পরিণয়ে পরিপূরক - পর্ব ২৪ - স্পৃহা নূর - ধারাবাহিক গল্প


দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে কিছুতে। পাশে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। কিছুটা এগিয়ে যেতেই দেখল মানুষ টা আর কেউ নয় অভ্রনীল। এক হাতে দিয়াশলাই বক্স অন্য হাতে কেরোসিন এর বোতল। আগুনের লাল শিখার আলোয় একদম টকটকে লালচে হলদে আভা পড়েছে অভ্রর মুখে।
.
.
অভ্র এক দৃষ্টে চেয়ে আছে আগুনের শিখা গুলোর দিকে । অবন্তী ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসছে সে বিষয়ে লক্ষ্যই করে নি । 
.
" এই মাঝ রাত্তিরে এভাবে কি পোড়াচ্ছেন অভ্রনীল? "
.
অবন্তী কথাটা বলতে বলতে অভ্রর হাত ধরে । 
আগুনের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অবন্তীর দিকে তাকাতেই চমকে ওঠে অভ্রনীল। অবন্তী তার ডান হাত ধরেছিল। ডান হাতে থাকা কেরসিনের বোতল চট করে ফেলে দেয় অভ্র। 
.
— হুম???
— রাত আড়াইটে বাজে । কি করছেন টা কি এখানে?
— সে কৈফিয়ত আমার তোমাকে দিতে হবে? আর তোমার সাথে কি দুটো চোখ নেই দেখতে পাচ্ছ না কি করছি? টিকটিকির মতো দুটো থ্রি সিক্সটি ডিগ্রি এঙ্গেল এর চোখ তো লাগিয়েই রেখেছ আমার পেছনে দেখছি।
— এভাবে ধমকাচ্ছেন কেন?আমি রেগে যাবার মতো কি বললাম? আপনি এত রেগে যাচ্ছেন কেন আমার ওপর?
— রাগবো না তো কি করব শুনি? আমি এর আগেও লক্ষ্য করেছি অবন্তী তুমি আমাকে ফলো করো চুপি চুপি। কেন হ্যা কেন? কি? কি জানতে চাও আমার ব্যাপারে হুম??? 
— এত রাতে ঘরে নেই বলে আমি তো শুধু খুজতে এসেছিলাম। আপনি এত কিছু কেন ভেবে নিচ্ছেন? 
.
(অবন্তী একদম কাদো কাদো হয়ে যায় কথা গুলো বলতে বলতে)
.
— ওহ আচ্ছা। তাহলে সেদিন দিনের বেলায় ও আমাকে খুজতে গেছিলে বুঝি স্টোর রুমে? আমি ভালো ভাবেই বুঝতে পেরেছিলাম অবন্তী তুমি দরজার আড়ালে আমাকে ফলো করছিলে। 
.
— তখনকার ব্যাপার আলাদা। তখন আমার আপনাকে অন্যরকম লাগত। কেমন যেন রহস্যময়। কিন্তু এখনকার ব্যাপার আলাদা। এখন আমার ভয় হয় আপনাকে নিয়ে । আপনি বুঝবেন কি করে আপনাকে নিয়ে কত রকম ভয় হয় আমার। 
.
— দরকার নেই আমার অত কিছু বোঝার। চুপচাপ রুমে চলে যাবে তুমি এখন। 
.
— কিন্তু এগুলো কি পুড়ছেন?
— লেবু আর লঙ্কা ।
— কিহ? কেন?
— ভুত তাড়াব । হ্যাপি এবার? 
— সত্যিটা বলবেন না তো? লেবু লঙ্কা পুড়লে অবশ্যই মরিচের ঝাঝ পাওয়া যেত।
— বুঝতেই যখন পারছ এত জিজ্ঞেস করছ কেন? রুমে যেতে বলেছি রুমে যাও। আমার সাথে জাসুসি ! 
.
.
অভ্র ওকে এভাবে ধমকাবে অবন্তী আশা ও করে নি। রুমে এসে বসে বসে অর্নির কথা গুলোই আবার ভাবছে। 
.
" এখন তো সত্যিই মনে হচ্ছে অভ্রনীল সত্য মিথ্যে মিশেল এর মহান কারিগর। এত রাতব কি এমন পুড়ল? আমাকে বলল পর্যন্ত না । কিসের এত আড়াল ওর?"
.
.
বার বার ভাবতেই থাকে অবন্তী কথা গুলো। 
.
অভ্র একদম পুড়ে যাওয়া ছাই গুলো অন্য পাশে মাটিতে গর্ত করে মাটি চাপা দিয়ে দিল । মাটি গুলোতেও পানি ছিটিয়ে আর হাত দিয়ে চাপ দিয়ে দিয়ে আগের মতো করার চেষ্টা করল। অন্যপাশ থেকে ঘাস সহ মাটির চাপা নিয়ে এসে বসিয়ে দিল। যেন বোঝা না যায় এখানে কিছু হয়েছে । এসব করতে করতে কিছুটা ঘেমেও উঠেছে। 
.
অভ্র কাজ সেরে রুমে এসেই ধপাস করে শুয়ে পড়ল। কোন কথা নেই । কম্বল দিয়ে মাথা পর্যন্ত ঢেকে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। 
আবার কিছুক্ষণ পর কি যেন মনে হয়ে চট করে উঠে পড়ল। 
উঠেই অবন্তীকে আবার এক ধমক,
.
" এই মেয়ে ঘুমোতে কি প্রবলেম হচ্ছে তোমার? আমার ওপর রাগ করে সারারাত জেগে থাকবে? নাও কম্বল নাও । শীত শীত পড়তে শুরু করেছে ঠান্ডা লাগবে না?" 
.
অবন্তী উপায় না পেয়ে চুপচাপ বাধ্য মেয়ের এর মতো শুয়ে পড়ে । সে বুঝতে পারে এখন খামোখা রাগ দেখালে অভ্র আরো রাগ করবে । এই মাঝ রাত্তিরে বাড়িতে অশান্তির কোন মানেই হয় না । 
.
.
" দেখুন আমার আপন বলতে এই পৃথিবীতে এখন একমাত্র আপনি ই । সেই আপনি এভাবে অকারণে আমার ওপর রাগ করবেন না । " 
.
অবন্তী কাচুমাচু হয়ে অভিমানের সুরে কথা গুলো বলতেই অভ্র ওকে নিজের বাহুতে জড়িয়ে নেয়।
.
"সব কিছু সহজ ভাবে নিলেই তো হয় । এত জটিল ভাবে ভাবো কেন তুমি?"
.
"আমি কিছুই জটিল ভাবে ভাবি নি। আপনি নিজেই অনেক জটিল। আপনার ধ্যান ধারনা মন মানসিকতা অত্যন্ত জটিল।"
.
" হুম এইসব জটিল কথা থামাও তো । আমি এখন জটিল একটা ঘুম দেবো ।"
.
.
পরদিন অভ্র অফিস যাবার পর অবন্তী আবার সেই জায়গায় গেল। সত্যি বলতে সন্দেহ একটু হচ্ছেই। এত রাতে কি এমন পোড়ালো? তাও আবার বললও না সত্যি কথাটা। 
নাহ কোন কিছুর চিহ্ন মাত্র নেই এখানে।
.
 .
 "আচ্ছা , অভ্র কাল রাতে স্টোর রুমের কথাও বলেছিল। শুধু মাত্র এলবাম খুজলে আর সেটাকে ফলো করলে কি এমন দোষের? ও এমন ভাবে রিয়াক্ট করল যেন কি না কি খুজছিল। আর আমি দেখে ফেলে বড্ড দোষের কিছু করে ফেলেছি ।" 
.
.
অবন্তী কথা গুলো মনে মনে আওরাতে থাকে। আবার ভাবে, 
" একবার স্টোর রুম চেক করলে কেমন হয়? "
.
.
যেই বলা সেই কাজ। নাহ। অনেক্ষন তন্ন তন্ন করে খুজেও তেমন কিছুই পাওয়া গেল না । কিন্তু কাল বলা অর্নির কথা গুলো ও মাথার এক কোণে কিছুটা হলেও জায়গা দখল করে নিয়েছে। কথা গুলো জায়গা দখল করত না, যদি না রাতে অভ্র লুকিয়ে ওমন কিছু করত। 
.
.
"অর্নির কথাই কি ঠিক? অভ্র সত্যি কি সত্য মিথ্যে ...কেন কিছু বলল না কাল ? কি লুকোতে চায় ও? "
.
আবার দলা পাকে কথা গুলো। তার সাথে সাথে অবন্তীর এবার অন্য একটা ব্যাপার খেয়াল হলো । 
.
অভ্র'র স্টাডি রুমে সময় কাটানোর ব্যাপারে। হঠাত এত বই পড়ার শখ কি করে হয়ে উঠেছিল? আবার তো ছেড়েও দিয়েছে সে শখ ক দিন হলো । এখন ও পড়ে কিন্তু গত কিছুদিন একটু বেশিই হয়েছিল। সারাদিন অফিস সেরে প্রায় সারারাত ও রুমে । 
.
.
স্টাডি রুম ও লক করে রেখেছে এ ছেলে। বাড়ির চাবির গোছায় সব রুমের চাবি আছে কিন্তু স্টাডি রুমের নেই। অথচ বাড়ির অন্য কেউ জানেই না এখানে ও রুমের চাবি নেই। অভ্র কখন সরিয়ে ফেলল? কে জানে! 
.
.
ব্যাপারগুলো ক্রমান্বয়ে আরো বেশি খটকা লাগতে শুরু করে অবন্তীর। 
.
অভ্র বাড়ি ফেরার সাথেই অভ্র'র সাথে বায়না ধরল স্টাডি রুমে যাবে। চাবি চাই তার।
.
— সবে বাড়ি ফিরলাম । চেঞ্জ করি, ফ্রেশ হই। 
— হ্যা কে মানা করেছে আপনাকে? আমাকে চাবিটা দিয়ে দিন । আমি নিজেই খুলে নেব। আপনি চেঞ্জ হোন, ফ্রেশ হোন । 
— কি এমন দরকার তোমার ও রুমে শুনি? এত তাড়া দিচ্ছ যে?
— বই পড়ব । আপনার মতো । 
— কিহ?
— হুম। দিন বলছি দিন। কোথায় রেখেছেন চাবি?
.
(অবন্তী অভ্র'র পকেটে হাত দিয়ে নিজেই খুজতে থাকে)
.
— কি আশ্চর্য! হচ্ছে টা কি এসব? ছোট বাচ্চাদের মতো শুরু করলে দেখছি।
— ছোট বাচ্চা হলে ফিডার খাবার জন্য জেদ করতাম ।
— তোমার কি মনে হয় এভাবে খুজলে পাবে?
— তো দিন না!

— কেন? যদি না দিই?
— আমি যদি বলি দিতেই হবে । 
.
.
অবন্তীর জেদের সাথে আজ কিছুতেই পেরে ওঠে না অভ্রনীল। শেষ পর্যন্ত তাকে দিতেই হয় চাবিটা । না দিলে আরো সন্দেহ করবে । এমনিতেই কাল হুট করে মাথা গরম করা তে অবন্তী যে তাকে সন্দেহ করেছে এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত। 
কিন্তু সন্দেহকারী ব্যাক্তিকে কখনোই বুঝতে দেয়া উচিত নয় যে যার ওপর সন্দেহ করা হচ্ছে সে বুঝে গেছে ব্যাপারটা । তাহলে হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই এখন অভ্রকে স্থির, সরল, সহজ ভাবে থাকতে হবে । কোন মতেই হাইপার হওয়া যাবে না । তাহলে ধরা পড়ার আশংকা প্রবল।
.
অবন্তীকে রুমের চাবি দিয়ে মনে মনে একবার সুরা ফাতিহা, তিন বার সুরা এখলাস আর তারপর বার বার দোয়া ইউনুস পড়তে থাকে।
.
"অভ্রনীল ধরা পড়ে যাবি এত তাড়াতাড়ি? এত দিনের এত চেষ্টা সব বৃথা যেতে দিবি? একটু মিথ্যের জন্য এত সুখ! ছেড়ে দিবি সব কিছু? 
পৃথিবীর সবার মতো তোর ও অধিকার আছে সুখ স্বাচ্ছন্দ্য পাবার । সারা জীবন মিথ্যে দোষের বোঝা বইয়ে এসব কিছুই পাস নি তুই।অন্যরা সবাই অবিশ্বাস করেছিল প্রথমে। এখনো হয়ত করে । বুঝতে দেয় না যদি আবার অসুস্থ হয়ে পড়িস সেই ভয়ে । 
অবন্তী ই কিন্তু একমাত্র যে নির্দ্বিধায় তোকে বিশ্বাস করে ।হ্যা এবার একটু ভুল বা দোষ হয়েই গিয়েছে তোর দারা। কিন্তু এক বার সব কিছু জানলে?ছেড়ে চলে যাবে ও তোকে । চলে যাবে..."
.
নিজের ভেতরের সত্ত্বা বার বার অভ্রনীলকে বলে যায় কথাগুলো !
.
.
.
চলবে...........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন