-জেরিন তাহলে জিতেই গেলো,তাই না ভিনা?
-এসব কী যাবির,এটা কোনো ম্যানার?
-ম্যানারের কথা এখন আমাকে বলবা না।গত তিনদিন ধরে পাগলের মত তোমার সাথে কন্ট্যাক্টের চেষ্টা করছি,অথচ তুমি পাত্তাই দিচ্ছো না।
-তোমার টানাটানিতে আমার আইসক্রিম পড়ে গেলো,ধ্যাৎ!
-এই চেয়ারে বসো,কথা আছে তোমার সাথে আমার।
যাবির দুটো কফির অর্ডার দিয়ে ভিনাকে নিয়ে কোণার একটা টেবিলে বসলো।ভিনা বিরক্তি নিয়ে বারবার ঘড়ি দেখছে।
-এদিকে তাকাও,বলো কী হয়েছে, তোমার সাথে কন্ট্যাক্ট করা যাচ্ছে না কেন?
-আমার এক্সাম চলছে তুমি জানো না?
-আচ্ছা?পড়াশোনা আমরা করিনি?দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা পড়ো তুমি?
-হ্যাঁ পড়ি,কোনো সমস্যা?
-এত পড়ো?আমি তো সাইন্সে পড়েও এত ঘন্টা পড়িনি।
-শাট আপ যাবির!এত মিন কেন তুমি?সাইন্সে পড়ে আর্টসের মেয়ের সাথে কথা বলতে সমস্যা হলে এখানে এসেছো কেন?আমি বলেছি আসতে?
-স্যরি,আমি সেভাবে বলিনি কথা।
-সেভাবেই বলেছো।সম্পর্ক কেন চাচ্ছিলাম না এখন বুঝতে পারছো তো?
-তুমি আমাকে ভুল বুঝছো ভিনা।প্লিজ শান্ত হও।
-আমি শান্তই আছি।তুমি আগে আমাকে বলোনি জেরিনের কথা।তোমার আগেই জানানো উচিৎ ছিলো,যখন তুমি ওর টিউশনি করতে। জানালে কখন?যখন ও নিজে এসেছে আমার কাছে।
-আমি ঝামেলা চাইনি কোনো।আমার তরফ থেকে তো কিছুই ছিলো না।থাকলে নিশ্চয়ই টিউশনি ছাড়তাম না আমি।
-কেন ছেড়েছো সেটা তুমিই ভালো জানো।আমি এখন এ বিষয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না।আমি বাসায় যাবো।
-আমাকে সন্দেহ করছো তুমি?
-না.....
-তাহলে আমাকে কিসের শাস্তি দিচ্ছো?
-শাস্তি!
-ছেলেরা সহজে সবকিছু এক্সপ্রেস করতে পারে না।ক্লাসে,ঘুমানোর সময় সবজায়গায় মোবাইল নিয়ে যাই এইভেবে যে তুমি এই মনে হয় কল দিলে।ইভেন ওয়াশরুমেও আমি নিয়ে যাই!
-আমি বলেছি অপেক্ষা করতে?
-এত রুড কেন ভিনা?আমি কী করেছি?
-কিছু না,আমি বাসায় যাবো।
-কফিটা অন্তত খেয়ে যাও।আই রিকোয়েস্ট।
ভিনা কোনো কথা না বলে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে।কোনো কিছুই ভালো লাগছে না।কিছুক্ষণ পরে যাবিরের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলো।যাবির মাথা নিচু করে আছে,অনেক কষ্টে চোখের পানিটা আটকে রাখার চেষ্টা করছে। ভাবতেও অবাক লাগছে,চব্বিশ বছরের একটা ছেলে নিজের চোখের পানির সাথে যুদ্ধ করছে।ওয়েটার কফি দিয়ে যেতেই ভিনা একটা কাপ এগিয়ে দিলো।
-কফি নাও।
যাবিরের চোখ লাল হয়ে আছে।ভিনার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে।
-থার্ড পার্সনের জন্য আমাকে অবিশ্বাস করলে ভিনা?শেষ পর্যন্ত আমার ভয়ই তাহলে সত্যি হলো?
-আমাকে একটু সময় দাও,প্লিজ!
-আর কত সময়?
-আমি জানি না।
যাবির বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে কফির কাপে চুমুক দিলো।গত তিনদিন যে কী মানসিক অশান্তিতে ছিলো,সেটা সেই জানে।দিন নেই রাত নেই,মোবাইল চেক করত।ভিতরের ভয় কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিলো ওকে।ভিনাকে ছাড়া এক মুহূর্ত চলে না এখন।কখনো ভিনা ওর জীবন থেকে সড়ে গেলে,সহ্য করতে পারবে না সে।নিজের আত্মসম্মান,ব্যক্তিত্ব সব তুচ্ছ হয়ে গেছে এমন।ভালোবাসা আসলে একধরনের অসহায়ত্ব।
কফি শেষ হওয়ার পর ভিনা বুঝতে পারছিলো না কী বলবে।এই ধরনের সিচুয়েশন আগে কখনো সে ফেস করেনি।ধারণার বাইরে ছিলো যে যাবির এমন করবে।
-আমি উঠি যাবির।
-আমাকে প্লিজ এভাবে ফেলে যেও না ভিনা।আমি শেষ হয়ে যাবো। সত্যিই শেষ হয়ে যাবো।অন্তত তৃতীয় পক্ষের কারো জন্য আমাকে এভাবে কষ্ট দিও না।
-এসব ঢং ছাড়ো,যে থাকার সে এমনিই থাকবে।
শেষের কথাটা বলার সাথে সাথে ভিনা মুখ ঘুরিয়ে ফেললো।কোনোভাবেই নিজেকে এভাবে প্রকাশ করার ইচ্ছা ছিলো না।খুবই ইতস্তত লাগছে ওর।দুম করে উঠে দাঁড়িয়ে ব্যাগ হাতে নিলো ।যাবির আবার হাত ধরে ফেললো
-সাবধানে দৌড় দিও,পরীক্ষা চলছে কিন্তু।
ভিনা একবার চোখ রাঙিয়ে সত্যিই দৌড় দিলো।ছেলেটা একটা অসভ্য!
•
মুনা দুপুরের ভাতঘুম থেকে উঠে দেখলো সোহেল এসেছে।
-বাহ্,আজকে বেশ জলদিই এসে পড়েছো।
-হ্যাঁ, প্রচুর প্রেশার গেছে লাস্ট কয়দিন,আর ভালো লাগছে না।
-হাত মুখ ধুয়ে নাও,আমি খাবার দিচ্ছি টেবিলে।
-না,এখন খাবো না,ক্ষিদা নেই।
-কী ব্যাপার?আপসেট মনে হচ্ছে।
-আপসেট না,ভিনার ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।আগে বাইরে থেকে আসলেই দৌড়ে এসে কোলে উঠত।বাসা তখন দুই রুমের ছিলো,কিন্তু মেয়েটাকে কোলে নিয়ে এত শান্তি লাগত!এখন বাসাও বড় হয়েছে,মেয়েও বড় হয়েছে,আগের মত এখন আর কারো মাঝে সেই শান্তিটা পাই না।
-আমাদের আজকে একটা বাচ্চা থাকলে কত ভালো হত তাই না?
-কখনো না।আমি তোমাকে বিয়ে করেছি কিসের জন্য তুমি ভালোমত জানো মুনা।আমার একটা বাচ্চা আছে,সেটা নিয়েই আমি খুশি।তুমিও খুশি হও।
-এভাবে কেন বলছো?আজকে যদি সত্যিই আমার পেটে বাচ্চা আসত,তাহলে?
-অবাস্তব কথা বলে লাভ আছে মুনা?যেটা হবে না সেটা নিয়ে বেশি ঘাটাঘাটি না করাই ভালো না?
-এখনো দায়িত্বই রয়ে গেলাম তোমার...
-টাওয়াল টা দাও,আমি ফ্রেশ হয়ে একটু ঘুমাবো।
মুনা কথা বাড়ালো না।চুপচাপ টাওয়াল দিয়ে চলে আসলো।বুক ফেঁটে কান্না আসছে।কিন্তু কিছু করার নেই।যা পেয়েছে,এ নিয়েও যদি খুশি না হয়,তাহলে পাপই হবে।বাইরে থেকে যে কেউ দেখলেই বলবে,ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও মুনার ভালো জায়গায় বিয়ে হয়েছে।হাজবেন্ডের দ্বিতীয় বিয়ে আর আগের ঘরে বাচ্চা আছে,তাতে কী।বড় ফ্ল্যাটে থাকছে,গাড়ি নিয়ে ঘুরছে,কিছুদিনের মধ্যে নিজের বিজনেস ও শুরু করবে,আর কী লাগে।কিন্তু কে জানবে এই 'আর কী' টাই তার জীবনের সবচেয়ে বড় চাওয়া ছিলো।
•
ঠোঁটের এক পাশ কেটে রক্ত পড়ছে আরশির। ঘরের এক কোণায় বসে ফুপিয়ে কাঁদছে।কিছুক্ষণ আগেই তার চাচা নাসের এসে জানিয়েছে,কোন এক মধ্যবয়স্ক ব্যবসায়ীর সাথে আরশির বিয়ে ঠিক করেছে সে।আরশির মা খোদেজা প্রতিবাদ করলেও কোনো লাভ হয়নি,দেবরের কাছে অকথ্য ভাষার গালি শুনতে হয়েছে তাকে।মায়ের অপমান কোনো মেয়ে সহ্য করতে পারে না,আরশিও পারেনি।
-মুখ সামলে কথা বলেন চাচাজান।আমার আম্মাকে এসব কথা সাহস কোথা থেকে পেলেন?
এক মুহূর্ত দেরী হয়নি সেই চাচার আরশির গায়ে হাত তুলতে।সদ্য তরুণী হওয়া কোনো মেয়ের এভাবে মার অবশ্যই অনেক অপমানজনক ব্যপার।খোদেজা থামাতে গিয়ে নিজেও ব্যথা পেয়েছেন।ইশমাম,আরশির ভাই,মানসিকভাবে অসুস্থ থাকলেও ঠিকি বুঝতে পেরেছে যে বোনের সাথে অন্যায় হচ্ছে।চাচার হাতে তাই কামড় বসিয়েছে সুযোগমত।
-কুত্তার বাচ্চা!আমার হাত কামড়াস!শালার পাগলার বাচ্চা!
-আমি পাগল না,পাগল না,পাগল না,পাগল না।মা বলো আমি পাগল?বলো না কেন?আরশিরে মারে কেন এই লোক,কেন মারে?কেন মারে,কেন মারে?মারবে কেন বলো।
-শুয়োর বাচ্চা!সেয়ানা মাইয়া রে তুই খাওয়াবি খানকির পোলা?দুইদিন পরে যখন দুইনিয়ার মাইনষেরে শরীর দিয়া বেড়াইবো,তখন তুই দেইখ্যা রাখবি?
অনেক তর্ক-বিতর্কের পর অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো,ইন্টার পরীক্ষার পর আরশির বিয়ে হবে।পরীক্ষা পর্যন্ত বিয়ে নিয়ে কোনো কথা উঠবে না।খোদেজা রীতিমতো পা ধরে এই কথায় রাজি করিয়েছে নাসের কে।জীবনে কখনো কল্পনাও করেননি,এই সিচুয়েশনে পড়তে হবে।নিজের আদরের মেয়েকে এভাবে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিতে হবে।চোখের পানি মুছে উঠে দাঁড়ালেন,ছেলেকে ঔষধ দিতে চলে গেলেন,মেয়েকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা খোদেজার কাছে নেই।
.
.
.
চলবে.................................................