অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ৪০ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


ভিনা প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে আরশি,ওয়াসিম আর বাকী সবার সাথে কথা বলে যাচ্ছে।পরীক্ষা শেষ, এরপর বেশ দেরীতে রেজাল্ট। কারো সাথেই আর নিয়মিত দেখা হওয়ার সু্যোগ নেই। কীভাবে চোখের পলকে কলেজ লাইফ শেষ হয়ে গেলো,ভেবেই পাচ্ছে না কেউ।মাত্র সেইদিনই ভর্তি হলো সবাই মিলে,আর এখন কলেজের শেষ পরীক্ষাও হয়ে গেলো।মন কেন যেন ভারী হয়ে আছে সবার।কিন্তু একটা বিষয়ে কারো নজর এড়ালো না,সেটা হলো ওয়াসিম আর আরশি।ওয়াসিম আগে সারাদিন আরশির পেছনে লেগে থাকত।এটাসেটা খুনসুটি, সবকিছু আরশির সাথেই।কিন্তু বিগত কয়েকদিন ওয়াসিম আরশির সাথে কোনো কথাই বলছে না।আরশিও ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে,কিন্তু এই বিষয়ে কথা বলার মেয়ে ও না।বরং বেশ স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছে বিষয়টা।

-এখন যাই তাহলে,প্ল্যান কিন্তু একটা থাকলোই,বের হবো রেজাল্টের পর আমরা।(আবির)

-কোথায় যাবি,ভেবেছিস?(সাদ)

-অবশ্যই দূরে কোথাও!(কথা)

-দূরে বলতে?(ওয়াসিম)

-মানে ঢাকার একটু বাইরে।(কথা)

-একটু বাইরে কেমন কথা?ঢাকার ভিতরেই ঘুরে দেখনা,সকালে গাড়িতে উঠবি,সন্ধ্যায় ও দেখবি একি জায়গায়।(ওয়াসিম)

-আচ্ছা,আমরা সবাই মিলে ডিসাইড করবো,সময় এখনো অনেক আছে।(ভিনা)

-আমি যাবো না রে।(আরশি)

-কেন যাবি না!(ভিনা)

-এমনি, পারবো না। (আরশি)

-গেলে সবাই যাবো, নাহলে কেউ না।(কথা)

-কী আজব!এত ঝামেলা কেন করিস তোরা?(আরশি)

-ঝামেলা না।কবে যেতে পারবি বলিস,আমরা ওভাবেই ম্যানেজ করবো।(ভিনা)

-আমি যাবো না রে।(আরশি)

-আচ্ছা বাদ বাদ,গ্রুপে কথা হবে,এখন চল।(সাদ)

ওয়াসিম সাথেই সাথেই চলে গেলো,একটুও দেরী করলো না। ভিনা চিন্তা করেছিলো ওয়াসিমের সাথে কথা বলবে,কিন্তু ওর এমন আচরণে আর বলতে পারেনি।পাশ ফিরে দেখলো আরশি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।চোখ যেন একরাশ ক্লান্তি নিয়ে ভারী হয়ে আছে।এই বয়সের একটা মেয়ের চোখজুড়ে স্বপ্ন থাকবে,উচ্ছ্বলতা থাকবে।ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে অনেক ক্ষেত্রেই সেটা হয় না।বেশির ভাগ মানুষ এই সময়টাকে রঙ্গিন বললেও,সত্যিটা ভিন্ন।আবেগ,কল্পনা,বাস্তবতা সবকিছুর সাথে অন্তর্দ্বন্দ্বে জড়িয়ে এই বয়সটা ধূসর হয়ে যায়। ভিনা যেয়ে আরশির কাঁধে হাত রাখলো।

-ওয়াসিমের জন্য যাবি না?

-ওরে মনে হয় দুই পয়সা দাম দেই আমি?

-আরশি,সত্যি করে বল তো,কেন যাবি না।

-তোর মত বড়লোকের বেটি না আমি।এইযে বাইরে যাওয়ার জন্য সবাই লাফাইতেসে,সবার টাকা আসে।

-শান্ত হ।প্লিজ।খুলে বল কী হয়েছে। 

আরশির বাস স্টপের যাত্রী ছাউনিতে বসলো।কোনো শব্দ হচ্ছে না,কিন্তু চোখ থেকে পানি পড়ছে।এই ধরনের কান্না মানুষ কী পরিমাণ কষ্ট পেলে কাঁদে,ধারণা নেই ভিনার।

-আরশি?কী হয়েছে? আমাকে বলবি না?

-আমার আর কী হবে? যা হওয়ার হয়ে গেছে আগেই।

-মানে?

-তুই আমার সম্পর্কে কিছুই জানিস না,কিছুই না।

-আমি জানি.....ওয়াসিম বলেছিলো আমাকে...

-ওর আর কতটুকুই বা জানে।

-তুই কি ওয়াসিমের বিহেভে কষ্ট পেয়েছিস?

-না,আমি জানতাম এমন কিছুই হবে।মোটেও অবাক হইনি।মাহতাব চলে যাওয়ার পর,কারো যাওয়াই আমার কষ্ট লাগে না।

-মাহতাব?কে?

-যার সাথে সংসার করার কথা ছিলো আমার।

-যা গেছে,গেছেই।তুই ওর চেয়ে ভালো কেউই ডিসার্ভ করিস।ও তোর যোগ্যই না।

-এটা সবচেয়ে বাজে কথা ভিনা।আমি বাচ্চা না যে আমাকে এসব বলে মন ভোলাবি।আমার বয়স জানিস তুই?

-ঐত,বিশই হবে।

-না,এর চেয়ে বেশি।

-হলে হোক,তাতে কী।তোকে তো আপা ডাকবো না তাই বলে।

-বয়সের কথা আসলে ভুল।যে যত দুনিয়াটা দেখেছে,তার বয়স তত বেশি।আর আমার,দুনিয়া দেখার বাকী নাই।

-আমি জানি আরশি। তুই ওয়াসিমের ব্যবহারে মন খারাপ করিস না।

-এই কথাটা বারবার বলিস না,তুই আমার সম্পর্কে কিছুই জানিস না ভিনা।আর ওয়াসিমের এই ধরণের আচরণে আমি বিন্দুমাত্র কষ্ট পাই নাই।কারণ ও যাই করছে,ওর মার জন্য করছে।

-কী বলিস!কেন?

-আছে অনেক ব্যাপার। বললাম না,তুই কিছুই জানিস না।বাদ দে।

-খুলে বল আমাকে।

-দরকার হলে বলবো,আমি চাই না কখনো যেন দরকার পড়ুক। 

-আচ্ছা ছাড়।কথা যখন এতবার বলেছে,চল না।আমি তো আছিই।কতইবা খরচ পড়বে।

-কথার জীবন টা কত সোজা,তাই না রে।শুধু পড়াশোনা করে,ঘুরে বেড়ায়।আর কোনো চিন্তা নাই।খোদা কিছু মানুষের জীবন এত সোজা করে বানায় কেন বলতে পারিস?

-জানলে তো ভালোই হত।

-উঠি এখন।

আরশির খুবই ধীরে হেঁটে হেঁটে চলে গেলো।ভিনার খুব কষ্ট হচ্ছে।এই মেয়েটার জীবনের সব কষ্ট যেন শেষ হয়ে যায়,মন থেকে এই একটা দোয়াই করলো। 

খুব ক্লান্ত লাগছে দেখে আর হেঁটে যেতে ইচ্ছা করছে না ভিনার।বাসায় দুইটা গাড়ি থাকতেও বছরে খুব বেশি হলে চার-পাঁচবারই ওঠা হয় ঐটাতে।রিকশা খোলামেলা, চড়ে মজা।খালি রিকশা ডাক দিতেই চমকে উঠলো।

-আজকে হেঁটে যাবে না?

-যাবির!এভাবে চোরের মত আসো কেন তুমি?কিচ্ছু টের পাই না।কখন এসেছো?

-এসেছি আগেই।দেখলাম তো,কত আয়েশ করে কথা বলছিলে তোমার ফ্রেন্ডদের সাথে।

-আসার বিশেষ কারণ?

-বিশেষ কারণে দেখা তো নরমাল ফ্রেন্ডরা করে।প্রেমিকদেরই বৈশিষ্ট্যই অকারণে দেখা দেয়া।

-বাড়াবাড়ি করছো কিন্তু। আমি কখন বলেছি তুমি আমার বয়ফ্রেন্ড?

-আমি কখন বললাম আমি তোমার বয়ফ্রেন্ড?আমি কি ঠিক এই কথাটাই বলেছি?নিজের ফিলোসোফি ঝাড়লাম একটু।

-সব বাদ।আমি ক্লান্ত,বাসায় যাবো।তোমার কোনো কাজ আছে?

-কী আজব!আমাকে এভাবে ফেলে তুমি বাসায় যাবা?

-তো কী চাও তুমি?

-তোমার সাথে ঘুরতে।

-কেউ দেখে ফেললে ঝামেলা হবে।

-পরীক্ষা শেষ হয়েছে আড়ে এগারোটায়,এখন বাজে একটা। কার এত তেল আছে যে তোমার উপর নজরদারি কর‍তে দাঁড়ায় থাকবে?

-কফিশপে চলো।

-তুমি না রিকশা নিচ্ছিলে?

-তুমিই তো বাসায় যেতে দিলে না।

-বাসায় যেতে মানা করেছি,রিকশা নিতে তো মানা করিনি।

ভিনা ভ্রু কুচকে যাবিরের দিকে তাকিয়ে আছে।বোঝার চেষ্টা করছে সব।

-তুমি কি আমার সাথে রিকশায় ঘোরার প্ল্যান করছো?

-নিজের মনের কথা বেশ ভালোমতো গুছিয়ে বলতে পারো ভিনা।

ভিনা আর কিছু বললো না।জানে যে কথায় এই ছেলের সাথে পারা যাবে না।

-কোথায় যেতে চাও?

-আশেপাশেই।

দ্বিতীবার যাবিরের সাথে রিকশায় উঠলো ভিনা।এবার অন্যরকম অনুভূতি কাজ করছে।প্রতিটা লোমকূপে শিহরণ জেগেছে।চোখে চোখ রেখে তাকানো যাচ্ছে না।আড়ষ্টতা চেপে ধরেছে।নার্ভাসনেসে হাত ঘেমে গেছে ভিনার।

-কী হয়েছে?

-জলদি বাসায় যাবো।

-নার্ভাস লাগছে?আমারো লেগেছিলো,যেদিন প্রথম তোমার সাথে রিকশায় উঠেছিলাম।

আধাঘন্টা রিকশা দিয়ে ঘুরে যাবির ভিনাকে বাসায় নামিয়ে চলে গেলো।পুরো সময়টার কথা চিন্তা করে মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়লো ভিনার ঠোঁটে।না,জীবনটা এতও খারাপ না।


সকালে উঠেই মুনা সোহেলের জন্য এক কাপ কড়া লিকারের চা বানিয়ে নিয়ে এসেছে।গোসল করে ভেজা চুল দিয়ে বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতে সোহেলের ঘুম ভাঙ্গালো।

-শুভ সকাল মাই ডিয়ার হাজবেন্ড।
 
পুরো বিষয়টা বুঝতে সোহেলের একটু সময় লাগলো।বিয়ের পর কখনো মুনা এভাবে ঘুম ভাঙ্গায়নি।এর উপর গতকালের ঘটনার পর সোহেল মোটেও আশা করেনি মুনা এত ভালো মুডে থাকবে।

-শুভ সকাল।

-কী হলো,এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?

-সুন্দর লাগছে তোমাকে।

-উহু,এটা ভেবে অবাক হচ্ছো যে আমি কেন এত ভালো ব্যবহার করছি,তাই না?

-না মানে,হ্যাঁ... 

মুনা সোহেলের হাত নিজের হাতে নিয়ে বললো,

-ভুল তো করেছি,এখন চাচ্ছি সব গুছিয়ে সুন্দরভাবে সংসার করতে।শিউলির জায়গা আমি চাই না,পাবোও না।কিন্তু নিজের একটা জায়গা তো করে নিতেই পারি,তাই না?

-সত্যি বলছো তুমি?আমার কালকের কথায় কষ্ট পাও নি?

-কষ্ট পেয়েছি সত্যি,কিন্তু তুমি ভুল ছিলে না।ভিনাকে সন্তান জায়গা দিয়ে,নিজের কষ্ট তো আমি ভুলতেই পারি। 

-আমার খুব ভালো লাগলো মুনা।আমি এরকম পরিবেশই চাচ্ছিলাম,যেখানে সবাইকে নিয়ে খুশি থাকা যাবে।

-আমিও এভাবেই থাকবো।দেখোতো,বিয়ের পর কিন্তু আমাদের কোথাও বাইরে যাওয়া হয়নি,ভিনার পরীক্ষাও শেষ, আমাদের বাইরে যাওয়া উচিৎ একবার।

-ঠিক বলেছো।নানা ব্যস্ততায় আসলে কিছুই হয়ে উঠেনি।মেয়েটার ও ভ্যাকেশন দরকার।মুখ ফুটে কিছু বলে না কখনো ও।

-সেটাই তো। এই ভ্যাকেশনই নাহয় আমাদের হানিমুন হলো।

-খুব ভালো কথা বলেছো,ভিনাকে নিয়ে গেলে কোনো সমস্যা হবে না তো তোমার?

-কী যে বলো তুমি!সমস্যা কেন হবে!আর এখানে ওকে কোথায়ই বা রাখবে।রুপিনের কাছে যদিও রাখা যায়,তবুও,মেয়ে বড় হয়েছে,এভাবে কারো বাসায় রাখাটা ঠিক হবে না।

-সেটাই।তোমাকে নিয়ে এমনিই আমি ঘুরতে যাবো পরে। 

-সমস্যা নেই।তুমি ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করতে আসো।ভিনা দুপুরে আসলে আমি জানিয়ে দিবো। 

-আমার মেয়েটা একা একাই বড় হয়ে গেলো,তাই না?

-আর একা বড় হতে হবে না,এবার আমি আছি।

মুনা দুপুরে ভিনার আসার অপেক্ষা করতে লাগলো।আজকে পরীক্ষা শেষ হয়ে খুব ফুরফুরে মেজাজে থাকবে নিশ্চয়ই, কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে দিবে না।
.
.
.
চলবে...................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন