-জেরিন,থাপ্পড় মেরে সব দাঁত ফেলায় দিবো!অসভ্য মেয়ে,জ্বালায় মারলো আমাকে!
খুরশিদ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে যাচ্ছেন।সেই সকাল থেকে জেরিন দরজা বন্ধ করে রেখেছে,এখন বিকাল পার হয়ে সন্ধ্যা প্রায়।ভেতর থেকে হালকা শব্দ পাওয়া যাচ্ছে,তার মানে মরেনি।খুরশিদ তার ইহজীবনের সব গালি একদিনে দিয়ে ফেলেছেন,কোনো লাভ হয়নি।
জেরিন ব্লেড হাতে নিয়ে বসে আছে।সাহস হচ্ছে না হাতে পোচ দেয়ার।ওর বান্ধবী সারা মেডিকেলে পড়ছে,এ্যপ্রোন পড়ে গতকাল ছবি আপ্লোড করেছে ফেসবুকে।ভেতর টা এলোমেলো হয়ে গেছে তখনই।মেডিকেল ও গেলো,যাবির ও।এর উপর জুটেছে ওর মায়ের দিনরাত হা হুতাশ আর খোঁচা মারা কথাবার্তা। এতকিছু আর সহ্য করতে পারছে না। হাতের রগগুলো ফুটে আছে।সাহস করে ব্লেড দিয়ে একটা ঘষা মারলেই হবে,কিন্তু সাহস জোগাতেই অনন্তকাল লেগে যাচ্ছে।
-কী রে, তুই দরজা খুলবি না?দরজা ভেঙ্গে ফেলবো কিন্তু আমি,তোর বাপ রে বলে দরজার ছিটকিনি সব খুলে ফেলবো।দরজা খোল শয়তানের বাচ্চা।
জেরিন পারলো না।ব্লেড তুলে রাখলো ড্রয়ারে।এভাবে হার মানবে না।শেষ একটা চেষ্টা করবেই।মেডিকেল যেহেতু ছুটেই গেছে,যাবিরকে তাহলে হারাতে দিতে পারবে না।আস্তে করে উঠে দরজা খুলে দিলো জেরিন।খোলামাত্র খুরশিদ প্রায় উড়ে এসে রীতিমত ঠাটিয়ে চড় মারা শুরু করলেন।চড় পর্ব শেষ করে ঘাড় ধরে খাবারের টেবিলে বসালেন জেরিন কে।
-চুপচাপ খেয়ে আমার রুমে যাবি।তোর রুমের ছিটকিনি না খোলা পর্যন্ত ঐ রুমে ঢুকবি না।ঘাড় ত্যাড়ামি আবার যদি করিস,লুলা বানায়ে ঘরে বসায়ে রাখবো।প্রেম একেবারে উৎলায়ে উঠেছে না?সেইদিনের পিচ্চি মেয়ে,প্রেমের জ্বালায় বাঁচে না!
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে জেরিনের মাথায় আবার চাটি মেরে খুরশিদ নিজের ঘরে চলে গেলেন।যেয়েই তার হাজবেন্ডকে ফোন দিলেন।
-আসার সময় মিস্ত্রী নিয়ে আসবা।মনে থাকে যেন।তোমার মেয়ে বেশি ফাইযলামি শুরু করেছে।
•
ইদানিং মুনার সাথে সম্পর্ক আবার খারাপ যাচ্ছে সোহেলের।সেদিন দুপুরের পর থেকে মুনা ঠিকভাবে কথা বলছে না।সোহেল নিজেও বুঝতে পারছে যে বলার ভঙ্গী ঠিক ছিলো না।কিন্তু সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে অযৌক্তিক কথা বললে মেজাজ কার না খারাপ হবে।আর এখন সম্পর্ক ভাঙার ও সুযোগ নেই,মুনার বাবাকে কথা দিয়েছে সে,আরেকটা বিষয় হলো,ভিনা বড় হচ্ছে,হাজার হোক,একজন মহিলা গার্জিয়ানের দরকার পড়বে।চিন্তা ভাবনা শেষে সোহেল নিজেই আগালো কথা বলতে।
-মুনা,সেদিনের কথার জন্য আমি স্যরি।
-বাদ দাও,ভাগ্যে যখন লেখা আছে মানুষের কথা শুনতে হবে,তখন আর কী করার।
-এভাবে কেন বলছো,আমি কি খুবই অযৌক্তিক কোনো কথা বলেছি?
-আমিও কী এমন বলেছি যে তোমার কাছে মনে হলো সেটা অযৌক্তিক?
-এই ইস্যু নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছো কেন মুনা,তোমারই তো উচিৎ এটাকে এভয়েড করা।
-কোন ইস্যু?আমি যে বন্ধ্যা সেটা?জানিই তো আমি বন্ধ্যা,তার মানে এই না যে আমার মা হতে ইচ্ছে করে না,আমার মাঝে মাতৃত্ব নেই।
-যদি সত্যিই থাকতো,তাহলে আমার মেয়েটাকে তুমি অনেক আগেই এক্সেপ্ট করে নিতে।তোমার মা হওয়ার ইচ্ছা নেই,শুধু নিজের সন্তান জন্ম দেয়ার আকাঙ্ক্ষা আছে।
-সেটা কি অন্যায়?
-যখন সেটার সুযোগ নেই,তখন সেটা অন্যায়ই!
-আমার ত্রুটি নিয়ে এভাবে কথা বলার অধিকার নেই তোমার!
-বন্ধ্যাত্বকে তুমিই ত্রুটি হিসেবে দেখেছো,আমি না।আমি কখনো সেটা নিয়ে একটা কথাও বলিনি মুনা।
-কারণ তোমার নিজের একটা বাচ্চা আছে,আমার নেই।
-এতকিছু করলাম তোমার জন্য,যা চেয়েছো সব দিয়েছি,এরপরো তুমি ভিনাকে আপন করে নিতে পারলে না?
-মানে কী?তুমি যাই করেছো, সেটা কি ভিনার জন্যই?
-আমি এ বিষয়ে কথা বাড়াতে চাই না।
সোহেল বিছানা থেকে উঠে রুম থেকে চলে যেতে নিলো।মুনা সাথে সাথে যেয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো।
-আমার কথার উত্তর না দিয়ে এখান থেকে যাবে না।
-শাউট করবা না মুনা।ভিনার পরীক্ষা চলছে ।
-করবো আমি!হাজার বার করবো!আগে উত্তর দাও,আমার সাথে এইযে ভালো ব্যবহার করেছো,সাপোর্ট দিয়েছো,এসবের মূল কারণ কি ভিনা?
-মুনা সরো বলছি।
-কথার উত্তর দাও আগে।
-সব বাবা মার কাছে তার সন্তানই মূখ্য।
মুনা আস্তে করে সোহেলের হাতটা ছেড়ে দিলো।বিছানায় বসে সাইড টেবিল থেকে গ্লাস নিয়ে পানি খেলো।নিজেকে প্রতারিত মনে হচ্ছে,শূণ্য মনে হচ্ছে।নিজের স্বামীর সান্নিধ্য, এটাও ভিনার ভিক্ষা মনে হচ্ছে।
-মুনা,প্লিজ,আম স্যরি এগেইন,আমি এভাবে কষ্ট দিতে চাইনি তোমাকে।
-আমাকে একটু একা থাকতে দাও।
সোহেল পাশ থেকে সড়লো না।মুনা সোহেলের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বললো
-আমি উল্টাপাল্টা কিছু করে তোমার ঝামেলা বাড়াবো না,একি ভুল,আমি দ্বিতীয়বার করবো না।
সোহেল উঠে গেট ভিড়িয়ে চলে গেলো।এরপর রান্নাঘরে মোমেনাকে বললো স্যুপ বানিয়ে তার ঘরে দিয়ে যেতে,কর্ন স্যুপ মুনার খুব পছন্দ।তখন কিচেনে ভিনা নিজের জন্য জন্য পানির বোতল ভরছিলো।
-মার কী হয়েছে বাবা?
-কিছু না,এমনি একটু শরীর খারাপ।
মলিন হাসি দিয়ে চলে গেলো সোহেল।ভালোমত জানে যে মুনা গতকাল দুপুর থেকে কিছু খায়নি।এখন কর্ন স্যুপ খেলে হয়ত সামান্য ভালো লাগতে পারে।ভিনা কী সুন্দর মেনে নিয়েছে মুনাকে,এদিকে মুনা স্বার্থপরের মতই আচরণ করে যাচ্ছে।আগে জানলে কখনো দ্বিতীয় বিয়ের মত ভুল কাজ করত না।শিউলি অনেক ইমোশনাল ছিলো,প্রেমের দিনগুলোতে কিছু হলেই চোখে পানি এসে পড়ত।ভার্সিটিতে একদিন এক মেয়ের থেকে হাসিমুখে খাতা নেয়ায় কেঁদে অস্থির হয়ে গিয়েছিলো।ভিনা হওয়ার পরও বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি এই আচরণে।তাই স্বাভাবিকের বেশ কমই মহিলাদের সাথে কথা বলত ।সেই শিউলির ঘরে,বিছানায় অন্য একজনকে জায়গা দেয়া হয়েছে।শিউলির কষ্টই কী তার সংসারে হায় হয়ে লাগলো?
মুনা দরজা বন্ধ করে বিছানার উপর বসে আছে।সোহেলের বলা কথায় ভেতরে চাপা কষ্ট অনুভব করছে।কিন্তু আগের মত আর অসহায় লাগছে না,বরং একধরনের জিদ কাজ করছে।ছোট থেকেই সবকিছুতে কম্প্রোমাইজ করে এসেছে সে।এ্যডজাস্ট আর কম্প্রোমাইজ,এই দুইটা শব্দ দিয়েই তার পুরো জীবনকে বর্ণনা করা যায়।এসব করে কোনো লাভ হয়নি,প্রতিবারই কষ্ট তারই পেতে হয়েছে।বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে চোখের পানি মুছলো মুনা।শুরু থেকে আর যাই হোক,কোনো ধরনের মিথ্যা অভিনয় করে সম্পর্ক নষ্ট করেনি। ভিনার সাথে যত দুর্ব্যবহার করেছে,সবার সামনেই করছে।সোহেলের আচরণে ক্ষণিকের জন্য অনুতপ্ত হলেও,এখন বিন্দুমাত্র অনুশোচনা কাজ করছে না।এই একটা মেয়ের কারণে আজ তার জীবনের সব এলোমেলো।আগে এগ্রেসিভ আচরণ করত দেখে প্রতিবার ভিনা ভিক্টিম হিসেবেই সোহেলের সামনে আসত। ভিনার প্রতি ঘৃণার ব্যপারটা লুকোনো কোনো বিষয় ছিলো না।মুনা সিদ্ধান্ত নিলো এবার সে খুব ভালো ব্যবহার দিয়েই ভিনাকে মেন্টাল টর্চার করবে,শুধু তাই না,সোহেল আর ভিনার মধ্যে সম্পর্ক খারাপ করবে।সোহেল আর তার নিজের একটা সংসার হবে,যেখানে ভিনা কোনোভাবেই থাকবে না।চরম স্বার্থপর হয়ে মুনার মাঝে অদ্ভুত একটা আনন্দ কাজ করছে।সে বুঝতে পেরেছে,জীবনে ভালো তারাই থাকে,যারা স্বার্থপর হয়। স্বার্থহীন হয়ে জীবনে সুখ পায়নি,কিন্তু এবার পাবে,পেতেই হবে।আর ডুকরে কেঁদে কেঁদে জীবন পার করবে না।
•
যাবির ঘরে ঢুকেই দেখলো তার মা সাহরা খাতুন বেশ গম্ভীর হয়ে ড্রয়িং রুমে বসে আছে।বিকেলের এই সময়ে তাকে দেখে যাবির বেশ অবাক হলো।সাধারণত প্রয়োজন ছাড়া বেডরুম আর ডাইনিং রুম ছাড়া এখানে আসেন না তিনি।আর্থ্রাইটিস এর সমস্যার কারণে ঠিকমত হাঁটতে পারেন না।এছাড়াও ডায়বেটিস আছে আর একটা কিডনি প্রায় সেভেন্টি পার্সেন্ট ড্যামেজড।
-মা,তুমি এখানে,কোনো সমস্যা?
-এ মাসে কি যাও নি ওখানে?
-আসলে,খুব ব্যস্ত ছিলাম....
-আমার ঔষধ যে শেষ হয়েছে জানো সেটা?
-আমি পরশুই দেখেছিলাম।নিয়ে আসবো আজকে সন্ধ্যায়।
-টাকা আছে?
যাবির চুপ হয়ে গেলো।আসলেই ওর কাছে টাকা নেই সেই পরিমাণ।
-কী হলো?
-আমি কালকে অবশ্যই কিনে আনবো মা।
-আমি টাকা দিচ্ছি,নিয়ে আসো,এখনি।
-কিন্তু আমি তো মাত্র পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছিলাম তোমার হাতে....
-নিজের ছেলের চেয়ে বাইরের মানুষ বেশি দায়িত্বশীল,একটা দায়িত্ব দেয়া হলে ঠিকি সেটা পালন করে।
-এসে দিয়ে গেছে টাকা?
সাহরা খাতুন উত্তর দেয়ার প্রয়োজন মনে করলেন না।কোনো কড়া কথা না,চিৎকার না,কান্না না,অভিশাপ না।কিন্তু এই ঠান্ডা প্রতিক্রিয়াই যাবিরের জীবনের সবচেয়ে বড় ভয় বলা যেতে পারে।ছোট থেকেই এইভাবেই ওর মা শাসন করে এসেছে।কখনো তাকে চড়া গলায় কথা বলতে শুনেনি যাবির,কিন্তু সবসময়ই মাকে যমের মত ভয়ে পেয়ে এসেছে,এখনো পায়।
-আর কখনো এমন হবে না মা।
-তুমি কি কোনো মেয়ের সাথে সম্পর্কে আছো?
যাবিরের হার্টবিট বেড়ে গেলো,সেই সাথে প্রচন্ড নার্ভাসনেস পেয়ে বসলো।মায়ের সাথে সম্পর্ক খুবই পোষাকি,খোলাখুলিভাবে কথা হয়নি এসব বিষয়ে আগে।
-না,কেন?
-সত্যিই তো?
-হ্যাঁ।
-দেখো যাবির,সারাজীবনের শিক্ষা,ক্ষণিকের কারো জন্য নষ্ট করে দিও না।বড় হয়ে গেছো,এর বেশি কিছু বলবো না।
যাবির কোনো কথা বললো না,শুধু মাথা নাড়ালো।এরপর হাত ধরে ওর মাকে রুম পর্যন্ত নিয়ে গেলো।কীভাবে যেন এই মানুষটা সব টের পেয়ে যায়।কিছু লুকানো সম্ভব ও না তার কাছে।কিন্তু এখনো ঠিক সময় আসেনি এই ব্যাপারে কথা বলার।আসলে, ঠিকি কথা বলবে।
•
কাল ভিনার টেস্ট পরীক্ষা শেষ। শেষ পরীক্ষার দিন একটু ঢিলেমি এসে পড়ে কেন যেন।পড়তে পড়তেই কখন যেন চোখ লেগে এসেছে।ফজরের আযানের একটু আগে ঘুম ভাঙলো ভিনার।পুরো শরীর ঘামে চপচপ করছে।খুব বাজে একটা স্বপ্ন দেখেছে সে।রেলিং ছাড়া একটা ছাদের কোণায় দাঁড়ানো ভিনা,এক পাশে মুনা আরেক পাশে যাবির দাঁড়ানো।সিড়িঘরে সোহেল ।আচমকাই মুনা এসে ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়,যাবির হাত বাড়িয়ে বাঁচানোর চেষ্টা করলেও এক সময় হাত ছেড়ে দেয়। সোহেলকে চিৎকার করে ডাকার পরও শুনতে পায় না। নিচে পড়ে গিয়ে পুরো রাস্তা রক্তে মাখামাখি হয়ে যায়।পাশে শুকিয়ে যাওয়া খালে একটা নৌকায় কেউ বসে বসে সব দেখতে থাকে, অবয়ব বুঝা গেলেও মানুষটা কে চিনতে পারে না। ভিনা স্বপ্নে যখন ব্যাথায় ছটফট করছিলো,তখন শিউলি এসে আঁচল দিয়ে রক্ত মুছে কান্না করছিলো।
এই স্বপ্ন দেখে নিজের অজান্তেই কান্না করে ফেলে ভিনা।ভয়াবহ একটা অস্থিরতা কাজ করছে।খারাপ কিছু কি আসছে সামনে?
.
.
.
চলবে.................................................