অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ৪৩ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


ভালো সময় চোখের পলকে পার হয়ে যায়,রুপিনের সাথে সাথে ভিনার তিনদিন ও পার হয়ে গেলো।এই তিনদিনে দুইজন মিলে ঘুরতে গিয়েছে,শপিং করেছে,একসাথে রান্না করেছে আর জীবনের গল্প বলেছে।তিনদিনের মাত্র একদিনই সোহেল ফোন দিয়ে খোঁজ নিয়েছিলো,বিষয়টা ভিনার খারাপ লাগলেও,রুপিনের কথার উপর ভিত্তি করে সেটাকে আর বাড়ায়নি।নানা কাজে ব্যস্ত থাকলেও অস্থিরতা ঠিকি কাজ করেছে ভিনার মধ্যে।ভাঙ্গা সম্পর্ক নিয়ে জীবন চালানো সহজ না। আজকে বিকেলের মধ্যেই এসে পড়বে সোহেল আর মুনা।রাতে রুপিন চলে যাবে।

-আজকের রাতটা থেকে যাও প্লিজ।আজকে আমি বাবার সাথে কথা বলবো,তুমি থাকলে,আমার জন্য বিষয়টা হ্যান্ডেল করা সহজ হবে।

-তুই যথেষ্ট বড় হয়েছিস।শিউলি যাওয়ার পর থেকেই নিজেকে সামলাচ্ছিস।এখন আবার আমাকে লাগছে কেন?

-এটাকে সামলানো বলে?আমার পুরো লাইফ এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলো।কলেজে যদি ও.... 

-কলেজে কী?

-মানে... আসলে আমার ফ্রেন্ডরা। অনেক ভালো ওরা,অনেক হেল্পফুল।

-প্রেম করিস?

ভিনা থতমত খেলো। রুপিনের সাথে সম্পর্ক যদিও খুব ভালো,কিন্তু যাবিরের বিষয়টা এখনি জানাতে চাচ্ছে না।ভার্সিটিতে উঠে ঠিক সময় বুঝে জানিয়ে দিলেই সবচেয়ে ভালো হবে।তাই পরিস্থিতি সামলিয়ে নিয়ে কথা ঘুরালো

-প্রেম?আর আমি?তোমার কী মনে হয়,আমাকে দেখে কোনো ছেলের মনে এসব আসবে?

-না আসার কারণ নেই। সত্যি করে বল,কয়টা প্রপোজাল পেয়েছিস?

-সত্যি পাইনি।পেলে সবার আগে তোমাকেই জানাতাম আমি।

-আচ্ছা?চালাক হয়ে গেছিস।কম্বাইন্ড কলেজে কোনো ছেলে তোকে পছন্দ করে নি,এটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলছিস?

-হ্যাঁ কারণ এটাই সত্যি।আমি এসব নিয়ে ভাবিও নি,নাহলে কষ্ট লাগত।

- হায়রে পাগলি!জানিস,তোকে অনেক মিস করবো আমি।

-তুমি আবার কোথাও যাচ্ছো?

-না....কিন্তু খেয়াল করলাম যে এখনো মুনা আমার যাওয়া আসা করা পছন্দ করে না।

-সে থার্ড পার্সন এখানে।তুমি তাকে প্রায়োরিটি দিচ্ছো,কিন্তু আমি থাকতে বলি,সেটা করো না।

-আরো বড় হ।জীবন একটু জটিলই হয়। 

-আমি জানি, কম জটিলতা আমি দেখিনি। কিন্তু আপন মানুষের চেয়ে অন্যকে কখনো প্রায়োরিটি দেয়া উচিৎ না।কখনো না।

-সোহেলের বিষয়টা এখনো ভাবছিস।এইত কিছুক্ষণ পরই ওরা এসে যাবে।মন খুলে কথা বলে নিস তখন।

সাড়ে পাঁচটার দিকে সোহেল আর মুনা এসে পৌছাল। ভিনা দরজা খুলেই সোহেলকে জড়িয়ে ধরলো।অভিমান আর অভিযোগে চোখ ভরে উঠেছে।

-তুই কাঁদছিস?কী হয়েছে?

-তোমাকে মনে পড়ছিলো বাবা।

-গেলি না কেন তাহলে আমাদের সাথে?

-তুমি বুঝবা না।

মেয়ের এই আহ্লাদে সোহেলের পুরোনো দিনের কথা মনে পড়লো।কতদিন পর ভিনা এইভাবে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরেছে সোহেলকে।যেই মেয়ে এখনো অভিমান করে কান্না করে,সেই মেয়ের উপর রাগ করে কী বোকামি করেছে সেটা ভাবতেই সোহেলের খারাপ লাগলো।

মুনা ভেবেছিলো ভিনা এখনো অভিমান করে বসে থাকবে, কারণ সে সোহেলকে খুব বেশি খোঁজ খবর নিতে দেয়নি।কিন্তু ভিনার এই আচরণে সে নিজেই অবাক হয়েছে।এরকম কিছু হবে,সেটা মোটেও আশা করেনি মুনা।

-বাচ্চাই রয়ে গেলে ভিনা।এত যখন মন খারাপ ছিলো ফোন দিতে বাবাকে।যাই হোক,ফ্রেশ হয়ে নেই,এরপর ব্যাগ থেকে গিফট বের করবো সব।

সোহেল রুপিনের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে উপরে ফ্রেশ হতে চলে গেলো।রুপিন ভিনার পাশে এসে দাঁড়ালো,

-সব ঠিক হয়ে যাবে দেখিস।

-বাবাকে আমি অনেক ভালোবাসি আন্টি। বাবা আমার হাত ছেড়ে দিলে,আমি শেষ হয়ে যাবো।

রুপিনের ভেতরটা হটাৎ ভার হয়ে গেলো।একটা সময় ছিলো,যখন নিজের বাবার জন্য ও এভাবে কান্না করত।জীবনে কখনো তার বাবা কষ্ট পাবে,এমন কাজ করেনি।কিন্তু অনিচ্ছাকৃত হলেও রুপিনের জন্যই তার বাবা মারা গিয়েছিলো।

সোহেল আর মুনা খাবার শেষে ব্যাগ থেকে সব গিফটগুলো বের করলো। রুপিনের জন্য সোহেল বেশ সুন্দর পাথরের জুয়েলারি এনেছে।ভিনার জন্য ব্যাগ,কানের দুল আর শোপিস।এছাড়াও হ্যান্ডমেড সোপ, আর কিছু কসমেটিকস এনেছে।

-এত কিছু আনলে কেন মুনা?

-ভালো লাগেনি?

-অনেক ভালো লেগেছে।আমার জুয়েলারির শখ আছে,আর এরকম এন্টিক স্টোনের হলে তো কথাই নেই। আমার খুব পছন্দ হয়েছে। 

মুনা খুব কষ্টে নিজের রাগ দমিয়ে গিফটগুলো দিলো।সোহেলকে মানা করেছিলো এগুলো কিনতে,কিন্তু সোহেল সবার জন্যই দামী সব জিনিস এনেছে।গিফট দেয়া শেষ হলে সোহেল সবাইকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে বসতে বললো।রুপিন তখনি বললো-

-আজকে আর না।অনেক কাজ বাকী পরে আছে।তোহা একা সামলাতে পারবে না।আমি আসি আজকে।

-রাতে খেয়ে যেতে।

-আসবো আরেকদিন।আজকে জার্নি করে এসেছো তোমরা।ঝামেলা করোনা কোনো।

ভিনা অপেক্ষা করছিলো কখন সোহেল ফ্রি হবে।ভিনার এই অস্থিরতা মুনার নজর এড়ায়নি।সে ভালোমতই বুঝতে পারছে যে রুপিন ভিনাকে বুঝিয়েছে কিছু।রুপিন যাওয়ার পরপর যখন ভিনা সোহেলকে নিজের রুমে ডাকলো তখন মুনা নিশ্চিত হলো এই ব্যাপারে।

-সোহেল তো ক্লান্ত,কালকে কথা বলো ভিনা।(মুনা)

- থাক না।কথাই তো বলবো।পরে রেস্ট নেয়া যাবে।(সোহেল)

-খুব বেশি জরুরি কথা?(মুনা)

-না মানে,এমনিই কথা বলতাম (ভিনা)

- যেই কথাই হোক,আমি শুনবো।তুমি রেস্ট নিতে যাও মুনা (সোহেল)

মুনার ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।যদি ভিনা বলে দেয় যে ট্যুরে যাওয়ার ব্যাপারটা মুনাই অন্যভাবে উপস্থাপন করেছিলো,সোহেল ওকে আর নিজের জীবনে রাখবে না।গত তিন দিন মুনার জীবনের পরিপূর্ণতা ছিলো।ভিনার ব্যাপারে নেতিবাচক কথা,নিজের জীবনের দুঃখ এসব বলে সোহেলের কাছ থেকে সিম্প্যাথি পেয়েছে।সিম্প্যাথির জন্যই হোক,বা যে কারণেই হোক,এই তিনদিন সোহেল বিনা দ্বিধায় মুনাকে স্ত্রীর অধিকার দিয়েছে,যতবার মুনা চেয়েছে।ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে মুনা ভুলেই গিয়েছিলো এ বাড়িতে আবার ফেরত আসতে হবে,যেখানে ভিনা আছে।তার চেয়েও বড় কথা,যেটা ধারণার বাইরে ছিলো,সেটা হলো ভিনার সোহেলের প্রতি রাগ ভেঙে সব ঠিক করতে চাওয়া।ভিনা রুমে চলে যাওয়ার পরই মুনা পায়চারি করতে লাগলো বাইরে।

- এই তিনদিন কোনো সমস্যা হয়নি তো তোর?

-না বাবা,রুপিন আন্টি সব খেয়াল রেখেছে।আর মোমেনা খালা তো ছিলোই।

-আচ্ছা বল তো,তুই কেন গেলি না আমাদের সাথে?

ভিনা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো।পুরো ব্যাপারটা কীভাবে বুঝিয়ে বলবে সেটা ঠিক করে নিলো।

-আসলে আমি তোমাদের মাঝে থার্ড পার্সন হতে চাইনি।

-কাদের মাঝে?কিসের কী?

-তোমার আর মার মাঝে।

-সন্তান কি কখনো বাবা মায়ের মাঝে থার্ড পার্সন হয়?সন্তানকে কেন্দ্র করেই তো বাবা মার জীবন।এসব আজগুবি চিন্তা কোথা থেকে তোর মাথায় আসে বল তো।

ভিনার চোখে পানি এসে যাচ্ছে।ধরা গলায় বললো-

-বাবা,আমি কি খুব ইম্যাচিউর?তোমাকে খুব জ্বালাই?

সোহেল মেয়ের দিকে ভালোমত তাকালো।কী এমন হয়েছে যে এত কষ্ট নিয়ে কথা বলছে ভিনা?

-কী হয়েছে...

কথা শেষের আগেই চিৎকারের আওয়াজ পাওয়া গেলো।সোহেল আর ভিনা তড়িঘড়ি করে বাইরে এসে দেখে মুনা রাগে লাল হয়ে আছে।

-কী হয়েছে মুনা?

-আমি আমার পার্স আর সোনার আংটি পাচ্ছি না।ওয়াশরুমে যাওয়ার আগে বিছানায় খুলে রেখেছিলাম।

-হয়ত ভুলে গেছো,আশেপাশে দেখো।

-আমি ভুলিনি।আমার স্পষ্ট মনে আছে,আমি এখানেই রেখেছিলাম।

-শান্ত হও,আমরা সবাই মিলে খুঁজি চলো।

-কেন খুঁজবো?তুমি বুঝতে পারছো না?আমার জিনিসগুলো চুরি হয়েছে।

-বাসায় আমরা তিনজন আছি,কে চুরি করবে?

-তিনজন কে বলেছে,মোমেনা আছে না।

ভিনা অবাক হয়ে মুনার দিকে তাকালো।মোমেনা প্রায় দুই বছর ধরে এখানে কাজ করছে।কখনো এধরনের কিছু চোখে পড়েনি।কীভাবে হুট করে একটা মানুষের নামে চুরির অভিযোগ দেয়া হচ্ছে দেখে ভিনার বেশ খারাপ লাগলো।

-মোমেনা খালা এমন না,হয়ত কোথাও ভুল হচ্ছে।বাসায় এর আগে উনাকে রেখে যাওয়া হয়েছে,কখনো কিছু হয়নি।

-ভিনা তুমি ছোট তাই এই ব্যাপারে কিছু বলো না।ছোটলোকদের স্বভাব তো তুমি জানো না।সামান্য টাকা পয়সা দেখলেই এদের লালা পড়তে থাকে।

-থামো মুনা।অযথাই কথা বাড়িয়ো না,ডাকো মোমেনা কে।

-আগেই তো চলে গেছে।চুরি করে কেউ ধরা খাওয়ার জন্য বসে থাকে?

সোহেল চিন্তায় পড়ে গেলো।ধরবে না জেনেও সোহেল মোমেনাকে ফোন দিলো,আশ্চর্যজনকভাবে,মোমেনা ফোন ধরলোও।বেশি কথা না বলে সোজা বাসায় আসতে বলা হলো তাকে। 

বাসায় আসা মাত্রই মুনা তেড়ে মারতে গেলো মোমেনা কে।মোমেনা ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুই বুঝতে পারলো না।অনেক জেরা করার পর ও যখন মোমেনা স্বীকার করলো না কিছু,তখন মুনা হুমকি দিলো পুলিশ ডাকার।

-গরিব মানুষ রে এমনে ফাঁসায়ে কী পান আপনেরা।আমি ক্যান চুরি করতে যামু?

-তাহলে আগে চলে গিয়েছিলে কেন?(সোহেল)

-আপাই...

-কী আপা?চুরি করে আমার নামে দোষ চাপাস?এত সাহস তোর?

অনেক চিৎকার চেচামেচির পর অবশেষে পার্স আর সোনার আংটি মুনার বিছানার পাশের ওয়ার্ডরোবের নিচে পাওয়া গেলো।
 
মোমেনা অপমানে কাঁদছিলো।কিন্তু মুনা সেখানে কোনো ভ্রুক্ষেপ করলো না।জিনিস নিয়ে রুম আটকিয়ে দিলো।ভিনা যেয়ে মোমেনাকে বুঝালো যেন কাজ ছেড়ে না যায়।পেটের দায়ে পড়েই এতকিছুর পর ও মোমেনা কাজ ছাড়লো না,কিন্তু মুনার জন্য ভেতর থেকে অভিশাপ দিলো।
সে রাতে আর সোহেলের সাথে কথা হয়নি ভিনার।কেন যেন মনে হচ্ছে মুনা ইচ্ছা করেই এ ধরনের সিন ক্রিয়েট করেছে।ভিনা ভেবে পাচ্ছে না মুনা কেন এমন করবে।সোহেল মুনার সব ধরনের চাওয়া পাওয়া পূরণ করেছে।তাহলে এসব করার মানে কী?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভিনা মোবাইল হাতে নিলো,যেখানে যাবিরের অসংখ্য মেসেজ জমা হয়ে আছে...
.
.
.
চলবে.............................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন