি দেয়,ঝগড়া করে, রাগারাগি করে আজ কিছুই করছে না সেসব এর। অভ্র কথা বলার জন্য আশে পাশে বার বার ঘুর ঘুর করছে, বিছানায় বসছে উঠছে। কিছুতেই কিছু কাজ হচ্ছে না ।
একপর্যায়ে কাপা কাপা হাতে অবন্তীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করল অভ্র। অবন্তীর তাও কোন রেসপন্স ই নেই ।
.
— এই অবন্তী কি হয়েছে তোমার?
এই...
আমি কি কিছু করেছি?
আচ্ছা সরি বলছি। ওঠ এবার । উঠে খেয়ে নাও কিছু । আমার খিদে পেয়েছে তো। আমি এখন তোমাকে ছাড়া খাই না জানো না তুমি? ওঠ ওঠ ।
.
এসবেও কাজ হলো না । অভ্র বুঝতে পেরেছে এভাবে হবে না । অন্য কথা বলতে হবে ।
.
— শুভ্র কে মিস করছ তো?
.
অবন্তী এবার চট করে উঠে পড়ল।
— আপনার মাথায় কি শুভ্র ছাড়া কিছু আসে না সব সময়??
— সেই কখন থেকে জিজেস করছি কি হয়েছে? না বললে আমি কি করে বুঝব?
— কেন আপনি তো সব ই বোঝেন। হাওয়ার বেগে সব জানতে পারেন। আজ কি হলো?
— হ্যা অন্য দিনের মতো তো আজ ও গেজ করেছিলাম । ঠিক হয় নি তো আমি কি করব?
— কিছুই করবেন না ।
— আশ্চর্য কি হয়েছে বলবে তুমি?
— শুনে আপনি কি করবেন? পারবেন আমার মন ভালো করে দিতে?
— বলেই দেখো।আমি সব পারি।
— আমার ভাইয়া কে এনে দিতে পারবেন? আজ আমার ভাইয়ার জন্মদিন।প্রতিবছর এই দিনে আমি ভাইয়া কে নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াতাম। ভাইয়া আমাকে কিছু না কিছু গিফট দিত।আমার ভাইয়া আমার সব কিছু ছিল। আমার সব অন্যায় আবদার ও ভাইয়া মেনে নিত। আজ সেই ভাইয়াকে আমি একনজর দেখতে পর্যন্ত পারছি না । আপনি নাকি সব পারেন। দিন আমার ভাইয়াকে এনে।
.
অভ্র চুপ করে যায় কথাটা শুনে ।
.
— এখন চুপ হয়ে গেলেন কেন? সব সময় অযথা আমাকে বিরক্ত করবেন না আপনি। প্লিজ আমাকে আমার মতো থাকতে দিন। .
.
.
অভ্র পাঞ্জাবি পাজামা পড়ে অজু করে এসে অবন্তী কে তৈরি হয়ে নিতে বলল। ও যেতে না চাইলেও জোর করেই রাজি করাল।
.
— কই যাব আমরা?
— দেখি কোথায় যাওয়া যায় । বিয়ের পর তো তোমাকে নিয়ে বের ও হওয়া হয় নি । চলো একটু বেরোলে মন ভালো লাগবে।
.
.
রাস্তায় বেরিয়ে দুজন হাটছে। অবন্তী হলকা আসমানী রঙের শাড়ি পড়েছে আর অভ্র সাদা ধবধবে পাঞ্জাবি পাজামা।অভ্র অবন্তীর হাত শক্ত করে ধরতে ভোলে নি।
নিয়ে গেলো লোকাল বাস স্টপ এ। অবন্তী লোকাল বাসে তেমন ওঠে নি কোন দিন, অভ্র নিজেও ওঠে নি। কিন্তু আজ উঠতেই হবে । মাসের শেষ ওয়ালেট ফাকা। মাত্র দু'শ পয়ত্রিশ টাকা আছে অভ্রের পকেটে। বাবা এখন খুব সামান্য পকেট মানী দেয় মাসের শুরুতে। বিজনেসে না বসা পর্যন্ত সে টাকা পয়সা, গাড়ি, এটিএম কার্ড কোন সুবিধা ই পাবে না বাবা কড়া ভাবে বলে দিয়েছে। পাসপোর্ট,ড্রাইভিং লাইসেন্স ও বাবার কাছে । এদিকে বাবার চোখে সে এখনো ইমম্যাচিউর রিসেপশনের দিনে অর্নির ওপর রাগ করে ওমন একটা কান্ড করায় ।
.
.
বাসে কোন মতো একটা সিট ম্যানেজ করে অবন্তী কে বসিয়ে দিল আর নিজে দেয়াল হয়ে এমন ভাবে দাড়িয়ে থাকল যেন অবন্তী কে কেউ ধাক্কা তো দূরের কথা টাচ ও করতে না পারে । আশে পাশের মানুষের ঘামের গন্ধে অভ্র বার বার বমি করার জন্য উকি পারছে। আর পকেট থেকে আতর বের করে নিজের গায়ে আর সামনের মানুষ গুলোর পিঠে স্প্রে করছে । অজু করে এসেছে তাই পারফিউম ইউজ করতে পারছে না ।
আর অবন্তী সেসব কান্ড না হেসে পারছেই না ।
.
.
বাস থেকে নেমে কিছুদূর হেটে গোরস্থানের সামনে নিয়ে গেলো অভ্র ওকে। দূর থেকে ইশারা করে কোনটা বাবা,মা আর ভাইয়ের কবর দেখিয়ে দিল।
অবন্তী কে গেটের সামনে দাড়িয়ে রেখে নিজে গেল কবর গুলো জিয়ারত করতে।
অবন্তী স্পষ্ট ভাবে দেখতে পাচ্ছে কি মনোযোগ দিয়ে কবর গুলো জিয়ারত করছে অভ্র। মনে হচ্ছে ওর ই আপনজন।
অবন্তীর কেন যেন আজ মানুষ টার ওপর খুব শ্রদ্ধা হচ্ছে। খুব বেশি শ্রদ্ধা। চোখ দিয়ে টপ টপ করে নিজের অজান্তেই পানি পড়ছে ।
.
.
— আচ্ছা আমি মারা গেলেও তুমি এভাবে কাদবে?এভাবেই সুন্দর করে?
.
অভ্র জিয়ারত শেষে অবন্তীর কাছে এসে ফিসফিস করে বলে।
.
—উফ্ফ। অভ্র আপনি সব সময় এমন বাজে বাজে কথা বলবেন না । সব কিছু নিয়ে ফান করা উচিত নয় ।
— বাবাহ এত ভয় পেতে শুরু করেছ আমার বাচা মরা নিয়ে?
— চুপ। বললাম তো আর বলবেন না ।
— আচ্ছা ।
— হুম।আপনি জানলেন কি করে এখানে আর এগুলো ই আমার বাবা মা দের কবর?
— এসেছিলাম যে কবর দিতে।
— আপনি?
— হুম। ঐ তো তোমার বাবা মা যেদিন মারা গেল সেদিন বাবার সাথে গেছিলাম তোমাদের বাড়ি একটা কাজে । তো সেখান থেকেই এসেছিলাম। সেদিন ই তো তোমাকে প্রথম দেখেছিলাম। কি কান্না করছিলে তুমি।
— ওহ । আপনাদের কি কাজ ছিল?
— ঐ....বিজনেস ব্যাপারেই। তোমার চাচা পলিটিশিয়ান তো ঐ ... ঐ সব ব্যাপার ম্যানেজ করতেই। বিজনেসে তো সব দিক কভার করেই চলতে হয় ।
— ওহ ।
.
.
ফেরার জন্য যে ক'টাকা লাগবে অভ্র হিসেব করে রেখে দিয়ে বাকি টাকা গোরস্থানের মসজিদের দান বাক্সে দান করে দিল। সামনে মাসে বাবা টাকা দিলে আরো কিছু টাকা এসে দিয়ে যাবে মনে মনে তাই সিদ্ধান্ত নিল।
ফেরার পথে বাসের একদম শেষ সিটে দুজন বসে বাড়ি ফিরল। তবে অবন্তী এবার বেশ খুশি, তা দেখে অভ্র ও মনের কোন কোনে প্রশান্তি খুজে পেল।
.
.
গত দু তিন ধরে অভ্র শুধু মাথা ব্যাথা মাথা ব্যাথা করেই যাচ্ছে। সারাদিন শুয়ে বসে থাকে । কিন্ত আজ আর উঠতেই পারছে না মাথা তুলে বিছানা ছেড়ে । চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে । বালিশের নিচে মাথা দিয়ে সকাল থেকে শুয়ে আছে । দুপুরে খাবার খেয়ে বমি ও করেছে।
.
অবন্তীর এসব মোটেও ভালো ঠেকছে না ।। অভ্র ডক্টর ও দেখাতে চাইছে না ।
সকালের পর থেকে মানুষ টা তেমন কিছু খেতেও পারছে না । দুপুরে একটু খেয়ে তা ও বমি করে দিল। অভ্র আপেল খেতে খুব ভালোবাসে। খরগোশ যেভাবে গাজর খায়,আপেল খাবার সময় অভ্র কেও অবন্তীর খরগোশ বলে মনে হয় । রোজ রোজ তার আপেল ছাড়া চলেই না ।
অবন্তী আপেল নিয়ে এসে অভ্রর দুহাতে দুটো ধরিয়ে দিল। অন্তত এগুলো ই খাক। অভ্র'র স্বভাব ই দু হাতে একসাথে দুটো আপেল নিয়ে খাওয়া। কিছুটা খাবার পর সেগুলো ও গড় গড় করে বমি করে দিল।
ওয়াশরুম থেকে বমি করে বিছানা পর্যন্ত আসতেই অভ্র অবন্তীর গায়ের ওপর ধীরে ধীরে যেন ঢুলে পড়ল।
সেন্সলেস হয়ে গেছে । ডক্টর এসে চেক আপ করছে।
.
শুভ্র'র বলা আর একটা কথা মনে পড়ে গেল অবন্তীর।
" ভাঙা থেকেই গড়ার শুরু"
প্রথম বার তো সব কিছু ভাঙার পর ,বাবা মা হারানোর পর অভ্র এসেছিল কিছুটা হলেও সব কিছু দিতে। কিন্তু আবার কি কিছু ভাঙবে?
অজানা ভয়ে নিজেই কেপে ওঠে অবন্তী।
.
.
.
চলবে........................